
ক্রিসমাসের দিন।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ক্রিসমাস ডে
ক্রিসমাসের দিন। যেদিন আমি প্রি রনোদ্যোঁ সাহিত্য পুরস্কার পেলাম, তাকে দেখতে গেলে নার্সরা আমাকে বলল, আমার মা তাদেরকে বলেছে- ‘আমার মেয়েটা দারুণ সুন্দর করে কথা বলতে পারে’। ‘ও ভালো লিখতেও পারে’। তিনি নাকি আরো বলেছেন, ‘যদি ওর বাবা আজ বেঁচে থাকতেন আর এটা জানতে পারতেন! তাহলে সব্বাইকে এটা বলে বেড়াতেন তিনি’। ‘ওর বাবা ওকে খুব আদর করতেন, ওর যেকোনো কিছুই খুব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন’।
আজ আমি যখন তার হাতের নখগুলো কেটে দিচ্ছিলাম, ব্যথা পেয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। যদিও আমি তাকে কোনো প্রকার ব্যথা না দিয়ে খুব যতেœর সঙ্গে এই কাজটি করার চেষ্টা করি, তবুও আমার মধ্যে যেন কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে, আমার শুধু বারবার মনে হয়, অতীতে তিনি আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করতেন, সেই ভয়াল স্মৃতির ঘাই আমার ভেতরটাতে প্রতিধ্বনি করে ভারী করে তোলে। তিনি কি এখনো আমাকে ঘৃণা করেন? আমার মনে হয়, তিনি এখনো আমাকে অপছন্দ করেন।
তার সেই কথাটা আমার বারবার মনে হয়, আজো মনে পড়ল, তিনি বলতেন- ‘আমি কখনোই কারো কাছ থেকে কিছু চাইনি। জীবনে আমি কোনোদিন কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাইনি’।
সোমবার ৩১
তিনি আজ বললেন, ‘তারা আমাকে এখন থেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলে না। আমার মনে হয়, এখান থেকে কখনোই বের হতে পারব না। হয়ত আমি এখানেই থেকে যাবো...’। এই বলে তিনি একটু থেমে রইলেন কিন্তু বাকি কথাটুকু আর উচ্চারণ করলেন না- ‘যতদিন না আমি মরে যাচ্ছি’। আমার মরে যাওয়া পর্যন্ত আমাকে এখানেই থেকে যেতে হবে- এটা হচ্ছে মূল অর্থ বা মূলকথা, যা তিনি আর উচ্চারণ করলেন না। তার এই ভাবনা আমার মনটাকে খান খান করে ভেঙ্গে দিল। তিনি তো এখনো বেঁচে আছেন। তার এখনো অনেক ইচ্ছে পূরণ হওয়া বাকি আছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি শুধু চাইছেন বাঁচতে। এবং আমি চাই তিনি বেঁচে থাকুন। একটু পর বসে থাকার এই পর্যায়ে তিনি বললেন- ‘ক্লদ কখনোই তার মাকে দেখতে গেল না। ওর মা তো খুব বেশি দূরে থাকে না। তোর খালা তো এই সেইন্ট মেরিতেই থাকে”। একটু পর থেমে আবার বললেন, ‘ক্লদকে না দেখলে ওর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগে’। এই সমীকরণটি আমাকে একটা অপরাধবোধে পূর্ণ করে- ক্লদ যোগ আমি আমরা দুজন। ক্লদ হলো আমার খালা ম্যারি লুইসের একমাত্র ছেলে। মা আর ছেলে দুজনই মদ্যপ ছিল। এখন দুজনই মৃত।
আজকে সকালে ল্য মন্দঁ পত্রিকায় মাতৃত্ব ও বন্ধ্যত্বের উপর একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম, যার সারমর্ম হলো, মাতৃত্বের প্রবৃত্তি মৃত্যু কামনার সমতুল্য।
১৯৮৫, জানুয়ারি, রবিবার ৬
নববর্ষের দিনে আমার মা এবং অন্য রোগীদের হাসপাতালের গাউন ছেড়ে তাদের আগের পোশাকগুলো পরতে দেওয়া হয়েছিল, প্রত্যেকে একটি স্কার্ট আর একটি ব্লাউজ। এরপর তাদের দেওয়া হলো এক গ্লাস করে শ্যাম্পেইন। বাস্তবজীবনের মিথ্যে ভান। আমি সেই সকালটি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, নার্সরা তাদের বিছানাগুলো ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। ড্রয়ার ঘেঁটে আগের জীবনের জামা কাপড়গুলো খুঁজে তদের জীর্ণ ক্লান্ত অসুস্থ শরীরে পরিয়ে দিচ্ছে। এরপর চিৎকার করে বলছে- “শুভ নববর্ষ! চলো উদ্যাপন করি। এসো দাদী মা”।
সারাদিন ধরে,তারা সবাই মিলে মজা করার ভান করত। বুড়ো মহিলাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন এই উদ্যাপনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। অথচ অপেক্ষা করার কিছু নেই। সন্ধ্যায় ফিরে এসো, আগের জীবনের স্কার্ট আর ব্লাউজ খুলে যার যার গাউন পরে বিছানায় শুয়ে পড়ো। যেন তারা এক একটি শিশু, একটি ভান করা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য এইসব পোশাক পরেছিল। কিন্তু এইসব তো তাদের অতীত জীবনে ঘটত এবং আগামীতে তাদের সামনে বাস্তবিকই আর কোনো উদ্যাপন নেই, অনুষ্ঠান নেই। তাদের জীবনটাও আর বাস্তবে নেই।
আমার মা, তিনি প্রায়ই বলতেন- ‘তোমাকে বাঁচতে হলে লড়াই করতে হবে’ এবং এছাড়াও আরেকটি কথা ছিল- ‘তুমি যদি শক্তিশালী না হতে পারো, তবে তোমাকে অবশ্যই স্মার্ট হতে হবে’। জীবনের সবকিছুই যেন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেখা, সংগ্রামের দৃষ্টিতে দেখা। আমি তার অতীতকালের কথা ভাবছি। অতীতের তার কথা বলছি। আজ যে মহিলাটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সেই একই মানুষ যাকে আমি অতীতে চিনতাম। এটা খুবই ভয়ানক একটা ব্যাপার ছিল।
শনিবার ১৯
তার সমস্ত শক্তি যেন খাওয়ার চেষ্টার মধ্যেই চলে যাচ্ছে। খুব লোলুপ হয়ে ক্ষুধার্তের মতন সবকিছু খাবার খেতে থাকেন।
জানুয়ারির শুরুর দিকে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম- যেখানে আমি একটি নদীতে শুয়ে আছি, দুটো স্রোতের মাঝামাঝি আটকা পড়েছি, আমার নিচে লতাপাতা গুল্ম ভেসে যাচ্ছে, আমার পাঁজরা থেকে নিতম্বের হাড় পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেইসব পাতলা তৃণলতাপাতার দল। আমার পশ্চাদ্ভাগ ছিল সফেদ; আমার ধারণা, আমার মায়ের শরীরটাও একই রকমের দেখতে, কিন্তু আমি কি কখনো এটিকে সেভাবে খুটিয়ে বিশ্লেষণ করার সাহস করতে পারবো?
কে গান গাইছে? একজন মহিলা রোগী বারবার একই প্রশ্ন করতে থাকে। এখানে একজনই সারাক্ষণ গান গাইছে, বাকিরা শুধু শুনছে। একজনই শুধু জীবনের গান গাইছে। যেন গাইছে তার জীবন। সবাই তাকে প্রতিদিন শুনে যাচ্ছে আনমনে।
ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১
আমি যখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ল্য গ্যালেরি লাফায়েতে প্রবেশ করি, একজন মহিলার সঙ্গে আমার দৃষ্টিবিনিময় হলে মনে হলো তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে এলাম, তবুও তার দিকে একবার তাকালাম আর সেও আমাকে একই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল। তার ছিল নীল ধূসর চোখ। পরে আমার মনে হলো, এটি তো আমার মা-ই ছিল, তিনি তো আমাকে সবসময় এভাবেই দেখতেন। আমার ভেতরটা এখন আবার অপরাধবোধের আলোড়ন আর উত্তেজনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
শনিবার ২
আমি আমার প্রেমিক ‘এ’ এর সঙ্গে ভালোবাসাবাসিতে খুব ডুবেছিলাম এতদিন, আর এভাবেই প্রায় একটা বছর উড়ে গেল আর ভুলে গেছিলাম আমার দায়িত্বের কথা, কিন্তু যেদিন হুঁশ এলো মাকে দেখতে গেলাম। যেয়ে দেখি তাকে আর্মচেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখে তিনি খুব নরম গলায় বললেন- “আমার মনে হয়েছিল তুই আর আমাকে দেখতে আসবি না”।
আমি মায়ের বাঁধনটা আলগোছে খুলে দিলাম। দুজনে মিলে করিডোর ধরে এমাথা-ওমাথা হাঁটাহাঁটি করলাম। এরপর উপরতলায় হেঁটে এলাম। নিচেও ঘুরে এলাম। ফিরে আসার সময়ে মাকে আবার আগের মতন বেঁধে রেখে এলাম নার্সের নির্দেশমতো। আমাদের যে আর কোনো বিকল্প ছিল না- ওই যেভাবে আমার বাচ্চাদের স্ট্রলারে বেঁধে রাখি, সেভাবে মাকেও বেঁধে রাখতে হলো। ফিরে আসার সময়ে বারবার মনে পড়ছিল আমার মায়ের পুরনো একটি কথা- “যাই করো না কেন, জীবন তো একটাই। খাও দাও। কেনাকাটা করো। মজা নাও। আর ফুর্তি করে কাটাও”। কিন্তু আমি তো ভাবি, এই জীবন থেকে আমাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
শনিবার ১৬
তিনি করিডোরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার উপস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞাত, দেখলাম করিডোরের রেলিংটি ধরে আনমনে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন রেলিংটিকে অনুভব করছিলেন। একটু পরে আমরা রুমে প্রবেশ করি। তিনি তার রুমমেটের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্রগুলোর ভেতর থেকে নিজের জিনিসগুলো খুঁজতে লাগলেন। এটি অন্য একটি মহিলা, এই হাসপাতালে ফিরে আসার পরে তার চতুর্থতম রুমমেট। তাদের পায়খানার মেঝেটা আঠালো, শুকনো প্রস্রাবের দাগ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এটা খুবই অসহ্য ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ, সহ্য করা যায় না। বিদায়ের সময় আমি তাকে ডাইনিংরুমে (এখানে লিখতে যাচ্ছিলাম- আমার বোর্ডিং স্কুলের মতন ভোজনকক্ষে) পৌঁছে দিয়েছিলাম। একজন প্রফুল্ল হাসিমুখের নার্স তার হাতে একটি মিষ্টি ধরিয়ে দিয়ে বলল- “নিন, এটা খেয়ে দেখুন। খুব মজার খেতে। এটা আপনাকে আনন্দ দেবে’। আহা! কি চমৎকার সহানুভূতি।
কয়েকদিন আগে লিলির ললিতকলা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। সুন্দর বাতাবরণের মননশীল পরিবেশে প্রতিটি কক্ষে একজন করে প্রহরী বসে আছে। আমার কাছে এই প্রহরীগুলোকে পাগল, উন্মাদ বলে মনে হয়। তারা কেমন সেখানে নিজেদের মতন করে কাটায়, কথা বলার মতন কিছুই তো নেই ওদের। ফ্রান্তিসকো গইয়ার আঁকা ‘টাইম এন্ড ওল্ড ওমেন’ চিত্রকর্মটি দেখলাম। কিন্তু এটি ঠিক আমার জন্য নয়। এমন কি অন্য একরাতে যখন নাট্যকার লোলাহ বেলেনের নাটক ‘টেন্ডার রিলেশন’ দেখলাম, সে নাটকের প্রধান চরিত্রটিও যেন ঠিক আমার মনে ধরেনি।
আমার মনে পড়ছে, আমার মা মেনোপজের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই বছর- যে বছর তার নিজের মা, আমার নানী মারা যান। সেই ভয়ংকর রবিবার আসার ঠিক একমাস বা দুই সপ্তাহ আগে এইটি ঘটেছিল। সেই রবিবার, সম্ভবত জুনের পনের তারিখ, ১৯৫২ সাল। কি করে ভুলি? যতদূর সম্ভব মনে পড়ছে- জুনের পঁচিশ তারিখ, তিনি ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে এলে আমার বাবা, আমার মায়ের সম্ভাব্য গর্ভাবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “তাহলে সম্ভবত আমরা শেষবারের মতো দীক্ষা অনুষ্ঠান উদ্যাপন করছি না”।
কিন্তু আমার মা, তিনিই জানতেন শুধু আসলে কি ঘটছে। তিনি বলেছিলেন- নাহ!
চলবে...