
সুপারী পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ব্যালকনিতে
সুপারী পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ব্যালকনিতে। কিছু কিছু মেঘও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আকাশের গায়ে। তাতে ক্ষণে ক্ষণে মেঘের ঘোমটায় মুখ ঢাকছে চাঁদ আবার কখনোবা ঘোমটা সরিয়ে আলোর হাসি ছড়াচ্ছে চাঁদ। ঐশী এসে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। ওর মুখেও আধো আলো আধো ছায়া খেলে যাচ্ছে। ওর চোখে কি পানির বিন্দু চিক চিক করছে? কি জন্য এই কান্না? ঐশীর একটি মাত্র ভাই ইমন কাল বিদেশ চলে যাচ্ছে তাই কি তার চোখে কান্না উথলে উঠছে? নাকি মায়ের ছবি দেখে মায়ের প্রতি করা অবহেলার কথা ভেবে ঐশীর চোখ ভিজে উঠছে? খালার প্রতি অহেতুক কঠিন ব্যবহার করার জন্য অনুশোচনার কান্নাও হতে পারে হয়তো।
কে জানে হয়তো সবকিছুই ওকে এই মুহূর্তে কান্নাকাতর করে তুলেছে। কখনো সখনো মানুষের কোনো আচরণ বা অনুভূতির প্রকাশ অন্যের কাছে রহস্যময় বা বোধগম্য নাও হতে পারে। কখনো নিজের কাছেও তা অবোধ্য থেকে যেতে পারে। কোনো বেদনায় হৃদয় উথালপাথাল হয় তা ব্যক্তিমানুষটি নিজেও বুঝে উঠতে পারে না সময়ে সময়ে। তবে কবি সেটা বুঝেছিলেন তাই তো বলেছেন ‘কেন অকারণ বেদনা ঘৃনায়’ তার মানে অকারণে বেদনা ঘনাতেও পারে। তবে এই মুহূর্তে ঐশীকে ঘিরে যে দুঃখ ঘনিয়ে এসেছে তা অকারণে নয়।
ইমন যখন ছবিটা ওর হাতে দিতে দিতে বললো
‘বুবু, ছবিটা স্যুটকেসে দিয়ে দিও। আমি এর কপি তৈরি করে তোমাকে পাঠাবো কেমন।’
ইমনকে বিদায় জানাতে আসা ওদের খালা আগ্রহে হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিয়ে বললো
‘দেখি কার ছবি’
ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ইমন বললো
‘খালা, ছবিতে আমি আর মা রয়েছি’
মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে খালা বললো
‘শোন্ ঐশী ইমনের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। ছবিতে তোর মায়ের সঙ্গে রয়েছিস তুই আর সে বলে কিনা মায়ের সাথে সে মানে ইমন’ খালার হাত থেকে ছবিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে দরজার দিকে চকিতে তাকিয়ে ঐশী রুক্ষ গলায় বললো।
‘না খালা, ইমন জানে সে আর মা রয়েছে ওই ছবিতে। শোন খালা আমাদের মা, আমাদের ছোটবেলা তার কোন স্মৃতি আছে তোমাদের কাছে? নাই। ঠিকতো।
কথাগুলো বলতে বলতে তড়িঘড়ি ছবিটা ইমনের স্যুটকেসে ঢুকিয়ে ফেলল যাতে আবার কেউ এই ছবির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মেতে না উঠে। তারপর গম্ভীর মুখে সে সংসারের অন্যান্য কাজ করতে থাকলো। এদিকে ঐশী-ইমনের খালা বহুদূর থেকে মা মরা বাচ্চাদের আদরের টানেই বিকালে এসে পৌঁছেছেন। এসে কিনা এমন ব্যবহার! ইমন স্কলারশীপ নিয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশ। কবে ফিরবে কে জানে। আর কোনোদিন বোনের ছেলেটিকে দেখতে পাবে কিনা তাও অনিশ্চিত।
খালাও মনমরা হয়ে বসার ঘরে টিভির সামনে চুপচাপ বসে রইলেন। টিভি চলছিল। তবে খালা আনমনে স্মৃতির দরজা খুলে সে রাজ্যে ঢুকে পড়লেন। কেউ দেখলে ভাববে উনি টিভি দেখছেন।
মনে হচ্ছে সেদিনের কথা। তবে এর মাঝে বাইশ বছর কেটে গেছে। ইমনের জন্মের সময়ে ঐশীর বয়স পাঁচ কি ছয় বোধ হয়। ওদের বাবা অল্প কিছুদিন আগে চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। ওরা নানা বাড়িতে ছিল। কথা ছিল বাচ্চা (ইমন) হওয়ার পর সাকেরা’বু দুই বাচ্চাসহ স্বামীর কাছে যাবে। তারপর কি যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো ইমন জন্মের পর। মা ওদের মা দুর্বল হচ্ছিল আর দুর্বল হচ্ছিল। ছেলেকে কোলেও নিতে পারেনি বেচারী। ইমন জন্মের তেইশ দিন পর ওর মা মাথা ঘুরে পরে জ্ঞান হারালো। এ্যাম্বুলেন্সে করে ঐশী-ইমনের মা সাকেরা’বুকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। ওটা ছিল ওর শেষ যাত্রা।
মরদেহ বা লাশ বাড়িতে আনা হয়নি আর। হাসপাতাল থেকেই মসজিদ হয়ে তাকে গোরস্তানে দাফন কাফন করা হয়। ঐশী ঠিকই বলেছে কি দুঃখজনক উদাসীনতা ছিল ওদের মায়ের প্রতি তা স্বীকার করতেই হবে।
বাড়িতে তখন বড়ভাইয়ের বউ গর্ভবতী, বয়স্ক মা প্রায় অসুস্থ। ঐশী-ইমন ছোট্ট। তাদের ঝামেলা। নিরীহ মা তবু মৃদু স্বরে লাশ বাড়িতে আনার কথা বলেছিলেন। তার সন্তানকে উনি নিজে একবার দেখতে চান তাও বলেননি। শুধু বলেছিলেন ঐশীকে একবার দেখানো গেলে ভালো হতো। ঐশীর মামারা বোনের মৃত্যুতে যথেষ্ট দুঃখিত হয়েছিলেন তবু বাস্তবতার কথা তুলে তারা ঐশী-ইমনের মায়ের মরদেহ বা লাশ বাড়িতে না আনার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে আসে। পৌঁছেই শোনে দাফনের জন্য লাশ এরমাঝেই গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে তক্ষুণি ঐশীকে কোলে নিয়ে গোরস্তানের দিকে ছুটলো। মফস্বল এলাকায় মেয়েদের জন্য গোরস্তানে প্রবেশ অনুমোদন পায় না। লাশ দেখা হয়নি। তবে অনেক কান্নাকাটি ও কাকুতি মিনতির পর ছোট্ট ঐশীকে নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পড়ার সামান্য সুযোগ পায়। পরদিন গিয়ে ছোট্ট এক শিউলি ফুলের চাড়া ঐশীর হাত দিয়েই কবরের শিয়রের কাছে পুঁতে দিয়ে এসেছিল।
শিউলির চারা লাগিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে বাহরাইন থেকে একজন অতিথি এসেছেন ক্যামেরা ও সামান্য উপহার নিয়ে। ঐশীর বাবা পাঠিয়েছেন। ক্যামেরা দিয়ে বাচ্চাদের ছবি তুলে পাঠাতে বলেছেন। ক্যামেরা দেখে ঐশীর মামী বলে উঠেছিলেন
‘আহারে বাচ্চাদের সাথে মায়ের কোনও ছবিও তোলার সময় সুযোগ হলো না।’
‘তোমাদের তো ক্যামেরা ছিল ভাবীর ছবিতো তুলে দিতে পারতে, তেইশ দিনেও একটা ছবি তোলা গেল না?’
কথাটা মনে আছে বলেই উনি বলেছেন যে মায়ের সঙ্গে ছবিতে ইমন নয় ঐশীই রয়েছে। তাতেই কিনা ঐশীর ক্ষ্যাপার মতো অদ্ভুত আচরণ। মা-হারা বাচ্চাদের মনে কি বোধ খেলা করে কে জানে?
তখন ভাবীর মুখে কোনো উত্তর ছিল না। চুপচাপ সব। সেই মুহূর্তে নীরবতা ভেঙ্গে ঐশীর নানি মানে যিনি তার মা বলেছিলেন ‘থাক ঐশীর সামনে ওইসব কথা তোলার দরকার নাই ও কষ্ট পাবে।’
বারান্দায় দাঁড়ানো ঐশীর মনে তাদের ছোটবেলা, তাদের ফেলে যাওয়া জীবনের ছবি ভেসে উঠছিলো। মায়ের মৃত্যুর পর ঐশী-ইমন বছর তিনেক নানী বাড়িতেই ছিল। মামা-মামি, নানির সঙ্গে কেটেছে সময়টা।
তিন বছর শেষে ঐশীর বাবা নতুন করে চাকরির চুক্তি নবায়ন করেননি। ফিরে এসে মিউনিসিপ্যালিটিতে তার আগের কাজে যোগ দেন। মামাবাড়ি ছাড়ার সময় ঐশীর আট বছর ও ইমনের তিন বছর। বাবা শহরের প্রান্তে বেশ আগে কেনা একখ- জমিতে ছিমছাম এক বাড়ি তৈরি করলেন। বাবা আর বিয়ে করেননি। ঐশীর নানি ও দাদি ওদের সঙ্গে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
নানি বাড়ি থাকার সময় মামির আচরণে আদর-অনাদর কোনোটাই তেমন মনে পড়ে না। হয়তো বা সে মনেও করতে চায় না। বড়কথা হলো ওর বাবা বলতেন যে মানুষের কাছ থেকে ভালো যেটুকু পেয়েছো তাই মনে রাখবে মন্দটুকু ভুলে যাবে তাতে কষ্ট পাবে না কখনো।
এই ছোটখালা প্রতি মাসে একবার অনেক কিছু মজার খাবার জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। নানিই ইমনকে ছোটবেলায় গোসল করাতেন। খালা যখন আসতেন তখন ঐশী-ইমন ও মামাতো ভাই আরমানকে গা-মাথা ঘসে গোসল করাতেন। নানির চুল ধুইয়ে, নখ কেটে ঝকঝকে করে দিতেন। একবার খালা এসে দেখলেন নানি জ্বরে ভুগে উঠেছেন মাত্র। ঐশী শুনেছিল খালা খুব দুঃখিত স্বরে মামিকে বলছেন ‘ভাবি মায়ের মাথাটা ধুয়ে দিতে পারতে, জ্বরের গন্ধ যেতো’ মামি কথাটি না বলে স্বভাবজাত নির্লিপ্ত উদাসীন চোখে তাকিয়েছিলেন। নানি জ্বরক্লান্ত নির্জীব গলায় বলেছিলেনÑ ‘থাক তুমিও যদি না ধুইয়ে দিতে আমি অখুশী বা ব্যাজার হতাম না, আমার আল্লাহ যেন ব্যাজার না হোন’ খালা আর্তনাদ করে বলেছিলেন ‘মা অমন কথা বলো না!’
খালা হাতে ঘসে গায়ে মাখার সাবানের ফেনা তুলে সে ফেনা চুলে মাখিয়ে যতেœ নানির চুল ধোয়ালো। তারপর গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে তোয়ালে চিপে নিয়ে গরম ভাপ ওঠা তোয়ালে দিয়ে নানির গা মুছিয়ে কাপড় পাল্টে দিল। ঘাম-জ্বরের গন্ধ উবে নানির চুল থেকে মজার সুবাস আসছিল। ঐশী নানির চুল নিয়ে খেলতে খেলতে জিজ্ঞেস করেছিলো
‘ব্যাজার মানে কি খালা?’
‘কারো মনে কষ্ট দিলে তার মন খারাপ বা ব্যাজার হয়। জানিস মন ব্যাজার হলে যে মন ব্যাজার বা মনে কষ্ট দেয় তার ক্ষতি হয়’।
তখন ঐশী কথাটার অর্থ বুঝেনি। আজ মামির প্রতি আরমানের বউয়ের অবহেলা ও অবজ্ঞা দেখে তার মাঝে মাঝে মনে হয় নানির প্রতি মামির অবহেলা ও অবজ্ঞা আজ শতগুণে ফিরে এসে মামিকে ঘিরে ধরেছে।
একবার মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে মামির সঙ্গে আরমানের অনেক ছবি দেখে ইমনের মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল। তারপর অদ্ভুত এক অচেনা গলায় জানতে চেয়েছিল
‘বুবু, মায়ের সঙ্গে আমার কোন ছবি নাই?’
ঐশীর মুখে কথা জোগালো না, চুপ করে রইলো সে।
পরে এই ছবিটা পেয়ে ঐশী ইমনকে বলেছিল এটা ইমন ও মায়ের ছবি। ছবিটা দেখে ইমন খুব খুশি হয়েছিল।
বাবা মায়ের সঙ্গে ঐশীর কিছু ছবি ছিল তবে মায়ের সঙ্গে ইমনের কোনো ছবি নাই ভাবলে ঐশীর কষ্ট বাড়ে।
ছবি নিয়ে ইমনকে মিথ্যে বলার কথা বাবাকে চুপি চুপি বলেছিলো ঐশী। মিথ্যা বলতে তার ভয়ও করেছে এটাও সে বাবাকে জানিয়েছিলো। বাবা বলেছিলো
‘যে মিথ্যা কারো ক্ষতি করে না সে মিথ্যাতে কোন দোষ নাই, তাতে তোর কোন সাজা হবে নারে মা’।
আজ এই সুন্দর মিথ্যা সরিয়ে সত্য বের হয়ে গেলে ইমন খুব কষ্ট পেতো। ইমনের কষ্ট ঐশীকেও কাঁদাতো।
খালার সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করে খারাপ লাগছে সত্যি। তবুও ঐশী ওই সুন্দর মিথ্যাটাকে বাঁচাতে চায়।
পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে আঁচ করে ঐশী। তার কাঁধে কারও আলতো হাতের ছোঁয়া। চোখের পানি মুছতে মুছতে ফিরে তাকায় ঐশী। ওর স্বামী ওর ঝরে পড়া চোখের পানির শেষ বিন্দু আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বললো
‘ছি কাঁদে না ঐশী তাতে ভাইয়ের অমঙ্গল হবে।’