ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মামুনুল দীনের কদলিপ্রস্ত

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৫ মে ২০২৫; আপডেট: ২০:৩৪, ২৫ মে ২০২৫

মামুনুল দীনের কদলিপ্রস্ত

লেখক প্রসঙ্গে

মামুনুল দীন, জন্ম ১৯৭৮ সালে, শরীয়তপুর জেলায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন। ২০০১ সাল থেকে প্রবাসী, সুইজারল্যান্ডে করেছেন হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্টে স্নাতক। হসপিটালিটি ও ট্যুরিজম বিভাগে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন শেষে বর্তমানে কর্মরত আছেন সুইস সরকারের গণপরিবহন বিভাগে।

বই প্রসঙ্গে

প্রথম ফ্ল্যাপে বই পরিচিতি প্রসঙ্গে লেখক জানান, ' ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে- Truth is, what you can handle, সত্য তাই, যা তুমি সামলাতে পারবে। সমাজ, রাষ্ট্র, মিডিয়া সবাই মিলে সত্যের একটা গড়াপেটা রূপ মানুষের সামনে রাখতে ব্যস্ত, যেটুকু সত্য মানুষ সামলাতে পারবে। কিন্তু মানুষের সামলানোর ক্ষমতার বাইরে মূলরূপে সত্য আসলে কি? কদলিপ্রস্ত আমাদের দৃশ্যমান লোকালয়ের ভিতরেই একটা অজ্ঞাত স্থান, তবে অপরিচিত নয়। পাঠক ধীরে ধীরে আবিষ্কার করবে, স্থানটা আর কিছু নয়, সমাজ বা রাষ্ট্র চোখরাঙানি দিয়ে যে সত্যকে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখে, সে সত্যগুলোই জমা হয় কদলিপ্রস্তে গিয়ে'।

ফ্ল্যাপে বই পরিচিতি পড়ে পাঠক অহরহ বিভ্রান্তই হয়ে থাকেন, কেননা ফ্ল্যাপের সংক্ষিপ্ত স্থানে বইয়ের বিস্তারিত বিবরণ সংকুলান করা যায় না। সুতরাং ফ্ল্যাপের চটকদার বিজ্ঞাপন আপাতত একপাশে সরিয়ে রেখে পাঠে মনোযোগ দিলে পাঠক কাহিনীর ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে ভিন্ন এক জগৎ আবিষ্কার করেন। উপন্যাসের কাহিনীটি সাদামাটাই বলা চলে। আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া, আগ্রাসী ও লোভী রাজনীতির বহুল চর্চিত ঘটনাই এখানেও দেখা যায়। কাহিনী আবর্তিত হয় তৌসিফকে ঘিরে। তৌসিফ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একজন উঠতি নেতা, সরকারের একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসীন, ওদিকে আবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সে ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতা আর নীতিবোধের স্বপ্নবাজী ঝোলায় ভরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার দল বা সরকারের নীতিবোধের মেরুদন্ডটা তৌসিফের মত এতটা শক্ত নয়। দল সরকারে থেকেও যদি নেতা-কর্মীরা একটু এদিক ওদিক থেকে দু-চার হাজার কোটি কামিয়ে নিতে না পারে তবে আর রাজনীতি করা কেন? দলের এই লালসার লকলকে জিভটাকে শান্ত করতে এক ব্যবসায়ী এসে হাজির হয় এক ভয়ানক 'গাধা উন্নয়ন প্রকল্প' নিয়ে - গাধার কৃত্রিম প্রজননের খামার। ভয়ানক এজন্য যে, এই প্রকল্পের ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর পড়বে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব। এখানেই আসে রাষ্ট্র ও সমাজ দ্বারা সত্য গোপন করা, গড়াপেটা করা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষকে সত্য আদৌ জানতে না দেয়ার প্রসঙ্গ। শুরু হয় তৌসিফের নীতিবোধের সাথে তার দলের চাওয়া-পাওয়ার সংঘাতের। তৌসিফ বাধ্য হয় তার নীতির সাথে আপসের, দলের প্রয়োজনকে সামনে রেখে সে বিসর্জন দেয় আদর্শকে।

সত্য গোপন করে ও মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভয়ানক গাধা উন্নয়ন প্রকল্পকে ন্যায্যতার চেহারা দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় খামারের জন্য জায়গা খুঁজতে গিয়ে। সরকারের নজর পড়ে 'কদলিপ্রস্ত'র ওপর। কদলিপ্রস্ত হল শহরতলিতে অবস্থিত একটি লোকালয়, ওখানে বাস করে সমাজবহির্ভূত, দুর্ধর্ষ অপরাধী কিছু মানুষ। সমাজ হয়তো ওদেরকে মানুষ হিসেবেই মানে না, হয়তো আধা মানুষ, অপূর্ণ মানুষ। এই ঊনমানুষগুলোকে হটিয়ে, কুচলে, পিষে, মেরে, কেটে, পুড়িয়ে কদলিপ্রস্ত দখল করা তো রাষ্ট্রের জন্য বাঁ হাতের খেলা। কিন্তু আসলে কি তাই? কার্যত কদলিপ্রস্ত দখল করতে গিয়ে দেখা যায়, কাজটা এত সহজ নয়। কদলিপ্রস্তের আপাত দুর্ধর্ষ, সমাজবহির্ভুত মানুষগুলোর কাছে আছে এক অসীম ক্ষমতাধর জিনিস, রাষ্ট্রের যা নেই - সত্য বলার মত লৌহদৃঢ় মেরুদন্ড। রাষ্ট্রের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার মত কদলিপ্রস্তের এত সাহস কি আমাদের গল্পের নায়ক তৌসিফকে কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করবে? সে কি পারবে তার হারানো নেতিবোধের ঝোলাটা পুনরোদ্ধার করতে? পারবে কি সে তার বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ডটা সোজা করতে?

সিনেমার গল্পে ক্লাইমেক্স দেয়ার জন্য উপন্যাসের এই মোড়টা হয়তো খুব কার্যকরী হতো, তৌসিফ প্রতিবাদী হয়ে উঠতো, সে কদলিপ্রস্তের হয়ে লড়াই করতো, তাদেরকে ন্যায় পাইয়ে দিত, অতঃপর সকলে সুখে-শান্তিতে বাস করত। কিন্তু লেখক তার পাঠককে এতো সহজ হেপি এন্ডিঙের অভিজ্ঞতা দেন না। লেখক গল্পকে টেনে নিয়ে যান আরও সামনে, যেখানে ক্লাইমেক্স হয় তবে এন্ডিংটা হেপি হয় না। রাষ্ট্র এক সময়ে কদলিপ্রস্ত গুড়িয়ে দেয়, সেখানকার অদিবাসীদেরকে কুচলে পিষে মেরে ফেলে। গাধা উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়ে যায়। খামারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের হাইব্রীড গাধা জন্ম দেয়া হয়। এই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মপরিচয় হারানো তৌসিফ ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায়। এত কিছুর পরও রাষ্ট্র স্বস্তির নিঃশাস ফেলতে পারে না। সত্যকে ম্যানিপুলেট করা যায়, দাবানোও যায়, কদলিপ্রস্ত গুড়িয়ে দেয়া যায়, কিন্তু এগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও গিয়ে জমা হতে থাকে। সত্য জানার তৃষা ও জানতে না পাওয়ার ক্ষোভ এক সময়ে মানুষকে দ্রোহী করে তোলে।

পুরো বই পড়া শেষ করে তবে গিয়ে পাঠক আবিষ্কার করে, ফ্ল্যাপে লেখক নিতান্ত মিথ্যা বর্ণনা দেননি। কদলিপ্রস্ত নামের আড়ালে একটা সামাজিক-রাজনৈতিক স্যাটায়ারের মাধ্যমে, একটু হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে লেখক আসলে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা বড় সংকটের দিকে আঙুল নির্দেশ করেন, মানুষকে আরেকটু রাজনীতি ও সমাজ সচেতন হওয়ার জ্ঞান দিয়ে যান।

 

বইয়ের নাম - কদলিপ্রস্ত

ধরণ - ব্যঙ্গধর্মী রাজনৈতিক উপন্যাস

লেখক - মামুনুল দীন

প্রকাশক - নাগরী, সিলেট

প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পৃষ্ঠাসংখ্যা - ৩৮৪

রিফাত

×