ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

অহ নওরোজ

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

পাহাড়গুলোর নাম আল্টা গ্যারাটক্সা

(পূর্ব প্রকাশের 
পার্ক নামে। স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, পাহাড়গুলোর নাম আল্টা গ্যারাটক্সা (Alta Garrotxa)। মূলত এই পাহাড়গুলো স্পেনের উত্তর দিকে ফরাসি দেশের সীমান্তে অবস্থিত পিরিনীয় পর্বত-শ্রেণির অংশ। এই পর্বত-শ্রেণির মধ্য দিয়েই ফ্রান্স ও স্পেনের বিভাজন রেখা চলে গেছে। এই পর্বতমালাটির অভ্যন্তরে পৃথিবীর ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম দেশ অ্যান্ডোরা অবস্থিত। অ্যান্ডোরা যাওয়ার গল্প অন্য এক লেখায় কখনো করা যাবে।
জানতে পারি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায়  ৪ শত ফুট উচ্চতায় আমাদের যেখানে ক্যাম্প তার কিছুটা কাছে পাহাড়ের মধ্যে ছোট্টো একটি আবাসিক হোটেল অবস্থিত। সেই হোটেল সংলগ্ন ছোটো ভলিবল মাঠ এবং সুইমিং পুল বা নীল জলের শান বাঁধানো পুকুরটি আমাদের ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়া আছে, চাইলেই আমরা সেখানে যেতে পারি। কৌতূহলে এক-দুই বার সেখানে যাইও। দলের অধিকাংশই পুল আর মাঠে বেশি সময় কাটায়। কিন্তু আমার মতো কয়েকজনের তাতে যেন মন নেই—এতো পথ পাড়ি দিয়ে কাতালোনিয়ার পাহাড়ে এসে যদি সেই ইট-কাঠের শহুরে ঘটনায় আবদ্ধ থাকি, তাহলে আসার কী অর্থ হলো? কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই এলাকা ঘুরে দেখবো। 
প্রথম আগ্রহ মুগা নদীকে ঘিরে। কিন্তু আবশ্যিক নিয়ম হলো, দলের কেউ যদি আলাদা কোনো পরিকল্পনা করে তবে সবকিছুই প্রথমে আমাদের দলের প্রধান এবং পরে ক্যাম্পিং-এর আয়োজকদের জানাতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী তাদের জানানো হয়। তারা বলেন, এই সাতদিনের কোনো একদিন ক্যাম্পের আয়োজকের পক্ষ থেকে একটি চৌকস বিশেষজ্ঞ দলের সহায়তায় আমরা মুগা নদী ট্রেকিং করার সুযোগ পাবো। নিজেরা একাকী যেন আমরা এই নদী ধরে কোথাও না যাই। কারণ, সরু পাহাড়ি-পাথুরে এই নদীর তলদেশের পাথর কিছু কিছু স্থানে খুব পিচ্ছিল, কিছু কিছু স্থানে গভীর খাদ। পিছলে পাথরের গায়ে ধাক্কা খেলে খুব খারাপ কিছু হতে পারে। যারা এই নদী ভালো চেনে তাদের সঙ্গে করে না গেলে আমরা যে কোনো সময়ই বিপদে পড়তে পারি। আমরা তবু নদীর কাছে যাই। সুস্বাদু জলে ভরা নদী, বড়ো বড়ো প্রাচীন পাথরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। 
ওয়াটার ট্রেকিং-এর দিনেও মুগা নদীকে নিয়ে আমাদের উত্তেজনার অন্ত ছিল না। সবাইকেই হেলমেট আর নেওপ্রিনআনসুগ (জার্মান: হবড়ঢ়ৎবহধহুঁম) নামে এক ধরনের নিউপ্রিন, রবার বা সিন্থেটিকের স্যুট বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হয়। সঙ্গে কাপড়ের জুতো। যেহেতু পাথুরে পিচ্ছিল সরু খরস্রোতা নদী, সে কারণেই এই প্রস্তুতি। তারপরও একবার পড়ে গিয়ে কনুই ছিলে যাওয়া রক্ষা করতে পারিনি।
যাত্রা শুরু হয় ক্যাম্প থেকে উত্তরে মুগা নদীর প্রশস্ত অগভীর স্থান থেকে। জলের গভীরতা সেখানে হাঁটু থেকে কোমর অব্দি। আমরা হাঁটতে শুরু করি নদীর মাঝ বরাবর। অধিকাংশ স্থানে নদীর কোনো পাড় নেই- দুই পাশে পাথুরে পাহাড় খাড়া উপরে উঠে গেছে, প্রায়ই মনে হয় দুই পাহাড়ের চিড়ে আমরা। পাহাড়ের মধ্যকার ফাটল ধরে বয়ে চলা নদীতে কেবলই পাথর। কোথাও সহসা সুগভীর, কোথাও অগভীর। কোথাও পিছলে যেতে হয় বৃহৎ পাথরের উপরে। কোথাও লাফ দিয়ে তলিয়ে যেতে হয় দশ-বিশ হাত। স্রোতস্বিনীর ভেতরে বড়ো-ছোটো মাছের দেখা।

চারপাশে পাখি আর ঝিঁঝিঁর অবশ্রান্ত ডাক। কিছু কিছু স্থানে নদীটি ঝর্ণা আকারে গড়িয়ে পড়েছে। সেখানে পানির গতিতে সতর্কতা নিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ঝর্না-আকারে জল পড়া এমন কিছু প্রশস্ত স্থানে আমরা দেখা পেয়েছি স্পেনীয় বালক বালিকাদের, তারা পাহাড়ের উপর থেকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় পানিতে লাফিয়ে পড়ছে আর তাদের ভাষায় বিভিন্ন শব্দের ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে। উঁচু থেকে গভীর জলে আমাদের লাফিয়ে পড়া দেখে তাদেরকে সমচ্চরে গান গাইতে শুনি। আমাদের দলে ব্রাজিলের যে শিক্ষার্থী ছিলো, সে পর্তুগিজ এবং স্পেনীয় ভাষায় বিশেষ পারদর্শী। তার কাছ থেকে পরে জানতে পারি, স্পেনীয় বালক-বালিকারা আমাদের উদ্দেশ্যে যে গান করেছিলো তা ছিলো মূলত কাতালান ভাষায়; তাতে তারা আমাদেরকে দুর্বল আখ্যা দিয়ে গান আকারে কিছু শব্দ বলেছে। একথা জানার পরও কোনোভাবেই মনের উৎফুল্লতা কমেনি। মুগা নদীর সবুজ-স্বচ্ছ জল বেয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে আমরা ফিরে আসি ক্যাম্পে। অবসরে মুকুরিত হওয়ার মতো নতুন গল্পে আমাদের জীবন মেখে যায়।
পাহাড়ে ক্যাম্পিং-এর অন্য একদিন সুযোগ হয় আয়োজক দলের তত্ত্বাবধানে মাউন্টেন-বাইক বা পাহাড়ের জন্য বিশেষ সাইকেল সফরে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো সফরে পাহাড়ের বনরাজির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অনেক রকমের ফুল ও গাছের দেখা পেয়েছি। বুনো মুরগি, ধূসর রঙের বরাহ শাবক আর হরিণদল ছাড়া আর কোনো বুনো জন্তুর সাক্ষাৎ সে যাত্রায় পাওয়া যায়নি। এদিককার পাহাড়গুলোর মাটি কিছুস্থানে এঁটেলজাতীয়, অনেকাংশে পাথুরে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ক্ষুদে ক্ষুদে গ্রাম। তারা আদিবাসী কিনা জানতে পারি না, তবে পাহাড়ের উপত্যকায় তাদের রচিত গম আর অলিভের শস্যচিত্রিত ভূমি আমাদের মস্তিষ্কে অচেনা সবুজের স্বাদ রাখে।
ক্যাম্পিং-এর স্থান থেকে পাহাড়ের যে চূড়া দেখা যায়, একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল সেখানে যাওয়ার। পর্যটক তত্ত্বাবধায়ক দলের সে বিষয়ে কোনো আয়োজন তালিকায় নেই বলে আমরা ছয় জনের একটি দল করে নিজেরাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত করি। আয়োজক দলের কাছ থেকে কয়েকটি স্থানীয় কাগজের মানচিত্র ছাড়া আর কোনো সহায়তা মেলে না। পাহাড়ে প্রায় অনেক স্থানেই মোবাইলের কোনো নেটওয়ার্ক না থাকায় ইন্টারনেটের সাহায্য পাওয়াও অসাধ্য হয়ে পড়ে। তবু যাত্রার নকশা করি— আনকোরা বলে পিছু হাঁটা পথে যাওয়া যেন আমাদের ধাঁতে নেই। মানচিত্র অনুসারে পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে যেখানে রাস্তা থাকার কথা সেখানে রাস্তার বদলে পাই বন-জঙ্গলের ফাঁকে আলপথের মতো পথের নিশানা।

পথ ধরে হাঁটতে থাকি। প্রত্যেকের কাছে কয়েক লিটার করে পানি আর কিছু ফল-ফলারি। বনের ছায়ার ভেতর রকমারি পতঙ্গ মাঝে মাঝে গায়ে এসে পড়ে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কান ঝালা-পালা হওয়ার উপক্রম। এসবের সঙ্গে বনের ভেতরে ভ্যাপসা গরম। মাথার ওপরে বড়ো বড়ো পাইন গাছের মাথায় দারুণ বাতাস বইতে দেখি; কিন্তু সে বাতাস ঘন পত্ররাজি আর গুল্মজাতীয় গাছদের ভেদ করে আমাদের কাছে পৌঁছায় না। অগত্যা ঘামে ভিজে জবজবে হতে হয়। এদিকে জামা খুলে ফেলবো সেই উপায়ও নেই- সরু পাহাড়ি পথের দু’পাশে কন্টকযুক্ত ছোটো ছোটো উদ্ভিদ। তাদের সংস্পর্শে এলেই শরীরে সুক্ত আঁচড় পড়ে যায়। কাতালোনিয়ার পাহাড়ে ওক গাছের দুই রকম প্রজাতি চোখে পড়ে।

এই দুই প্রজাতিরই পাতা ওক গাছের মতো অবিকল, কিন্তু পাতার নিচের অংশ সাদাটে, আঁকারে ছোটো-গাছগুলো ঝোপ আঁকারে বড়ো হয়, তবে বেশি বাড়ে না। এক প্রজাতি কাঁটাযুক্ত, অন্যটা কাটামুক্ত। যতই উপরে উঠি ততই তাদের আধিক্য দেখি। এক পর্যায়ে গাছের ঘনত্ব কমে আসে, পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় চারপাশের পর্বত-শ্রেণির নয়াভিরাম দৃশ্যে। যতদূর চোখ যায় শুধু কাতালোনিয়ার পর্বত-শ্রেণির সবুজ চোখে পড়ে। যতই উপরে উঠি ততই পথ আরও বন্ধুর হয়, পাথুরে পথে হেঁটে ওপরে ওঠা বেশ কঠিন- সতর্ক না হলে গড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। (চলবে...)

×