ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রেক্ষিত গফরগাঁও

সোহেল মাজহার

প্রকাশিত: ২২:১১, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রেক্ষিত গফরগাঁও

মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন

একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচার নির্যাতন করা। সাধারণভাবে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী প্রচারণা চালায় বাঙালি মুসলমান নয়। তারা হিন্দু বংশোদ্ভূত ও হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমান। আর বাঙালি সংস্কৃতি বলতে যা বুঝানো হচ্ছে, তা মূলত হিন্দু সংস্কৃতি। তারা ভারতের দালাল। মূলত ভারতের ষড়যন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীই পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে।

একটি পর্যায়ে তাদের এই প্রচারণা পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কিছু কিছু বিশ্বাসও করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এই প্রচারণাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী একটি সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁরা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিশেষ করে হিন্দুদের ভূমি, জমি-জিরাত, বাড়িঘর, স্থাপনা দখল করা, নগদ ধনসম্পদ, টাকা-পয়সা, সোনাদানা লুট করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।

এই ষড়যন্ত্রকে বাস্তবে রূপদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এমনকি নেহাৎ নিরীহ হিন্দুদের ধরে নিয়ে যেত। তাদেরকে বাড়িঘড় থেকে উচ্ছেদ করা, হত্যা-নির্যাতন এবং ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে। ঘটনা প্রায়শ নির্মমতা ও পৈশাচিকতার সকল সীমা অতিক্রম করে যেত, যা শুনলে এখনো শরীরের রোম খাড়া হয়ে যায়। এখানে একটি কথা বলা দরকার, এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড যারা করেছে, তাদের অনেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শিক চেতনা থেকে করেছে।

আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দখল ও ভোগের উদ্দেশ্য নিয়েই সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণযজ্ঞে মেতে ওঠে। এমনকি এই শ্রেণি মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্বে কোথাও কোথাও পাকিস্তানের সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত নিরীহ বিহারি জনগোষ্ঠীর উপর হত্যা ও নির্যাতনযজ্ঞ চালায়। মার্চের ময়মনসিংহে এ রকম একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী ময়মনসিংহ শম্ভুগঞ্জ রেলব্রিজে বোমাবর্ষণ করে।

পরদিন ১৮ এপ্রিল শহরের কিছু দুষ্কৃতকারী শহরের পাটগুদাম, রেলওয়ে কলোনি ও রামকৃষ্ণ মিশন রোডে বিহারি কলোনির উপর হামলা চালিয়ে শতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। দুষ্কৃতকারীগণ এদিন জেলখানা সংলগ্ন আগাখানের লোকজনের উপরও হামলা চালায়। অবশ্য রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ঘটনা দমন করে শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।

২৩ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী ময়মনসিংহ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো যে সকল দুষ্কৃতকারী অবাঙালিদের হত্যা করেছিল, তাদের অধিকাংশই পরে আবার রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। 
সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় কমবেশি সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পরিশরে সামগ্রিক আলোচনা করা অসম্ভব। এখানে শুধু ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও ও পাগলা অঞ্চলের কয়েকটি ঘটনার উপর আলোকপাত করা হলো। 
উত্তর গফরগাঁও এ সর্বপ্রথম সংখ্যালঘু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রসুলপুর ইউনিয়নের আমলিতলা গ্রামে। এদিন রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনী যৌথভাবে স্থানীয় নিশিবাবুর বাড়িতে হামলা করে। ঘাতকের দল নিশী ধর, রঞ্জন ধর, শিশির রঞ্জন ধর, হরিবল চন্দ্র দে রতন কুমার রায়, সন্দোষদেবসহ ৯ জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।

আবার পাকিস্তান বাহিনী নিগুয়ারী ছুতার বাড়ির সুরেশ চন্দ্র বর্মণকে হত্যা করে। একই পরিবারের যোগেশ চন্দ্র বর্মণ ও পরেশ চন্দ্র বর্মণকে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানায়। নিগুয়ারী চামর্থা গ্রামে রবীন্দ্র চরণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে পাকিস্তান বাহিনী তার পিতা রামচরণ ও পিতৃব্য গোপাল চরণসহ পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করে এবং তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করে। 
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি ছিল গফরগাঁওয়ের প্রসাদপুর গ্রামে। রমজানে মাসে পাকিস্তান বাহিনীর আকস্মিক হামলায় এই ঘাঁটির পতন ঘটে এবং মুক্তিবাহিনী নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়। এদিন পাকিস্তান বাহিনী এখানে গণহত্যা চালায়। সেদিন নিহত হয় রমণী চন্দ্র সাহা, সুজিত চন্দ্র সাহা, হীরেন্দ্র চন্দ্র সাহা অমর চন্দ্র পাল, লক্ষ্মী বাবু, মন্টু আচার্য, টুনু আচার্য, হেমেন্দ্র চন্দ্র আচার্য, অশ্রমাঝি, প্রভা সাহা ও হযরত আলী। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হেলালও এদিন শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তার পরপরই বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস, পণ্ডিত রাসবিহারী মিশ্র ও বাবু শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ বেশ কয়েকজন হিন্দু-মুসলিম শিক্ষক ও শিক্ষিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। তারা মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। 
বলে রাখা দরকার ভারইল গ্রামের আবদুল মজিদ মোড়ল ও ছুনু মোড়লের সঙ্গে বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস পরিবারের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। আবার ভৌমিক পরিবারের সঙ্গে পুখুরিয়ার মীর আব্দুস সাত্তার গং এর জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। সংখ্যালঘু পরিবারগুলো মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করায় মজিদ মোড়ল, ছুনু মোড়ল ও মীর আব্দুস সাত্তার গং মুক্তিযুদ্ধকে উপলক্ষ করে তাদের জমি ও বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাবলিক লাইসেন্স অথরিটি কর্মকর্তা অর্থাৎ পিএলএ। তার ভাই যুধিষ্ঠির চন্দ্র ছিলেন কৃষক। বীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের দুই ছেলে নরেন্দ্র নারায়ণ দাস ও সুবোধ রঞ্জন দাস কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উচ্চমান সহকারী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। 
আনুমানিক ৭ ভাদ্র পুখুরিয়া গ্রাম নিবাসী মীর মহর উদ্দিনের ছেলে রাজাকার আব্দুল করিমের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী বীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায়। পরদিন সকাল বেলা বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস দুই ছেলে নারায়ণ চন্দ্র দাস, সুবোধ রঞ্জন দাস, মেয়ে মায়ারানী দাসসহ পরিবারের সকল সদস্যদের ত্রিশালের ধানীখোলার ভাটিদাসপাড়ায় নিকটাত্মীয় অবনী মোহন মহাপাত্রের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বাড়িতে অবস্থান করেন শুধু বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস ও তার স্ত্রী রেণুবালা দাস। 
একই দিন বিকেল বেলায় আব্দুল করিমের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়িতে আক্রমণ করে। বাড়ি থেকে বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস, রেণুবালা দাস ও প্রতিবেশী অম্বিকাচরণ দাসকে গ্রেপ্তার করে। তাদেরকে স্থানীয় পুতু ঠাকুরের বাড়ি সংলগ্ন মঠ- শ্মশানের কাছে নিয়ে যায় এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

একইদিন পাকিস্তান বাহিনী গ্রাম থেকে চিত্তরঞ্জন দাস, পণ্ডিত রাসবিহারী মিশ্র, নগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, আবু দাস, পরমেশ ভৌমিক, মন্টু ভৌমিক, বুধু ভৌমিক, সত্যেন চন্দ্র দাস, বীরেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক, জ্যোর্তিময় ভৌমিক, জ্ঞান প্রসন্ন চাকলাদার, বিমল চন্দ্র দাস ও মৃণাল কান্তি দেবনাথকে ধরে নিয়ে যায়। তন্মধ্যে মৃণাল কান্তি দেবনাথকে গফরগাঁও থানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান বাহিনী তাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। অন্য সবাইকে গফরগাঁও লঞ্চঘাটের বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়।

একে একে সবাইকে লাইন ধরে গুলি করে পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদীতে ফেলে দেয়। কিছুটা সৌভাগ্য ও কিছুটা বুদ্ধির জোরে বিমল চন্দ্র দাস গুলির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভান ধরে নদীতে ঝাঁপ দেয়। রাত অন্ধকার হওয়ায় বিষয়টি ঘাতক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যায়। সে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে পানির ওপর থেকে ভেসে ওঠে। তারপর নদীর অনুকূল ¯্রােতে আনুমানিক ১০ কিলোমিটর দূরত্বে চর আলগী ইউনিয়নের এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারা তাকে সেবা শুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তুললে সে প্রাণে বেঁচে যায়।

এদিকে বীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়িতে হামলার খবর ও গুলির শব্দ শুনে প্রতিবেশী বাবু শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। তিনি ছিলেন গফরগাঁও ইসলামিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক ও সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। নিহত পরিবারের অভিযোগ এদিনের ঘটনার পেছনে আবদুল মজিদ মোড়ল ও ছুনু মোড়লের ইন্ধন ছিল। 

৮ ভাদ্রের দুই সপ্তাহ পর গণ্ডগ্রামের সংখ্যালঘু বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও নুশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভূতি চন্দ্র দাস বাদী হয়ে গফরগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে পুলিশ দুইবার চার্জশিট দেয়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বাদী বিভূতি চন্দ্র দাস কিছুটা হতাশ হন। তিনি বিভূতি চন্দ্র দাস পরবর্তীতে আর মামলার কোনো তদবির করেননি।
৮ ভাদ্রের দুই সপ্তাহ পর হানাদার বাহিনীর সহায়তায় গণ্ডগ্রামের পার্শ্ববর্তী মোক্তাপাড়া গ্রামের সকল সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘরে লুটপাট চালায় ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও একটি মহল তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। একাত্তর ও পরবর্তী সময়, কোনো ঘটনার কোনো বিচার না হওয়ায় ৭২ থেকে ৮৩ সালের মধ্যে মোক্তাপাড়া গ্রামের সকল পরিবার দেশান্তরি হয় এবং গ্রামটি সংখ্যালঘুশূন্য হয়। 
এবার একটু অন্যরকম গল্প শোনাতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এপ্রিল মাসে চাকুয়া গ্রামের চিত্ত দেবনাথ মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে মেঘালয়ের তুড়া জেলার ঢালু চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি যখন ঢালুতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং গ্রহণ করছিলেন, তখন তার বাবা যতীন্দ্র দেবনাথ মা তরুবালা দেবনাথসহ পরিবারের নিত্যরঞ্জন দেবনাথ, গোপাল চন্দ্র দেবনাথ, দুঃখু দেবনাথ, নিশীরানী দেবনাথ ও সচিরানী দেবনাথ দুষ্কৃতকারীদের হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

মুক্তিযোদ্ধা চিত্তরঞ্জন দেবনাথ এই ঘটনার জন্য যে দুইজনকে অভিযুক্ত করেছেন, তাদের একজন স্থানীয় মহিমা প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রধান হিসাবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আরেকজন ঘটনার কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধে যান। চিত্ত দেবনাথের ভাষ্য ভূমি ও নারী লোভই ছিল দুষ্কৃতকারীদের মূল লক্ষ্য।

×