
.
প্রতিটি বই এক একটা ইতিহাস। বই মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। আলোর পথ দেখায়। মূর্খ আর জ্ঞানীর পার্থক্য হয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। জ্ঞান অর্জনের জন্য অন্যতম মাধ্যম হলো বই।
মানুষের মুখের কথাটাই বই আকার ধারণ করেছে।
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। (ওমর খৈয়াম)। ওমর খৈয়ামের এই উক্তি বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় বইয়ের আসল কাহিনী। পৃথিবীর শুরু লগ্নে থেকে মুখে মুখে চলে জ্ঞানচর্চা। কিন্তু দেখা গেল মানুষ চলে যায়। সব কিছু শেষ হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবান কথা, উক্তিগুলো ভুলে যায়। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছানো যায় না।
এক সময় মানুষ চামড়ায়, পাতায়, পাথরে অঙ্কন করে লিখে রাখা শুরু করে। ১০৫ খ্রি: এসে মোম দিয়ে বানানো সমতলে আর কাগজে লেখা বসেছে। অতঃপর লেখার সঙ্গে ছবি যুক্ত হতে হতে ৬০০ খ্রি: লেগে যায়। এই বইয়ের মাধ্যমেই মানুষের অন্তরের চিন্তা ভাবনা, কথাগুলো পৌঁছানো শুরু হয়।
সেজন্যই ওমর খৈয়াম বলেছেন, বইখানা অনন্ত- যৌবনা। সে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে।
উক্তির শেষ অংশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, বই অনন্ত যৌবনা হবে- যদি ভালো বই হয়। একটি বই তখনই যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে যখন বইটি ভালো হবে।
আগেকার লেখকরা যত না বই লিখে গেছে তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি পড়ত। আর এখন আমরা অধ্যয়ন না করেই লেখা শুরু করে দেই। এ যেন হাত না বাড়িয়েই চাঁদ ছুঁতে চাই। যার কারণে স্থায়িত্ব হয় না লেখা।
কব আল মাহমুদ বলেছেন, আমি এক পৃষ্ঠা লেখার জন্য একশত পৃষ্ঠা পড়তে সক্ষম। এতেই বুঝা যায় লেখার জন্য পড়া কত গুরুত্বপূর্ণ।
এই কথাটা সবাই শুনেছি, যতই পড়িবে ততই শিখিবে। কিন্তু এখন উল্টো হয়ে যাচ্ছে যতই লিখিবে ততই শিখিবে। তবে হ্যাঁ শেখা যায় কিন্তু পড়ে- লিখলে শেখাটা বেশি ভালো ও মজবুত হয়। এবং স্থায়িত্ব লাভ করে। অনন্ত যৌবনা হয়ে থাকবে। এজন্যই ‘দেকার্তে’ বলেছেন, ‘ভালো বই পড়া যেন গত শতকের মহৎ লোকের সঙ্গে আলাপ করার মতো।’ (দেকার্তে)।
ভালো বইয়ের মূল্য আছে। দামের কথা বললে ‘বে সাম’ এর কথা বলতেই হবে। উত্তর আমেরিকার “বে সাম বইটি ১৬৪০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি ২০১৩ সালে নিলামে উঠলে এক কপিই বিক্রি হয় ৪২.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
বই কি মানুষ আসলেই পড়ে? আর পড়লেও এর ভিতর এমন কী আছে তার কারণে মানুষ পড়ে। বলতে গেলে মানুষ যা জানতে চায় বা পছন্দ করে, তা-ও যেমন বইয়ে থাকে, আবার যা জানবে বলে ভাবেনি, তা-ও থাকে- যা পড়ে সে চমকে উঠতে পারে। চমকে উঠতে পারে বইয়ে পরিবেশিত তথ্য বা পরিবেশনার বৈচিত্র্যের কারণে। কিংবা বইটির মাধ্যমে অজানা জীবনের অলিগলিতে অবলীলায় হেঁটে আসার কারণে।
বই মানুষ এখনো পড়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ আমেরিকান বই পড়ে আর তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পড়ে কাগুজের বই। প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্ট দিনে গড়ে একটা করে বই পড়তেন।
কিংস্টোন বিশ্ববিদ্যালয় জানায় যে যারা কল্পকাহিনী পড়ে, তারা সমাজের অন্য মানুষদের তুলনায় বেশি আবেগপ্রবণ, সহানুভূতিশীল ও উদার মানসিকতার অধিকারী হয়ে থাকে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাদের ইতিবাচক চালচলন দেখতে পাওয়া যায়। এ রকম ধারণা সত্য হতেই পারে। কারণ, সম্ভবত একটি বই একজন মানুষকে আমূল বদলে দিতে সক্ষম। কালজয়ী দীর্ঘ উপন্যাস কিংবা চাঞ্চল্যকর তথ্যসমৃদ্ধ বই পড়তে শুরু করার মুহূর্তের মানুষটি আর শেষ পাতা পড়ে নিয়ে বন্ধ করে রাখা পাঠক কিছুতেই এক মানুষ নন। তিনি হয়তো জানেন না পাতার পর পাতা তাঁকে ভেতরে– ভেতরে নতুন করে সাজিয়েছে। কেবল ব্যক্তিগত পরিশোধন নয়, সমগ্র মানবজাতির উন্নয়নের জন্যও বইকে দায়ী করা যেতে পারে, যেমন জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪, স্টিফেন হকিংয়ের আ ব্রিফ হিস্ট্রি অবটাইম কিংবা কার্ল মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলসের দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-এ রকম বই কখনো বদলেছে আমূল সমাজ, কখনো প্রযুক্তি বদলে প্রবর্তন করেছে নতুন জীবনপদ্ধতি। অন্যদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পাঠের অভ্যাস মানুষকে দীর্ঘজীবী করে, মানসিক চাপ আর আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমায়।
বই মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা আবশ্যকীয় সেটা ‘টলস্টয়’-এর কথা দ্বারাই বুঝা যায়। তিনি বলেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই’ (টলস্টয়)।
বই হলো মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যার সঙ্গে কখনো মনোমালিন্য হয়নি, হবেও না। জীবনের সকল দিক খুঁজে নিতে পারি বইয়ের পাতায় পাতায়।
এইচ এন মিজানুর রহমান
মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর, বরিশা।