কাঠ-কয়লার মানুষ
ধীরু ডোম গণতন্ত্র বোঝে না। শ্মশানে মানুষ চড়িয়ে হাড়ি ভরে চোলাই মদ খেতে খেতে চিৎকার করতে থাকে। ইয়ে জিন্দেগী বহুত সজবর হ্যায়। মুল্লুক ছোড়কে আয়া তো বহুত দিন এ মাটি হামার নেহি। জুম্মন ছাব মাটি চায়। লাছ ছায়। নেহি দুংগা——ঠার যাও- মধুমতির জলে এই কণ্ঠের অনুরণন তোলে। তার বাজখাই গলা জল তরঙ্গে ছড়িয়ে যায় বহুদূর । মানুষ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হলেও মধুমতির জলযানে যারা নতুন তারা শ্মশান ঘাট সম্বন্ধে একটা নতুন ধারণা নিয়ে যায়। শ্মশান ঘাট এক বৈচিত্রময় জায়গা। অজস্র কণ্ঠের কান্নার মধ্য দিয়ে এখানে লাশ আসে।
কাচার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নির্ধারিত ডোম। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্মশান সাজিয়ে খড়ি কাঠের আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে দেয়। এসব লাশ কান্না-মরা-বাঁচা তাদের স্পর্শ করে না। লাশ পোড়ানোর সঙ্গে পেটের সম্পর্ক। ডোমের সম্পর্ক দ-ের বাঁশ আর কাঠ-কয়লা। এছাড়া কোন জীবন নেই-কথা নেই। চাঁদে মানুষ গেল বা ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে- বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না। ডোমদের এসব মাথায় ঢোকে না। লাশ আসলে শ্মশান সাজিয়ে আগুন জে¦লে চোলাই খেয়ে দ-ের বাঁশের খোঁচায় লাশ পোড়ানোর কৌশল ছাড়া আর কিছু বোঝার নেই। অমাবশ্যার জমাট অন্ধকারে শ্মশানের আগুন বেশি তেজ নিয়ে জলে ছায়া ফেলে। দাউ দাউ করে জ¦লে ওঠা আগুন আর চিৎকার করে লোকজনের হরিবোল ধ্বনি যে কাউকে বেদনার্ত করে।
চিতার আগুন লেলিহান সাধ নিয়ে শত শত লকলকে জিভ বের করে উদ্বাহু নৃত্য করলে নদীর মধ্যে এক মাল্লাই নৌকার ভেতর থেকে লোকজন বিস্ময় ভরে দেখে। একটি মৃত মানুষকে কিভাবে পোড়ানো হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শ্মশানের দিকে ফিরে কায়মনচিত্তে নমস্কার করে আর অন্যরা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলে, এইটা কোন্্ ধর্ম? আস্ত মানুষটারে পোড়াইয়া ফেলানো কোন্ কাজের কাজ? এর উত্তর কেউ দেয় না। মধুমতির পাড় ঘেঁষেই লোহার চরগ্রাম। এখানে কবে শ্মশান ঘাট গড়ে উঠেছে তা কেউ জানে না। শ্মশান ঘাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ডোম পল্লী। ডোমদের কাজ মানুষ পোড়ানো। মৃতদেহ সৎকারের কায়িক কাজে এরা অভ্যস্ত কাজও করে ।
বর্ণপ্রথার কারণে ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবেই এরা চিহ্নিত। সারাদিন এরা লাশের অপেক্ষায় বসে থাকে। শ্মশানে লাশ নিয়েই এদের কাজ। পল্লীতে দল বেঁধে তারা বসত করে। এক সময পল্লী ছোট ছিল, এখন অনেক বড়। কিন্তু অন্যকোন কাজে এদের ঠাঁই নেই। লাশ আসলেই এদের রুটি-রুজি। এদের সমাজপ্রধান লাশ পোড়ানোর শিফট বেঁধে দেয়। তিনটা শ্মশানে চার শিফট বাঁধা। এক একটি শ্মশানে ২/৩ জন করে কাজ করে। শ্মশানের চার কোনে চারখানা শক্ত লোহার পাতের ভেতরে আমকাঠ দিয়ে ডোমরা এমনভাবে সাজায় কাঠের বিছানা, যার নিচে বাতাস প্রবাহের বন্দোবস্ত আছে। আত্মীয়স্বজন পাটখড়িতে আগুন জেলে চারদিক প্রদক্ষিণ করে হরিবোল ধ্বনির মধ্য দিয়ে কান্না শুরু হয়। এক সময় কান্না, আগুন সব নিভে আসে।
পরে জল ঢালা হয় শ্মশানে। কয়লায় পুড়ে যাওয়া শরীর ভেসে যায় নদীর জলে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন লাশ আসে। ডোমরা নেমে পড়ে মহারাজের (যমদেব) নামে প্রণাম করে, নেমে পরে ডোম পুরুষেরা। মহিলারা এস উলুধ্বনি দিয়ে শ্মশানে প্রণাম করে যায়, দ-ের বাঁশ হাতে দাঁড়ায় ডোম প্রধান। ইতোমধ্যে চলে আসে কারনের বোতল। নিজেদের তৈরি চোলাই খেয়ে পান মুখে দিয়ে কাজ শুরু করে সবাই। বার বার হরিধ্বনি চলে, চলে কান্নাকাটি। মদের নেশায় ঢুলু ঢুলু সুভাষ ডোম চোখ মুছতে মুছতে বলতে থাকে- বাবু মড়া পোড়াই,হামরা ছোট জাত।
দ্যাক বাবু হামাদের মুল্লুক ছিল। ছালা বিটিশ আমাদের আনধ্রা (অন্ধ্র প্রদেশ) থেকে অইনা এখান দিল ইখন হামরা কোথায় যাবো? জুম্মন মিয়া যাই বলুক হামরা যাবো না। কাঠ আর কয়লা ছেনে ছারাটা জীবন কয়লা হয়ে গেছে। বাবু হামিও কয়লায় মিছে যাবো বলে সুভাষ ডোম কাঁদতে থকে। এর মধ্যে রমেশ এসে বলে-দাদা, ডান দিকে খোঁচা মারো। আগুন জ¦লছে না।
সুভাষ ডোম এবার শ্মশানের কাজে মন দেয়। তিনটি শশ্মান জ¦লছে। এর আগে যেগুলো পোড়ানো হয়েছে তার কয়লা, ভাঙা হাড়ি দ-ের বাঁশ পড়ে আছে। কয়লার রং কি কালো। পোড়ার পর জল লেগে যেন রং খুলেছে। মধুমতির পাড়ে এই হরিজন মহল্লায় সারা রাত মানুষজন জেগে থাকে। আবার সকালে যখন ডাক পড়বে তখন উঠবে। ডোমপল্লীর কাচার বেড়ার ভেতরে ভগবান ঢুকতে না পারলেই ওদের পরম দেবতা মহারাজ (যমদেবতা) ওদের কখনো ছেড়ে যায় না। এখানে ঢুকতেই অভাবের ঘ্রাণ আসে। আসে কিছু চাপা কান্না। এখানে প্রতি বছর কালীপুজোর মতো কেউ না কেউ চলে যায়। কিন্তু সবই কাঠ-কয়লার ভিড়ে চাপা পড়ে যায়।
মিতালী শশ্মানে প্রণাম করতে করতে কাঁদে বাবু, এই যে বিষ (চোলাই মদের বোতল দেখায়) দেখিস ইহা খাইতে খাইতে হামরা কাঠ কয়লার সঙ্গে মিছে যাবে। সব বছর হামরা মরদ হারাই। কাজ পাই না। কয়লা বেচি দূরে যাই। হামরা কেমনে বাঁচবো? প্রণাম করে কেঁদে জ¦লন্ত শ্মশানের পাশে বসে থাকে। এখানে বিধাব বধূদের সবার ভিতরে অসংখ্য শ্মশান। ডোম পল্লীতে রাতে মন্দিরে গানের আসর বসে প্রত্যেক শনিবার। বাইরে থেকে লোকজন আসে, তারপর চোলাই খেয়ে এরা আনন্দ করে। তারপর সব ভুলে যায়। ডোম পল্লীতে অভাবের আগুন চিতার আগুনের মতো ধিকি ধিকি করে জ¦লে। মরদেহ পুড়িয়ে, ঠাকুর, সরকার, পাড়ার চাঁদা সব দিয়ে তেমন আর থাকে না। তারপর বাজারে দাম বাড়ছে। কিছু কেনার সাধ্য নেই। মাছ, মাংস প্রায় বন্ধ । শাক, এটা বাটা, ওটা বাটা দিয়ে পেট চালানো।
সংসার চালানো অনেক কষ্ট। এই কষ্টের মধ্যে চোলাই একমাত্র বন্ধু। এটা খেলে আর ক্ষুধা লাগে না বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ খেয়েছে, ওরাও খায় । ডোম পল্লীকে ওদের মহাদেবতা মহারাজ (যম) যেন খুব ভালোবাসে। নিরক্ষর মানুষেরা তাদের সন্তানদের অল্প বয়সেই কাজে দেয়, বিয়ে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই অসুখ দেখা দেয়। পেটের অসুখ, পরে রক্তবমি করে মারা যায়। ডাক্তার বলেছে, এটা নাকি লিভার সিরোসিস। এটা হলে মরতে হবে। গত মাসে সুমন রক্ত বমি করলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তার বলেছে, তাকে বাঁচানো যাবে না। লিভার শেষ। কিন্তু চোলাই না খেয়ে এরা কাজ করবে কিভাবে? মিলন ডাক্তারকে বলেই বসলো-
বাবু হামরা কি ছক করে এছব খাইগো। মরা আগুনে দিলে যে গন্ধ বেরায় সেময় চোলাই না খেলে কাজ করে কিভাবে? ডাক্তার চুপ থেকে বলে, তবু চোলাই ছাড়তে হবে।
খেয়ে এরা শেষ হয় দ্রুত। এইতো গত বছরের কথা ফেকু ডোম মারা গেল । তার বউয়ের ঘরে অভাব, অভাব প্রায় সব ঘরে। নির্বাচনের আগে ভোটের জন্য সবাই আসে। বলে যায়, এটা হবে ওটা হবে। কিচ্ছু হয় না। কিন্তু এবার অন্য ঘটনা ঘটেছে। ভাদ্রের অমাবশ্যার রাতে কালি পূজা করে সবাই যখন চোলাই খেতে ব্যস্ত, তখন আসলো জুম্মন মিয়া। ডোমপাড়া মৃণালের শোকে যখন কাঁদছিল তখন এলাকার মুরুব্বিদের নিয়ে জুম্মন মিয়া আসে। জুম্মণ মিয়াকে এলাকার সবাই জানে। এই এলাকার কমিশনার ছিলেন। জুম্মন মিয়া বারবার দল বদল করে প্রতাপের সঙ্গে আছে। তার বাহিনী আছে, বংশে লোকজন আছে, আছে অনেক লোক। যেকোন ফাঁকা এলাকা পাইলেই তিনি টাওয়ার বানিয়ে ফেলেন। জুম্মন মিয়া হাঁক দেয়- এই পাড়া কালকের মধ্যে খালি করে দিবি মাদারচোদের বাচ্চারা । এখানে শপিংমল হবে।
সুভাষ ডোম এগিয়ে যায়- বাবু হামরা তাহলে যাবো কুথায়? জুম্মন বলেন, তোরা শপিংমলে কাজ করবি- তোদের অসুখ-বিসুখ থাকবে না। তোরা ভালো থাকবি। সুভাষ ডোম বলে, না-না বাবু এ বড় অবিচার। এ মাইট আমার চার পুরুষের ভিটা। মাটি ছাড়লে বছুমতি হামাদর অভিছাপ দেবে।
ওই দিন থেকে মৃণাল ডোমকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ডোমরা থানায় গেল, কমিশনারের কাছে গেল, কত লোক ধরা ধরি করল মৃণালকে পাওয়াই যাচ্ছিল না। রাতে জুম্মন মিয়া আসে দলবল নিয়া। সুভাষ ডোম বলে- বাবু, হামার মিনাল হারাই গেছে’ বলে কাঁদতে থাকেন।
জুম্মন মিয়া বলেন, এমন মিনাল প্রতিদিন হারাইয়া শ্যাষ হইয়া যাবি। পাড়া ছাইড়া দে-। একটু পর মিনালের লাশ পাওয়া যায় ডোম পল্লীর ভিতরে। চারদিকে কান্না কাটি শুরু হয়। তাকে সৎকার করার কাজ চলতে থাকে। জুম্মন সবাইরে বুঝায়- মিনাল ছিল না, আইনা দিছি। জিন্দা না মুর্দা। আইনা দিছিতো। এবার বুঝ নে। এলাকা ছাড়বি কি না। শক্ত জারুলের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় মিলন ডোম- হ ছাব বুজ ফ্যালাইছি। হামরা রক্ত দিব মাগার পল্লী দিব না । অমাবশ্যার যোগে কাল কেউটের ভরা বিষের শরীরে যে জ¦রা হয় সেই জ¦ালায় জ¦লে ওঠে জুম্মন। তীরে মাথার মতো শাণিত তেজে সে চলে যায়- ফিরে আসার জন্য। রাতে ডোমদের সভা হয়।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনক্রমেই তারা পল্লী ছাড়বে না। পরদিন ডোম পল্লীতে আগুন দিতে আসলে ডোমরা তিনজনকে ধরে থানায় দিলেও কাজ হয় না। তারপর চলতে থাকে জুম্মন মিয়ার খা-ব দাহন। সন্ধ্যায় লোকজন নিয়ে হামলা চালাতে আাসে জুম্মন মিয়া। লক্ষণ ডোমের বউ লছমীরে ধইরা এক টান মাইরা বুকের সঙ্গে বামহাতে জড়িয়ে রিভলবার বের করে জুম্মন লছমীকে নিয়ে যেতে চায়। পেছন থেকে মিলন রামদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। লোকজন সব পালাতে থাকে। জুম্মন মিয়া মৃত মানেই লোকজন আবার কোন জুম্মনের আশ্রয়ে যাবে।
পালানোর সময় তারা-গুলি, পটকা ছুড়তে থাকে। আশপাশের এলাকার লোকজন জমা হতে থাকে ধোঁয়া-ধূসর পল্লীতে। এর মধ্যে পুলিশ এসে রক্তমাখা রামদাসহ মিলনকে গ্রেপ্তার করে। মিলনের মা কান্দে- মিলন কান্না থামাতে সান্ত¦না দেয়। তারপর পুলিশের গাড়িতে ওঠে। এর মধ্যে খবর আসে লছমী গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ডোম পল্লীর কান্না মধুমতি শোনে। লোকজন শোনে, তবু মায়া-মমতার বাঁধন অস্পৃশ্যতার কঠিন রশ্মিকে ছিড়তে পারে না। লছমীর লাশ নিয়া মনিস্দরের সামনে আসতে আসতে মিলনের গাড়ি ছেড়ে দেয়। জ¦লে ওঠে কাঠ কয়লার শ্মশান। শ্মশানের ডোম জীবনকে মুক্ত করতে মিলন পুলিশের হাতে আর লছমী চিতায় ওঠে।
এবার ধীরু ডোম কাঁদতে কাঁদতে বলে, আজ শ্রাবণী পূজা। আজ আর পূজা রইস না। আজ তোরা আমার মা লছমীর জন্য দেবী শ্রাবণীর পালার একটা গান গা- সব্বাই গেয়ে ওঠে- বেহুলাগো বেহুলা, ভাসো মাগো বেহুলা- তোমারে ভাসাইছি মা কালিদহে ওগো মা। কাঁদতে কাঁদতে চিতার আগুন নিভে আসে। অমাবশ্যার অন্ধকারের আলোয় চিল্কায় মধুমতি। আকাশটা উবু হয়ে যেন নিচে নামছে। দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে- সবাই বলতে থাকে নদীর জল চিল্কায়, সকাল হবে সকাল- সক্বলে দেখতে ডোম পল্লীর মানুষেরা শশ্মান ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে।