
চন্দন মিত্রের সাথে আমার আজ পরিচয় হলো কলেজে। চন্দন মিত্রের স্ত্রী সুবর্নার সাথে আমার প্রেম ছিলো।
প্রেম ঠিক না মানে ভালোবাসা বাসি ছিলো। বিয়েও হতে পারতো। কিন্তু সুবর্না আমাকে বিয়ে করতে চাইলেও তার পরিবার আমাকে মেনে নেয়নি। দোষ আমার একটাই তার চেয়ে আমি লম্বায় খাটো। আমি নাকি হাবাগোবা টাইপের।
আমার সাথে ভালোবাসা করা যায় কিন্তু বিয়ে না। এমন কথাই বলতো তারা।
কিন্তু চন্দন মিত্রযে আমার চেয়েও খাটো। গোফওয়ালা- ভুড়িওয়ালা মিত্রকে দেখে সুবর্নাকে মারতে ইচ্ছে হলো।
সামনে পেলে হয়তো ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতাম। আজ থেকে হয়তো চন্দন মিত্রের খোজ খবর নেয়া শুরু করবো।
দোতালার টিনসেডে মিত্র মশাইকে নিয়ে বসলাম। ক্যাম্পাসের ভেতর এই জায়গাটা একদম নিরিবিলি। স্টুডেন্টদের কোন কোলাহল নেই এখানে। এই জায়গাটা নিরিবিলি হবার পেছনে যে কারন তা হলো এখানে একজোড়া মানুষ আত্মহত্যা করেছিলো।
ভালোবাসর দাম দিতে হয়েছিলো দুজনকে। সে ভয়ে এখানে কেউ আসে না। কিন্তু এই জায়গাটা আমার ভীষন প্রিয়। মাঝে মাঝে সন্ধার বেশ পরে এখানে আমি একা একা আসি। যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন দারোয়ানকে বলি গেট খুলে দিতে তখন আমি ওখানে বেশ কিছু সময় থাকি। দারোয়ান বেচারা বুঝতে পারে কবে আমার মন খারাপ।
ওরা যে ফ্যানটার নিচে ঝুলেছিলো ঠিক তার নিচে আমি বসি।
বসার আগে লাইটটা অফ করে দেই। তারপর চোখ বন্ধ করে সুবর্নাকে ভাবি। তখন টিনের চালে কত শব্দ হয়, গায়ের ওপর অন্ধকারে টিকটিকি, পোকামাকড় পড়ে। ছোট ছোট হাসির শব্দ পাই। কে যেনো ফিসফিস করে।
এগুলো শুনে আমার কোন ভয় হয় না। কিছু সময় উপরে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
এইতো সেদিন রাতে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। একটা কালো বিড়াল আমার সামনে এসে কথা বলতে শুরু করলো। আচ্ছা কান্ডটা না হয় পরে বলছি।
চন্দন মিত্রকে ঠিক সেখানে নিয়ে এসেছি। একটি মাত্র চেয়ার। তাকে সেখানে বসালাম। আমি বসলাম সামনের টেবিলটাতে।
আচ্ছা দাদা বলুন আমার কাছে কীইবা দরকার? গোপন কি কথা বলার জন্য এতোদূর থেকে ছুটে এসেছেন।
চন্দন মিত্র চুপ হয়ে রইলেন। কিছুই বলছেন না। এই শীতে আমি ঘামছি। কেন ঘামছি তা জানি না।
চন্দন মিত্র বসা থেকে হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লো। দাড়িয়ে কেঁদে ফেললো। আমি কিছুই বুঝে ওঠার আগেই সে হাুউমাউ করে কেঁদে ফেললো।
এবার একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হলো আমাকে
আচ্ছা দাদা কি হয়েছে বলুনতো!
চন্দন মিত্র আস্তে আস্তে কান্না থামালো। আমি তাকে ধরে চেয়ারে বসালাম।
মিত্র বাবু বলেনতো কি হয়েছে!
এবার কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
ঃ সুবর্না মারা যাবার আগে আপনাকে একটা জিনিস পৌছে দিতে বলেছে। তাই আসা।
আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। সুবর্ণা মারা গেছে!
একথা শুনতেই আমার হাত পা অবশ হয়ে এলো।
তারপরও কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেস্টায় বললাম,
ঃ কি করে মারা গেলো?
চন্দন মিত্র বললো,
ঃ বাচ্চা হবার সময় মারা গেছে। বাচ্চাটা বেঁচে আছে।
হোচট খেলাম। বাচ্চাটার মুখটা ভাসাতে চেস্টা করলাম। কিন্তু আমিতো কখনও দেখিনি।
আচ্ছা ও কি দেখতে সুবর্নার মতো হয়েছে নাকি চন্দন মিত্রের মতো।
আমি ভাবনাটা থামালাম। থামিয়ে বললাম,
ঃ কী এমন জিনিস আপনাকে দিতে বলে গেছে সুবর্না!
আর আমাকেই কেনো?
চন্দন মিত্র আমার দিকে করুন ভাবে তাকাতে তাকাতে বললেন, আপনি না করবেন না প্লিজ। জিনিসটা আপনি রাখেন। তানা হলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না। সুবর্ণা আপনাকে খুব ভালোবাসতো।
এই ভালোবাসা শোনার পর আবার হোচট খেলাম। আমাকে ভালোবাসতো চন্দন মিত্রের কাছে বলেছে!
অদ্ভুত কথা!
চন্দন মিত্র পকেট থেকে কী যেনো একটা বের করতে যাবে এমন সময় দারোযান ছুটতে ছুটতে এসে বললো,
ঃ স্যার তাড়াতাড়ি বের হন। ওদিকে আগুন লাগছে।
আমি আর চন্দন মিত্র দৌড়ে বের হতে থাকলাম
ততক্ষনে চারিদিকে আগুন আগুন শব্দের চিৎকারে যে যার মতো দৌড়ে নেভানোর চেস্টা করছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে দূরে।
কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রনে চলে এলো।
এদিকে চন্দন মিত্রকে আমি হারিয়ে ফেললাম। শত শত লোকের ভেতরে তাকে কোথায় খুঁজে পাই! ধ্যাৎ আগুন লাগার আর সময় পেলোনা।
আস্তে আস্তে লোকজন কমতে শুরু করছে। আমি চন্দন মিত্রকে খুঁজে পেলাম না। তার জন্য অনেকক্ষণ অপোক্ষা করতে করতে একসময় বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
মন খারাপ নিয়ে বাড়ি পৌছলাম। কলেজ থেকে বাড়ি আসতে পাচমিনিটের বেশী লাগে না। তিন্তু আজ মনে হলো আমার কাছে কয়েকঘন্টা লাগলো।
রাতে ঠিকমতো ঘুম আসছেনা। কী এমন জিনিস সুবর্না চন্দন মিত্রকে দিতে বলেছে! খুব অস্বাভাবিকভাবে রাত কাটছে আমার।
সুবর্নাকে একশ একটা চিঠি লিখেছিলাম।। তাহলে কি সেই চিঠিগুলো!
এইতো এগুলা ছাড়া আর কি!
সারারাত প্রায় নির্ঘুমই কাটাতে হলো। ভোর হবার পর মনটা আরও খারাপ হতে শুরু করেছে। এমন কস্ট আমার বহুদিন লাগেনা। সুবর্না বিশ্বাসঘাতকতা করে ভালো থাকবার কথা না কিন্তু মারা গেছে মনে করতেই বুকের ভেতর খচ করে ওঠলো।
সুবর্না মরে গেলো। হ্যা সুবর্না তুমিতো মরে গিয়ে বেঁচে গেছো। আর আমি কেমন আছি তা তুমি জানলেনা।
কলেজ গেটে ঢুকতেই চন্দন মিত্রের সাথে দেখা। আমার রাগ হলো দেখে আবার প্রচন্ড খুশীও হলাম।
চন্দন মিত্র কাছে এগিযে এসে বললো, দাদা কাল আপনাকে পরে খুঁজে না পেয়ে আত্মীয়র বাসায় চলে গিযেছিলাম।
আচ্ছা আপনি কি বেয়াক্কেল কেছেমের একজন। আমাকেতো বলে যাবেন।
আচ্ছা শুনুন আমার ক্লাস আছে এখন। আপনি ঠিক বারোটায় কালকের সেই জাযগাটায় চলে আসবেন।
চন্দনমিত্র মাথা নেড়ে চলে গেনো।
বারোটার কিছুটা পরে আমি সেই দোতালার টিনসেডে যেতেই দেখি চন্দন মিত্র নেই। তবে টেবিলের ওপর একটা চিঠি আর একটা প্যাকেট। চিঠিতে লেখা
দাদা সুবর্না এই প্যাকেটটা আপনাকে দিতে বলেছে। পারলে ওকে ক্ষমা করবেন।
প্যাকেট খুলতেই দেখি সিদূরের কৌটা। হোচট খেলাম।
অনেকদিন আগের কথা। যখন সুবর্নার সাথে আমার ভালোবাসাবাসি ছিলো তখন দুজনে মার্কেট থেকে একসাথে সিদূরের কৌটাটা কিনেছিলাম।
কিন্তু আমার সিদুর সুবর্ণার কপালে ওঠেনি। কথা ছিলো এই সিদুর দিযেই বিয়েটা করবো।
এতোবছর পর সেই সিদুরের কৌটাটা হাতে নিতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল সিদুরের উপর পড়ছে। আর তখন সিদুরের রংটা আরো লাল হয়ে হৃদয় পোড়াচ্ছে।
ততক্ষনে ছুটির ঘন্টা বেজে চলেছে। আমি ছুটির ঘন্টা শুনছি আর ঠায় হযে দাড়িয়ে উপরে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছি। যে ফ্যানটায় ঝুলেছিলো একজোড়া ভালোবাসা।
মাহবুব হাসান বাবর
আবৃত্তিকার -উপস্থাপক- গল্পকার
ও
বিভাগীয় প্রধান
সরকারি মুকসুদপুর কলেজ
মুকসুদপুর গোপালগঞ্জ
রাজু