ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধান্দাবাজরা

প্রকাশিত: ২০:১৮, ২৬ জুন ২০২১

শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধান্দাবাজরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ২৫ জুন ॥ সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের পৈত্রিক পেশা টিকিয়ে রাখতে রং, সুতা, কেমিক্যাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত প্রকল্প চালু করলেও তা তাদের কল্যাণে আসছে না। বরং তাঁতিদের এ শুল্ক ছাড়কে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর ধান্দাবাজ ব্যবসায়ী তাঁতি সমিতির নামে রং, সুতা আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে কালোটাকার পাহাড় গড়ছেন। এভাবে দেশের ৫১টি তাঁতি সমিতির নামে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দেশের ৫১টি তাঁতি সমিতির নামে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার তাঁত কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদীসহ কয়েকটি জেলার প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে এ শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করা হয়। কিন্তু প্রান্তিক সমিতির সদস্যরাই জানেন না তাদের তাঁত দেখিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে ধান্দাবাজ কতিপয় ব্যবসায়ী। তাঁত বোর্ড পাবনা অফিস সূত্রে প্রকাশ, পাবনায় ৫টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে প্রায় ৪৫ কোটির শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। এ ৫টি সমিতি হলো-গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, গয়েশপুর ৩ নং প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, আতাইকুলা ৬নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, দোগাছি ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং একদন্ত ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। এসব সমিতির প্রান্তিক তাঁতিরা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির কোন সুফল পাননি। পাবনা তাঁত বোর্ডের দোগাছি লিয়াজোঁ অফিসের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিলেও তাঁতিদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করায় তাঁতিরা সুবিধা পাচ্ছেন না। পাবনার শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানিকারক ৫টি সমিতি অনুসন্ধানে দেখা যায় আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামালের কিছুই পাননি তাঁতিরা। এই ৫টি সমিতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে গয়েশপুর ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। কাঁচামাল না দিয়ে সমিতি থেকে তাঁতিদের প্রত্যেককে হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সমিতির সভাপতি আয়ুব হোসেন জানান, শুল্কমুক্ত যেসব কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে তারমধ্যে পলিয়েস্টার সুতা তাঁতিদের কাজে লাগে না। এ ছাড়া এলসির মাধ্যমে আমদানির জন্য অপেক্ষা করার মতো সময় এবং অর্থ কোনটাই নেই প্রান্তিক তাঁতিদের। সাঁথিয়ার এক ব্যবসায়ী তাকে এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানির কথা বললে তিনি রাজি হন । সেই ব্যবসায়ী আমদানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এখানে তাঁতিদের কোন অর্থ ব্যয় হয়নি আমদানির লভ্যাংশ হিসেবে ছয় লাখ টাকা তাকে দেয়া হয়। তিনি সমিতির ৫৫৮ সদস্যের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করোনাকালীন সহায়তা হিসেবে দিয়েছেন বলে জানান। একইভাবে আতাইকুলা ৬নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সদস্য প্রান্তিক তাঁতিরা তারাও শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির কোন খবর জানেন না। পাবনা তাঁত বোর্ডের দোগাছি লিয়াজোঁ অফিসের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার জাকির হোসেন জানান, সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিলেও তাঁতিদের অজ্ঞতার সুযোগে একটি চক্র আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করায় প্রান্তিক তাঁতিরা সুবিধা পাচ্ছেন না। এ সুবিধা ব্যবহার করে সুতা ও রঙের মতো কাঁচামাল আমদানিও করছে পাবনার বিভিন্ন তাঁতি সমিতি। তবে যাদের নাম করে এ সুবিধা নেয়া হচ্ছে সেই প্রান্তিক তাঁতির বেশিরভাগেরই এসবের কিছু জানা নেই। এ সুযোগে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল বিক্রি করে দিচ্ছে একটি চক্র। গয়েশপুর ২নং ওয়ার্ড তাঁতি সমবায় সমিতির ১৩০ তাঁতির ১ হাজার ২ শ’ ৯০টি তাঁতের বিপরীতে প্রায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়েছে। সমিতির বেশিরভাগ প্রান্তিক তাঁতি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি নিজেও কিছুদিন আগে কাঁচামালের কথা জানতে পেরেছেন। আমদানিকৃত কাঁচামাল ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে সমিতি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার সুতা, সোডিয়াম সালফাইডসহ বিভিন্ন কাঁচামাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির অনুমতি পায় গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। এরপর এসব কাঁচামাল নিয়েও আসা হয়। প্রান্তিক তাঁতিদের নামে এত কিছু হলেও তারা কিছুই জানতে পারেননি। আমদানি-রফতানি বিভাগের অফিস আদেশ থেকে জানা গেছে, চারটি শর্তে গয়েশপুর ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতিকে এ শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্তই হলো শুল্কমুক্ত এসব কাঁচামাল সমিতির ১৩০ তাঁিীর ১২৯০টি তাঁতে ব্যবহার করতে হবে। এসব মাল কোথাও বিক্রি বা হাত বদল করা যাবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি দালাল চক্র ওই সমিতির নেতাদের মাধ্যমে এসব শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একইভাবে আতাইকুলা ৬ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আকাশ হোসেন জানান, তাকে সাঁথিয়ার একজন ব্যবসায়ী এলসি সম্পর্কে বলেন। এলসি খোলা, আমদানির পুরো প্রক্রিয়ায় তার কোন জ্ঞান নেই। তিনিই সমিতির নামে পণ্য আমদানি করে তা বিক্রির লভ্যাংশ থেকে দুই লাখ টাকা সমিতিকে দেন। সমিতির ১৭২ সদস্যের মধ্যে ৭০০ টাকা করে লভ্যাংশ হিসেবে টাকা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। একদন্ত ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে ৬ কোটি সাড়ে ৭ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানির অনুমতি পেলেও ৫ কোটি ১০ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয়। সমিতির ৩শ’ ১৮ প্রান্তিক তাঁতির ১ হাজার ৪০টি তাঁতের বিপরীতে এ শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির ঘটনা সদস্যভুক্ত প্রান্তিক তাঁতিরা কিছুই জানেন না। সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা এ আমদানি করেন। আরও অবাক যে সেক্রেটারি শওকত আলীকেও জানানো হয়নি। প্রান্তিক তাঁতিদের করোনায় সরকারী অনুদানের কথা বলে ২শ’ ৪০ জনকে ৮শ’ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। কাঁচামাল আমদানির এ ঘটনা জানাজানি হলে তাঁতিদের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরপর গত শনিবার একদন্ত ইউপি সদস্য আমির হোসেন শিবপুর বড় মসজিদের পাশের মক্তবে এ নিয়ে মীমাংসা বৈঠকে করলেও কোন সুরাহা হয়নি । শুক্রবার আবারও এ নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে বলে ইউপি সদস্য আমির হোসেন জানান। প্রান্তিক তাঁতিদের দাবি, সভাপতি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিলেও তাদেরকে করোনা সহায়তার নামে ৮শ’ টাকা দেয়া কিছুতেই মানা যায় না।
×