ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর কবি নজরুল

রহিম আব্দুর রহিম

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৬ মে ২০২৩

বঙ্গবন্ধুর কবি নজরুল

.

পলাশী ট্র্যাজেডি একশত বিয়াল্লিশ বছর সিপাহী বিদ্রোহের বিয়াল্লিশ বছর পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে বাঙালির জাতীয় সাহিত্যের প্রাণপুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ এবং কাজী নজরুল ইসলাম অবিভাজ্য সত্তা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঢাকায় আসেন। এরপর বহুবার, শেষাবধি এখানেই শেষ নিশ্বা ত্যাগ। শৈশব-কৈশোর জীবনের সংগ্রামী কবি নজরুল ছিলেন স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জীবন আলেখ্যের অনুপ্রেরক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার কালজয়ী রাজনীতির কবি; যাঁর অন্তঃকরণে লালিত হয়েছে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শ, ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক জীবনে যাঁর ফুটে ওঠেছে কবি নজরুলের প্রতিচ্ছবি। দুরন্ত ডানপিটে স্বভাবের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এই একই স্বভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। শেখ মুজিব ছোট থেকেই ছিলেন দুরন্ত, চঞ্চল দুষ্টুমিতে পরিপূর্ণ এক প্রতিবাদী স্বভাবের মানুষ। একইভাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব-কৈশোরের চরিত্র ফুটে ওঠে। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান নিশ্চিতসহ গোটা জাতির মুক্তি কামনা করেছেন। একইভাবে রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। এক কথায় নজরুল আদর্শে অনুপ্রাণিত বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির নায়ক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুই জাতির সর্বকালের মহান রাষ্ট্রনায়ক যিনি কালজয়ী সংস্কৃতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে তাঁর বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলো স্বস্তির করেছিলেন; তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মর্যাদার আসনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কবির গান অনুপ্রেরণার অন্তঃহীন উৎস হিসেবে প্রজ্জ্বলিত ছিল। পূর্ববঙ্গের আনাচে-কানাচে, পাড়া-মহল্লায় কবি নজরুল বিচরণ করেছিলেন আপন মহিমায়, ফলে এই ভুখন্ডকে তিনি বারবার শ্রদ্ধা অবনত সম্মান জানিয়েছেন সর্বক্ষণ। নজরুল ইসলামেপূর্ববঙ্গএবংবাংলাদেশশীর্ষক গানে আবেগের মোহনী মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে অকপটে। কবি অসুস্থ  হওয়ার কয়েক মাস আগে দৈনিকনবযুগপত্রিকায় তিনি এক সম্পাদকীয় লেখেছিলেন, ‘আট বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট-বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ ভালোবাসলাম, মনে হলো এই আমার মা।কবি কবিতায় বলেছেন,

পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গা/ বিধৌত পূর্ব দিগন্তে/

তরুণ-অরুণ বীণা বাজে/তিমির বিভাবরী অন্তে।

কবি ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে বাঙালির বাঙলা নামের প্রবন্ধে লিখলেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলে-মেয়েকে ছোটবেলা থেকে একমাত্র শেখাও এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির, আমাদের। বাঙালির জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’ (সূত্র : সচিত্র বাংলাদেশ, জুলাই-আগস্ট ২০১২, পৃষ্ঠা-২৪) কবির এই লেখার পর বঙ্গবন্ধু সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানকে কখনোই পূর্ব পাকিস্তান বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান সরকার যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবিতা এই ভুখন্ডে নিষিদ্ধ করেছিল, একইভাবে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছুরিকাঘাত করতে পাকিস্তান শাসকরা দ্বিধা করেনি। নজরুলের কবিতায়মহাশ্মশানশব্দটি বদলে দিয়েগোরস্তানশব্দে প্রতিস্থাপন করে। এই মহান কবির স্বভাব আদর্শ বঙ্গবন্ধুকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছিল যে, কবি নজরুলের একটি কবিতার অংশজয় বাংলাশব্দটি তিনি মুক্তিযুদ্ধের জ্বালাময়ী স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসার সমস্ত ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পত্র লেখেন, ‘মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি।’ (সূত্র : সংবাদ, ২১ মে ১৯৭২) ব্যাপারে . আতিউর রহমান তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থবঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ভাবনা ১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে কবি আসলেন ঢাকায়। অবিরাম পুষ্প অর্পণের মাঝে কবি বাংলাদেশে পদার্পণ করলেন। কবি বঙ্গবন্ধুর মাঝে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হলো। বাঙালির এই দুই বিদ্রোহীর মিলনক্ষণটি ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল এক অধ্যায় হিসেবে এরই মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

দৈনিক বাংলা ১৯৭২-এর ২৫ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ, ‘গণভবন থেকে কাজ সেরে গতকাল বিকেল আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু গেলেন তাঁর ধানমন্ডি বাড়িতে। বাড়ি গিয়ে তিনি বুকশেলফ থেকে বের করলেন কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ সঞ্চিতা। আবেগ আর উচ্ছ্বাস জড়িয়ে আবৃত্তি করলেনবিদ্রোহীকবিতা। তারপরমহাবিদ্রোহী রণকান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত’- চরণ দুটি আবৃত্তি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলেন। তাঁর বাড়ি থেকে আটাশ নম্বর কবির বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত সারাটা পথ আবৃত্তি করলেন কবিতার সেই চরণ দুটি। হাতে তাঁর পুষ্প নৈব্য।.... বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধাভরে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। পরম স্নেহে বারবার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কবির মাথায়, পিঠে, সর্বাঙ্গে। নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে কি যেন বললেন বঙ্গবন্ধুকে। বাকশক্তিহীন সেই মুখের ভাষা বুঝা গেল না।বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলকে দেশে এনেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। ওই দিন কবির সঙ্গে এসেছিলেন সস্ত্রীক দুই পুত্র সব্যসাচী অনিরুদ্ধ এবং কবির দুই নাতনি খিলখিল কাজী মিষ্টি কাজী। ওইদিন তেজগাঁও বিমান বন্দরে এক জনতার বিশাল অংশ বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে সংবর্ধনা জানালো। সেইদিন ঢাকা ছিল উৎসবমুখর।

বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে কবিকে চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। প্রতিদিন তাঁকে গান শোনানোর জন্য ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এই সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ১৯ তারিখ ছিল কবিতা বিষয়ক আলোচনা। ওইদিন কবিকে মঞ্চে আনা হয়েছিলপ্রধান অতিথি হিসেবে। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। একই বছরে তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই কবির শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কবিকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে তিনি ছিলেন এক বছরেরও বেশি সময়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি মৃত্যুবরণ করেন।

কবি নজরুলের ভাবাদর্শের বঙ্গবন্ধু তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কবির জন্য নিবেদিত ছিলেন। যেন এক মহাময়ী শ্রষ্ঠা প্রদত্ত ভালোবাসার নিদর্শন। উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন ২৯ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুবরণ করেন ১৫ আগস্ট। অপরদিকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম দিবস ২৪ মে, বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে চলতি বছরের ২৩ মে। আধ্যাত্মিক মহামিলন প্রমাণ করে, ‘বঙ্গবন্ধুর কবি নজরুল’, ‘কবি নজরুলের বঙ্গবন্ধু

১৯৭৭ সালে ঢাকার ময়মনসিংহ সড়কের নামকরণ করা হয়, ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডি কবি ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়নজরুল ইনস্টিটিউট

কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেখানে শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ব্যথিত হৃদয়ের বিদ্রোহের প্রবাহ ঢেলেছেন, কাব্যে কিংবা প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত পরাধীন জাতির মুক্তির আহ্বান রেখেছিলেন বজ্রকণ্ঠে। যার ডাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত-স্বাধীন দেশ পেয়েছে গোটা বাঙালি জাতি।

 

×