
স্টাফ রিপোর্টার ॥ অভিনয়ের শক্তিতে নিজের নামটিকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন এটিএম শামসুজ্জামান। ছিলেন একাধারে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার। নিভে গেল বর্ণময় গুণী এই মানুষটির জীবন প্রদীপ। শনিবার সকাল ৯টা ৬ মিনিটে সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। বুধবার সকালে পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল খুবই অসুস্থ এটিএম শামসুজ্জামানকে। তার অক্সিজেন লেভেল কমে গিয়েছিল। হাসপাতালে ডাঃ আতাউর রহমান খানের তত্ত্বাবধানে ছিলেন জনপ্রিয় এ অভিনেতা। তার মেয়ে কোয়েল আহমেদ বলেন, আব্বা হাসপাতালে থাকতে চাইছিলেন না। তাই শুক্রবার বাসায় নিয়ে আসি। শনিবার সকালে নাস্তার জন্য ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারি, বাবার ঘুম আর ভাঙবে না।
শনিবার বাদ আসর রাজধানীর পুরান ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রাায় শায়িত করা হয়। এর আগে সূত্রাপুর জামে মসজিদে এই কিংবদন্তির দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টারে তার মরদেহ রাখা হয়। তার প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয় বাদ জোহর নারিন্দার পীর সাহেব বাড়ি মসজিদে। এর আগে এটিএম শামসুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নারিন্দার পীর সাহেব তার গোসলের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা ॥ বরেণ্য অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গভবন প্রেস উইং জানায়, শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে তার অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। এটিএম শামসুজ্জামানের রুহের মাগফিরাত কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং জানায়, শেখ হাসিনা শোক বার্তায় বলেন, জনপ্রিয় এই শিল্পী তার অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এছাড়া এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মোঃ শাহাবউদ্দীন, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসছে চলচ্চিত্রসহ গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। এটিএম শামসুজ্জামানকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে অভিনেত্রী তারিন বলেন, এই মাসের শুরুতে আমার বাবা মারা যান, আজ মিডিয়ায় যে আমাকে মেয়ের মতো আগলে রাখতেন, সেই পিতা চলে গেলেন। একই মাসে আমি দুই পিতাকে হারালাম। তিনি বলেন, উনি যে আমাকে কতটা স্নেহ করতেন, তা বলে বোঝাতে পারব না।
শামসুজ্জামানকে বিদায় জানাতে আসেন অভিনেত্রী আনোয়ারা। বরেণ্য অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান পর্দায় নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করলেও বাস্তবে অনেক ভাল মানুষ ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ অভিনেত্রী আনোয়ারা। শনিবার এটিএম শামসুজ্জামানকে শেষবারের মতো দেখতে রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে এই অভিনেতার বাড়িতে উপস্থিত হন অভিনেত্রী। আনোয়ারা বলেন, উনি সাধারণত ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পর্দার খারাপ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করলেও বাস্তবে অনেক ভাল মানুষ ছিলেন। উনার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তা বলে শেষ করা যাবে না। বরেণ্য অভিনেতার রুহের মাহফিরাত কামনা করেন আনোয়ারা। এছাড়াও এটিএম শামসুজ্জামানকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছেন বৃন্দাবন দাশ, শাহানাজ খুশি, দীপু হাজরা, ইলিয়াস কাঞ্চন, এস এ অলিকসহ আরও অনেকে।
এটিএম শামসুজ্জামানের বর্ণাঢ্য জীবন ॥ মূল নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান হলেও কিংবদন্তি এ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান নামেই তুমুল জনপ্রিয়। ছোটপর্দা কিংবা বড়পর্দা সকল ক্ষেত্রেই তার সরব উপস্থিতি। ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এই কিংবদন্তি। তবে তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের ভোলাকোটের বড় বাড়ি। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেন এলাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর এটিএম জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। বিনোদন দুনিয়ায় এটিএমের পরিবারের কোন সূত্র ছিল না। কিন্তু নিজের ভবিষ্যত এই জগতেই ভেবেছিলেন তিনি। সেই লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।
এটিএম শামসুজ্জামানের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সে সময় তিনি কয়েকটি সিনেমায় কৌতুকাভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই চরিত্রে তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’ ইত্যাদি।
চিত্রনাট্যকার ও কাহিনীকার হিসেবেও সফল এটিএম শামসুজ্জামান। তার চিত্রনাট্যে প্রথম সিনেমা হচ্ছে ‘জলছবি’। পরবর্তীতে তিনি শতাধিক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন।
কৌতুক চরিত্রে তিনি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এরপর নিজের অবস্থান আরও বেশি পোক্ত করেন খল অভিনেতা হিসেবে। খল চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের অভিষেক হয় ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ সিনেমার মাধ্যমে। এই সিনেমার পর তিনি বহু বছর ধরে খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর কুড়িয়েছেন প্রশংসা। নেতিবাচক ভূমিকায় এটিএম যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘চোরাবালি’।
তার অভিনীত সিনেমার তালিকাটা দীর্ঘ। সেই তালিকায় সফল সিনেমার সংখ্যাই বেশি। তার মধ্যে রয়েছে- ‘বড় বউ’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমণি’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সুর্য দীঘল বাড়ি’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘দাদীমা’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘চাঁদের মতো বউ’, ‘গেরিলা’, ‘লাল টিপ’ ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের প্রাপ্তি অনেক। শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে একবার, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে একবার এবং আজীবন সম্মাননা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া ২০১৫ সালে শিল্পকলায় অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক লাভ করেন এই গুণী অভিনেতা।
টিভি নাটকেও এটিএম শামসুজ্জামানের অবস্থান প্রথম দিকে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নাটক, টেলিফিল্মে অভিনয় করে আসছেন। শেষের দিকটাতে তিনি সিনেমায় কাজ করলেও নাটকেই বেশি দেখা গেছে। তার অভিনীত শত শত নাটক রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘শিলবাড়ি’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’, ‘শতবর্ষে দাদাজান’, ‘সেরা কিপ্টুস’, ‘নাপিত’, ‘গরু চোর’, ‘মুরুব্বি জামাই’, ‘আমার বউ বেশি বুঝে’, ‘পিতা পুত্র’, ‘সিন্দুকনামা’, ‘ওস্তাদজি’, ‘আক্কেল আলীর নির্বাচন’, ‘ইলু ইলু’, ‘শোধবোধ’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘তরিক আলী হাডারি’ ইত্যাদি।