ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক বন্দে আলী মিয়া

সোহেল বীর

প্রকাশিত: ০১:৩৫, ২৩ জুন ২০২৩

বহুমাত্রিক বন্দে আলী মিয়া

আলী মিয়া

‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।’

‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাখ্যাত বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাবান কবি বন্দে আলী মিয়া একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, চিত্রকর, গীতিকার, নাট্যকার ও শিশুসাহিত্যিক। তাঁর কবিতায় আমরা যেমন পাই আবহমান বাংলার পল্লির কথা, তেমনি গ্রামীণ দৃশ্যপট, লোকজ উপাদনসহ সুনিপুণভাবে ফুটে ওঠে প্রকৃতির কথা। 
কবিতায় প্রকৃতি বন্দনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।তাঁর সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় একটি কবিতা- আমাদের গ্রাম। এ কবিতায় তিনি চমৎকারভাবে গ্রামের স্বরূপ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রাম আমাদের অস্তিত্বের শিকড়। অনাবিল সবুজ আর প্রকৃতির রং দিয়ে লেখা গ্রামখানি মা-মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রামের আলো-বায়ুতে রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আর এই আলো-বায়ুতে বেড়ে ওঠে প্রতিটি প্রাণ। কবির ভাষায়,

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।

‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাটি শুধু কবির গ্রাম নয়, এ যে আবহমান বাংলার গ্রামের প্রকৃত দৃশ্য। এই কবিতাটি যেমন আমাদের সামনে একটি গ্রামের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, তেমনিভাবে শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় একটি কবিতা।
বহুমাত্রিক লেখক বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। পিতা মুন্সী উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যের উচ্চাসনে আরোহণ করতে সক্ষম হন। কর্মজীবনে তিনি প্রথমদিকে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

তাঁর কলকাতা যাপনের সময় বন্দে আলী মিয়া কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেন। সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানিতে তাঁর রচিত পালাগান ও নাটিকা রেকর্ড আকারে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ উপন্যাস ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরই আলোচনায় চলে আসেন। পাঠকমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয় তাঁর এই বইটি। এই বইয়ে লোকজ উপাদানে সমৃদ্ধ কবিতায় প্রকৃতির স্বরূপ চিত্র অঙ্কনে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। বুনো ঝাউ, বুড়ো বট, গাঙের তট, বিহানের লাঙল, চাষী, গাঙচিল নানা অনুষঙ্গ ‘ময়নামতির চর’ কবিতার উপজীব্য। কবি লিখেছেন,

এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও-পারের বুড়ো বট
মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;
এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী,
কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি ।
বাংলাদেশের চরের সহজ-সরল প্রকৃত বর্ণনা পাওয়া যায় এ কবিতায়। পুরো কবিতাজুড়ে রয়েছে চরে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও জীবিকার বর্ণনা, চরের মাঠ-ঘাট, নদী, ঐতিহ্যবাহী উৎসবসহ প্রকৃতির আসল রূপ ও  গ্রামীণ জীবনের আবহমান দৃশ্যপট। 

উৎসব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূন্য বালির চর
এ-পারের পানে চাহিয়া ও-পার কাঁদে শুধু রাত ভর।
[ময়নামতির চর]
‘ময়নামতির চর’ ছাড়াও চর নিয়ে আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ হলো- ‘পদ্মানদীর চর’ এবং ‘মধুমতীর চর’। তাঁর আরও উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘অনুরাগ’ ও ‘ধরিত্রী’। নামগুলোর মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই আবহমান বাংলার গ্রামীণ চিত্রকল্প এবং প্রকৃতি বন্দনা।‘ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর এতটাই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীতে কবি বন্দে আলী মিয়া ‘ময়নামতির চর’-এর কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল, বরেণ্য কবি বন্দে আলী মিয়া বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও সমানতালে লিখেছেন। শিশুদের জন্য তিনি নিরলস সাহিত্য চর্চা করেছেন। তার লেখায় বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছে নতুন এক মাত্রা।‘চোর জামাই’, ‘মেঘকুমারী’, ‘বোকা জামাই, ‘ডাইনী বউ’, ‘রূপকথা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘শিয়াল প-িতের পাঠশালা’ ও ‘সাত রাজ্যের গল্প’ তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। রেডিওতে চাকরি করার সময় শিশুদের উপযোগী গল্প লিখে তিনি ‘গল্পদাদু’ নামে শিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় গ্রামীণ কণ্ঠস্বর, পল্লির কবি ও প্রকৃতির কবি। সাহিত্যে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সাহিত্য প্রতিভার জন্য তৎকালীন সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে তিনি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৮৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
১৯৭৯ সালের ২৭শে জুন কবি বন্দে আলী মিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যান, রাজশাহীতে তাঁর মৃত্য হয়। পল্লি ও প্রকৃতির কবি, ছোটদের বড় এই লেখক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর অমর কীর্তি কবিতা, গল্প, গান বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। সাহিত্যকর্মের মাঝেই তিনি টিকে থাকবেন। তবে বর্তমানে কবি বন্দে আলী মিয়া যেন আমাদের অন্তরালে চলে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁর পাঠ অতি জরুরি। কেননা, মন ও মননের প্রকৃত চর্চায় বন্দে আলী মিয়া এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
কবি বন্দে আলী মিয়ার ব্যবহৃত আসবাবপত্র, লেখার টেবিল, আলমারি, হাতে লেখা পা-ুলিপি, তাঁর আঁকা ছবিসহ নানাবিধ জিনিসপত্র অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম। কবির স্মৃতিবিজড়তি এসব মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। পরিবারের পক্ষ থেকে কবির নাতনি ডা. নাদিরা আক্তার রুনু কবি বন্দে আলী মিয়াকে বাংলাসাহিত্যের সম্পদ তথা আমাদের জাতীয় সম্পদ উল্লেখ করে তাঁর স্মৃতিবিজড়তি মূল্যবান জিনিসপত্রসহ বাস্তুভিটা সংরক্ষণ করার জন্য কবির নামে একটি গ্রন্থাগার বা স্মৃতি সংগ্রহশালা তৈরির পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমরা যত বেশি বহুমাত্রিক লেখক বন্দে আলী মিয়াকে পাঠ করব, ততবেশি তিনি পঠিত হবেন এবং বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখায়। প্রিয় এই লেখকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

×