ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

গল্প ॥ মন ভালো নেই

কাজী সুফিয়া আখ্তার

প্রকাশিত: ২২:২৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গল্প ॥ মন ভালো নেই

আজ সোনাভানুর মন ভালো নেই

আজ সোনাভানুর মন ভালো নেই। শরীরও ভালো নেই। শুধু ঘাম ঝরছে গা বেয়ে। তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। রৌদ্রের দিকে তাকানো যায় না। মাথা ঘুরছে ভনভন করে। শাড়িটা আলগা করে বসে পড়ে উঠানের কোণে আম গাছের ছায়ায়। পাখিরাও ভালো নেই। বৃক্ষরাও ভালো নেই। বৃষ্টির অভাবে পাতা লাল হয়ে ঝরে যাচ্ছে। রান্না ঘরের পাশে লাগানো জামরুল গাছে এই প্রথম জামরুল ধরেছে। বোটা শুকিয়ে জামরুল ঝরে পড়ে আছে গাছের গোড়ায়, মাটিতে। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। এমন আর্দ্রতাহীন দিন উপেক্ষা করে বেলী ফুলগাছটা প্রাণ ভরে নয়ন জুড়ানো ফুল ফুটিয়েছে! বিপরীত আবহাওয়ায় ছোট ছোট গাছগুলো কী আপ্রাণ চেষ্টায় সপ্রাণ বেড়ে উঠে! ভাবলে অবাক মানতে হয়।

ক্লান্তিতে ভরা শরীরে সেদিকে তাকিয়ে পরানে যারপর নাই শান্তি লাগে তার। অন্তর ভিজে ওঠে মমতায়, না পরম করুণাময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায়; সত্তুর ছুঁই ছুঁই সোনাভানু সঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মনে মনে সে গাছের প্রাণ শক্তি ধার চায়। এই বয়সে এসে একেবারে কম কষ্টকর কাজ করে না, তা নয়। যথেষ্ট করে। ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। সবসময় এই কাজ থাকেও না। কষ্ট হলেও হাতে রোজকার আয়ের টাকা আসে। ঘর-সংসারের কাজে মেয়েরাও মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করে। তাঁর ছেলে বলতে ওই মেয়েদের ঘরে জন্ম নেওয়া ছেলেগুলো। সম্পর্কে নাতি। এখনো বড় হয় নাই। ঘাড় মোটা হয় নাই। লকলক করে লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠেছে,  লম্বা হয়েছে।

ওই যে বলে না, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হাটের দিনে তারা বাজার সদাই করে দেয়। নতুন সবজি বাজারে বিক্রি করে দেয়। এখানে এখন সবজি,  ধান,  পাটের চাষের জমি নেই বললেই চলে। ঘরের কোণায়, রাস্তার পাশে লাগানো লাউ, মিষ্টি কুমড়ো,  বেগুনি ফুলের শিম ভরসা। এক সময় চাষের জমিতে ধানের চাষ হতো। এখন শুধু চিংড়ি চাষ হয়। শ্যামনগরে এখন অনেক জায়গায় সবজির চাষ হয়। এ বছর শ্যামনগরের আল্পনা রানী সবজি চাষ করে পুরস্কার পেল। দাতিনাখালিতে সবজি চাষ খুব কঠিন। নোনা পানিতে কিছু হতে চায় না। ঘরের কোণায় লাউ, কুমড়ার বিচি লাগালেও নোনা মাটিতে জন্মাতে চায় না। রাজহাঁস পালা যায়। চিংড়ি ঘেরে মাছের গায়ে শ্যাওলা খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয়। দেশী পাতিহাঁসের চারটা ডিমের সমান একটা ডিম পাড়ে। দেখে মন ভরে যায়। চিন্তা লাগে এ বছর মাছ ভালো ধরা পড়ছে না দেখে। প্রাকৃতিক মাছ কমবেশি সবাই ধরে খেতে পারে। রাজহাঁসের ডিম তো সবাই খেতে পায় না।

এখানে এই দাঁতিনাখালিতে অধিকাংশই নিম্নবিত্তের মানুষ বাস করে। দিন আনে দিন খায় এক ধরনের মানুষ, মওয়ালী-বাওয়ালী পেশার মানুষ বাস করে। আইলার পরে এনজিওদের উন্নয়ন কর্মসূচির কল্যাণে গরিব মানুষে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সরকার পথঘাট নির্মাণ করছে। প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর নারীরা, বিধবা নারীরা কাজের সুযোগ পাচ্ছে। তবু অভাব পিছু ছাড়ে না। দারিদ্র্য সাধারণ মানুষের জীবন থেকে খুব আস্তে আস্তে পিছু সরে।  
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও চারপাশের সবার ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থেকে ভালো আছে সোনাভানু। ছোটখাট গড়নের ছিমছাম মহিলা এখনো সুরেলা কণ্ঠে গান গায়। মিষ্টি করে কথা বলে। কোনো কূটকাচালিতে থাকে না সে। তাদের পরিবার ছিল বয়াতি পরিবার। বাবার বাপ-দাদার ভিটে ছিল উত্তর ২৪ পরগনায়। তাদের কখনো দেখেনি সোনাভানু ও তার ভাইবোনেরা। চার ভিটেতে চার দাদার বড় বড় চৌচালা ঘর-উঠোন-পুকুর-গাছপালা সমেত সচ্ছল গৃহস্থ বাড়ি ছিল বলে বাবার মুখে গল্প শুনেছে। সুন্দরবনের ধারে সুন্দরবন নির্ভর জীবন, বনজীবীদের দুঃখ ভরা জীবন, গান পাগল বাবার কোনোটাই ভালো লাগত না কৈশোরে, দেশ ভাগের পরে একদিন বাবা বাড়ি থেকে পালিয়ে এক গানের দলের সঙ্গে প্রথমে বাগেরহাটের শরণখোলায় আসে।

সেখানে কয়েক বছর থাকার পরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই খুলনা হয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে চলে আসে। ক্ষেতখোলার কাজ কোনো দিনই তার ভালো লাগে নাই। সুন্দরবনের মায়াও ছাড়তে পারে নাই। খেয়ে না খেয়ে গানের দলের সাথেই বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে বেড়াতো। যাযাবর জীবন। গানের দলের কর্তা বাবাকে খুব ভালো বাসতেন। এসবই বাবার মুখে শোনা। তিনি মারা গেলে বাবা নিজেই গানের দল গড়েন। গানের দলের মূল গায়েন বাবা দেখতে সুন্দর আছিল। গান শুনে, রূপে মুগ্ধ এক গৃহস্থবাড়ির মেয়ে তার প্রেমে পরে। একদিন পালিয়ে গিয়ে বিয়েশাদি করে বসতি গাড়ে এখানেই। বাবা সোনামিয়া বয়াতি পূর্ণিমা রাইতে তার দল নিয়া গ্রামের মানুষের বাড়ির উঠানে গানের আসর বসাত।

অগ্রাহায়ণ মাসে ধানের মাড়াই করতে করতে কৃষক বাড়ির মানুষ, মুনিষ্যি সারারাত কাজ করত, গান শুনত। কখনো নিজেরাও গলা মেলাত, সুর ধরত। ছোটবেলায় অনেক জায়গায় সোনাভানুও বাবার সঙ্গে যেত। তার বাবা গানও বাঁধত। এই সময়ে আয়- রোজগার ভালো হতো। কিন্তু অন্য সময়ে সংসার চালান কঠিন ছিল। সংসার বিবাগী মানুষটার ঘরে চাল আছে কি নাই সেই খেয়াল থাকত না। বিভিন্ন স্থানে হাটের দিনে গান করত। মানুষ খুশি হয়ে যা দিতেন তাই দিয়ে সংসার চালানো! তাতে কি হয়? মা মাঝে মাঝে রেগে যেতেন। বলতেন, কি কুক্ষণে যে আপনার প্রেমে পইরে ঘর ছাড়লাম! সুখের মুখ দেখতি পালাম না। বিবাহ করলেন, সংসার করলেন, সংসারি হইলেন না। সারাডা জেবন একইরহম থেইক্কে গেলেন।

শুনে বাবা কখনো মিটিমিটি হাসত। কখনো চুপ কইরে থেইক্কে আস্তে করে ঘর থেকে বাইর হয়ে যেতেন। এক সপ্তাহ পনেরো দিন কুন হদিস নাই। নিত্য অভাব সঙ্গী ছিল। তা-ও কী সুখের দিন ছিল! ভাইবোরে মুখে গান ছিল। সোনাভানুরা ছিল বাবার দলে। বলত এ্যা মা, তুই বাবারে বকা দিবি না। মাইষে গান শুইন্ন্যা ট্যাকা না দিলে হেইডা কি বাবার দুষ? আমাগো আলাভোলা গানপাগলা বাবাটা কি ভালোই না ছিল! 
Ñঅ দাদি একা একা হাসতিছো ক্যান? দাদার সঙ্গে রঙ্গ করার কথা মনে পড়িছে? পাশের ঘরের ভেতর থেকে সালাম বলে ওঠে। অনেকক্ষণ সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দরজা দিয়ে সোনাভানুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভাবান্তর লক্ষ্য করছিল। 
Ñ ধুর যা ছেমড়া। নিজের বাপ-মায়ের মিডা ঝগড়ার কথা মনে হইছে। আমার বাপ কুনদিন জিততে পারে নাই। মায়ে ঝগড়া কইরে আবার কান্দন জুড়তো। 
হাসতে হাসতে সোনাভানু একচালা রান্নাঘরের দিকে পা চালায়। একটু পরেই নাতি দুইটা স্কুল থেকে ফিরবে। হাঁড়িতে দু’মুঠো খুদ পরে আছে। পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ-হলুদ দিয়ে খুদ ফোটাতে উনুন ধরায়। ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে। তার হাতের খুদ ফোটানো তরু খুব মজা করে খেত। ছোটবেলায় তরুলতা গায়েন যাত্রা দলে গান করে এই অঞ্চলে খুব নাম করেছিল। রাজলক্ষ্মী অপেরার সঙ্গে এদিক-সেদিক যেত। বড় হয়ে যাত্রাদলের এক হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে ভারতে চলে যায়। অনেক আগে এখানকার একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখে শুনেছে তরু ভালো আছে। সে সংসার করছে। তার সঙ্গে তরুলতা ও তার বরের দেখা হয়েছে। কিন্তু হিন্দু পরিবারে মুসলমান মাইয়া তো গ্রহণ করে না।

দুইদিন পরে যদি তাড়াইয়া দেয় এই মাইয়ার কপালে কি দুর্ভোগ হইব? এই চিন্তায় আদরের মাইয়া চলে যাওয়ার শোকে বাবা একদম চুপ করে গেলেন। সারাদিন মনমরা হয়ে থাকতেন। গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন। গুনগুনও করতেন না। এক বর্ষার রাতে দুই দিন জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। কত বছর হয়ে গেল! তরুলতা বেঁচে আছে না মারা গেছে জানে না সে। মা দুর্গার মতো সুন্দর চেহারা ছিল বুইনের। মন কাঁদে। বড় মন কাঁদে। 
ছোট দুই ভাই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সুমায় নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের, ভারত যাত্রীদের পারাপার করত। যুদ্ধের শেষের দিকে রাজাকাররা আর্মিদেরকে ওদের চিনিয়ে দেয়। এক পৌষের কুয়াশাছন্ন সকালে ওরা নৌকাতেই ছিল। পাক-আর্মি ওদের গুলি করে বুক ঝাঝরা করে দেয়। ওরা রক্তাক্ত শরীরে খেলপেটুয়ার পানি লাল করে তলিয়ে যায় গভীর জলের ¯্রােতের আলিঙ্গনে। মাছের নামে নাম এই গ্রাম দাঁতিনাখালির আলো-হাওয়ায় ওরা বেড়ে উঠেছিল। অনেক পুরনো বসতি। প্রতিদিন জোয়ার-ভাটায় জলে ডুবে, ভেসে ওঠে, প্রাকৃতিক বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়ে বারে বারে জীবন-মরণের বাঁচার লড়াইয়ে জিতে আছে। দেখলে মনে হয় নতুন বসতি। আইলার পরে উন্নয়নের ছোঁয়া একটু একটু লাগতে শুরু করেছে।

প্রতিদিনের খাবারের মাছ সোনাভানু নিজেই ঝাঁকি জাল দিয়ে ধরে। ছোট ছোট চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ, লাল শাক ভাজি বেশ লাগে খেতে। মাঝে মাঝে চিংড়ি মাছের বড়া করে। তাছাড়া ছোট ছোট কাঁকড়া তো আছেই। তবে ওখানে যেহেতু কাঁকড়ার পয়েন্ট আছে। মাঝে মধ্যে বিক্রি করে দেয়। দুটো পয়সা ঘরে আসে। ছোট মেয়ে তার দুই ছেলেকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। দিন ভালোই চলে যায়। মাকে সাহায্য করতে তাদের ইচ্ছে ষোলো আনা। কিন্তু সময় ও সুযোগ মেলে না। মেয়ে কাজে যায়। ছেলেরা স্কুলে যায়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। মাছ ধরার কাজটা সকালে জোয়ারের সময় সেরে নেয়। ছোট চিংড়ি ও ছোট কাঁকড়া বেশি পানিতে থাকতে পারে না। উপরে উঠে আসে।

এই সময়ে সকলেই প্রায় মাছ ধরতে তিন কোণা জাল নিয়ে নেমে যায় জলে। সকাল থেকে আজ তার কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। মনটা জমাট বেঁধে আছে। গলার কাছে কষ্টগুলো যেন দলা পাকিয়ে আছে। কান্নাও করতে পারছে না। উনুনে আধা শুকনো পাতা ঠেলতে ঠেলতে ধোঁয়ায় সোনাভানুর দুই চোখ জ্বালা করে ওঠে। এতক্ষণ পরে দুপুর গড়িয়ে সোনাভানুর দুই গাল বেয়ে জল ঝরে, না কি হৃদয়ের গভীরে লুকানো কষ্ট ঝরে পড়ে সে বুঝতে পারে না। নাতিদের ফেরার অপেক্ষায় কান্না ভেজা চোখে পথের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে।

×