
ছবি: সংগৃহীত
স্বামীর মাদকাসক্তি, নির্যাতন আর অপরাধপ্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে ৩৪ বছর বয়সী এক নারী তার স্বামীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুন হন স্বামী। মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় অন্য রাজ্যের একটি খালে। এরপর নতুন জীবনের স্বপ্নে প্রেমিকের সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও করতে থাকেন স্ত্রী। কিন্তু স্বামীর মোবাইল ফোন ও প্রেমিকের একটিমাত্র ভুল পুরো পরিকল্পনাই ফাঁস করে দেয় পুলিশের কাছে।
ঘটনাটি ভারতের দিল্লির। দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের একাধিক সদস্য খুঁজছিলেন বহু মামলার পলাতক আসামি পীতম প্রকাশকে। তাকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশ উন্মোচন করে ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ডের গল্প। তদন্তে উঠে আসে—পীতমের স্ত্রী সোনিয়া তাকে হত্যার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, যাতে প্রেমিককে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সোনিয়া ও তার প্রেমিক রোহিতকে। দুজনেই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
প্রেম, নির্যাতন আর প্রতিশোধের শুরু
সোনিয়া জানান, মাত্র ১৬ বছর বয়সে পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করেন পীতমকে, যার বয়স ছিল ৪২। তাদের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। বাস করতেন দিল্লির আলিপুরে। কিন্তু পীতম ছিলেন পেশাদার অপরাধী— মাদকাসক্ত, অস্ত্র বহন, ডাকাতি, অপহরণসহ একাধিক মামলার আসামি। স্ত্রী সোনিয়া বহুবার চেষ্টা করেছিলেন তাকে অপরাধ জগত থেকে সরাতে। কিন্তু ব্যর্থ হন। বরং প্রতিনিয়ত মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে পীতম তাকে মারধর করতেন।
২০২৩ সালে সোনিয়ার পরিচয় হয় রোহিত নামে এক ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে। তিনিও একসময় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের পর দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন। কিন্তু পীতম ছিলেন সেই পথে প্রধান বাধা।
২০২৩ সালের ২ জুলাই সোনিয়া স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বোন দীপার বাড়ি চলে যান হরিয়ানার সোনিপাতে। রোহিত তাকে সেখানে গাড়িতে করে পৌঁছে দেন। পথেই সোনিয়া অনুরোধ করেন, পীতমকে যেন হত্যা করেন রোহিত। রোহিত যদিও অতীতে চারটি অপরাধমূলক মামলায় জড়িত ছিলেন, তবু নিজ হাতে খুন করতে অস্বীকৃতি জানান। পরিবর্তে বলেন, ৬ লাখ টাকা দিলে খুনি ভাড়া করবেন।
সোনিয়ার হাতে তখন এত টাকা ছিল না। কথোপকথন সেখানেই শেষ হয়। রোহিত তাকে বোনের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান।
বিকল্প পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ড
৫ জুলাই পীতম সোনিপাতে যান সোনিয়াকে ফিরিয়ে আনতে। সেদিনও হয় উত্তপ্ত ঝগড়া। এরপর সোনিয়া খুনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যোগাযোগ করেন বোনের স্বামীর ভাই বিজয়ের সঙ্গে। বিজয় প্রথমে ১ লাখ টাকা দাবি করেন পীতমকে হত্যার জন্য। পরে ৫০ হাজার টাকায় রফা হয়।
সেদিন রাতেই পীতম অনুরোধ করেন, সোনিয়া যেন তার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যান। সোনিয়া রাজি না হয়ে বলেন, তিনি বোনের বাড়িতেই থাকবেন। এরপর রাতেই বিজয়কে নির্দেশ দেন খুন করতে। রাতের বেলায় পীতম ও বিজয় নিচতলায় ঘুমান, আর সোনিয়া ও অন্যরা ছাদে যান। গভীর রাতে বিজয় পীতমকে হত্যা করেন। মরদেহ চাদরে মুড়ে পাশের একটি নালায় ফেলে দেন। পীতমের ফোন পেয়ে যান সোনিয়া। পরে দিল্লির আলিপুর থানায় স্বামী নিখোঁজ বলে একটি অভিযোগও দায়ের করেন তিনি।
ধরা পড়লেন প্রেমিকের ভুলে
এতকিছুর পর সোনিয়া পীতমের ফোনটি দেন প্রেমিক রোহিতকে এবং বলেন সেটি নষ্ট করে ফেলতে। কিন্তু রোহিত তা করেননি। বরং সেটি ব্যবহার করতে থাকেন।
দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্তকারীরা হঠাৎই খেয়াল করেন, বহুদিন ধরে নিখোঁজ পলাতক পীতমের কোনো খোঁজ নেই। এরপর ফোন ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখা যায়—সেটি ব্যবহার হচ্ছে এবং সর্বশেষ অবস্থান সোনিপাতে। সন্দেহ ঘনিয়ে আসে রোহিতের দিকে। রোহিতকে নজরদারিতে নিয়ে অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে রোহিত বলেন, ফোনটি তিনি একজনের কাছ থেকে কিনেছেন। পরে চাপ দিলে ভেঙে পড়েন। জানান, সোনিয়ার সঙ্গে প্রেম, পীতমের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও মৃতদেহ ফেলে দেওয়ার বর্ণনা।
স্ত্রীর স্বীকারোক্তি ও তদন্তের অগ্রগতি
এরপর গ্রেপ্তার করা হয় সোনিয়াকে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেন পুরো পরিকল্পনা তারই ছিল। তিনি বলেন, খুনের পর বিজয় তাকে মরদেহের ছবি পাঠিয়েছিলেন। তিনি বিজয়কে ৫০ হাজার টাকা দেন এবং পীতমের একটি গাড়ি বিক্রি করে পান ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখান থেকে কিছু টাকা দেন রোহিতকে।
ঘটনাটি জানার পর দিল্লি পুলিশ যোগাযোগ করে হরিয়ানা পুলিশের সঙ্গে। তারা জানায়, ওই সময় একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়েছিল এবং ডিএনএ নমুনা সংরক্ষিত আছে।
বর্তমানে রোহিত ও সোনিয়া পুলিশের হেফাজতে আছেন। বিজয়ও আগেই একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তবে এই কাহিনীতে চমক আরও রয়েছে—পুলিশ জানায়, প্রেমিকা সোনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের মাঝেই এবছর এপ্রিলেই অন্য একজনকে বিয়ে করেছেন রোহিত।
সূত্র: এনডিটিভি।
রাকিব