ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

বাঙালি আবেগের বৃহৎ উৎসব

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাঙালি আবেগের বৃহৎ উৎসব

অমর একুশে বইমেলা

অমর একুশে বইমেলা আমাদের আবেগ-অনুভূতি ও অস্তিত্বের সংমিশ্রণে গড়া বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে এই উৎসব আলো ছড়াবে মানুষের হৃদয়ে। তাই তো ‘পড়ো বই, গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’Ñপ্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে এবারের অমর একুশে বইমেলা। শুধু তা-ই নয়, অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের আত্মার মহামিলন ঘটানোর বৃহৎ উৎসব।
এবারের বইমেলা ঘিরে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কেননা বইমেলা শুরুর আগেই শোনা গিয়েছিল, অন্য বছরের চেয়ে এবার কম প্রস্তুতি নিচ্ছেন লেখক-প্রকাশকরা। কারণ প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট উপকরণের দাম বাড়ায় হতাশ হয়েছিলেন তারা। ফলে এ বছর বইয়ের দামও হয়েছে দ্বিগুণ। এতে শেষ পর্যন্ত কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বইমেলা শেষ হলে হয়তো তারও একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। বইমেলা শুরু হওয়ার পর এসব নিয়ে এখনও চলছে জল্পনা-কল্পনা।
এ বছর নয়শ’র মতো স্টল নির্মিত হয়েছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন চমক। একটি প্যাভিলিয়নে হয়েছে মুজিব কর্নার। মেলায় দর্শনার্থীদের কেনাকাটা ও চলাচল সহজ করতে ডিজিটাল দিকনির্দেশনাসহ বেশ কিছু পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু চত্বরের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে। এভাবেই প্রতি বছর বাড়ছে মেলার পরিসর, বাড়ছে স্টলের সংখ্যা, বাড়ছে পাঠক ও দর্শক। সেই সঙ্গে বাড়ছে লেখকের সংখ্যাও। আশা করি এ বছর বই বিক্রির সংখ্যাও বাড়বে। বগিত বছরের রেকর্ডকেও অতিক্রম করবে।
প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরেই আশার আলো দেখে দেশের প্রকাশনাশিল্প। আশা করি পাঠক বরাবরের মতোই বইমেলায় আসবেন। নতুন নতুন বই কিনবেন। নতুন বইয়ের দাম একটু বেশি হলেও আগে প্রকাশিত বইগুলো কিনবেন। সব মিলিয়ে বেশকিছু বই তো অবশ্যই বিক্রি হবে। আমার মনে হয়, বইমেলা শেষে ভালো একটি পরিসংখ্যান আমরা পেয়ে যাব। তাতে আমাদের হতাশা কেটে যাবে। নিজের টাকা লগ্নি করে লেখক-প্রকাশকরা অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না। কেননা মেলার শুরু থেকেই কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। 
বইমেলার শুরু থেকেই নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মেতে উঠবেন তারা। শিশু-কিশোরদের মোহিত করবে নতুন বই। এই একটি মাসের জন্যই তো লেখক-পাঠকরা অপেক্ষা করে থাকেন। বই কেনা, আড্ডা, গল্প,  হৈচৈয়ে মুখর হয়ে উঠবে বইমেলা প্রাঙ্গণ। এই বৃহৎ উৎসব এবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। লেখকে-পাঠকে পারস্পরিক ভাব বিনিময় হবে। প্রাণের এই উৎসব মানুষের মাঝে বইপড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। সব রকমের আশঙ্কা নস্যাৎ করে দিয়ে সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে বইমেলা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি উপেক্ষা করেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে।
আশা রাখি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই বইমেলা অতীত গৌরব অক্ষুণœ রেখেই ইতি টানতে পারবে। বই কেনার পাশাপাশি লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে। মানসম্মত বই উপহার দিয়ে পাঠকসমাজকে উপকৃত করবে। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে আয়োজকরা সার্বজনীন মেলা উপহার দিতে পারবে।  
আমাদের মনে রাখতে হবে, বইমেলার জন্য নীতিমালা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সেই নীতিমালা মেনে চলতে হবে। কেউ যেন নীতিমালার বাইরে না যান, সে জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স সদস্যদের জন্য মেলায় করা হয়েছে একটি অফিসও। টাস্কফোর্স নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে এই টাস্কফোর্সের কারণে কারও মুক্তচিন্তার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ফলে আমাদের উচিত বইমেলার শৃঙ্খলা বজায় রাখা। আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা। 
এখনো প্রকাশনা ও লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুতরাং এর থেকে উত্তরণ দরকার। ফলে সচেষ্ট হতে হবে লেখক ও প্রকাশকদের। প্রকাশনার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অতীব জরুরি। লেখক-প্রকাশক উভয়ের আন্তরিক প্রয়াসে দেশের প্রকাশনা জগৎকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে, আমাদের প্রকাশনাশিল্প আগের চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছে। তাই আর একটু যতœবান হলেই সব ভুল দূর করা সম্ভব। যে কারণে লেখার মানের দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। লেখক-প্রকাশকরা নিজেরা যদি সচেতন না হন, তাহলে বাজে বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, কিছু ভালো বই অবশ্যই বের হয়। সুতরাং খারাপ বই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ভালো বই যেন প্রকাশ হয়, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।  
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, লেখালেখিতে বরাবরই তরুণের সংখ্যা বেশি। পরে হয়তো সে সংখ্যাটা কমে আসে। অনেকেই নানাবিধ জটিলতায় পড়ে কাব্য বা সাহিত্যচর্চার মতো অতীব জটিল বিষয়টিকে ধরে রাখতে পারেন না। অনেকে চর্চা ও সাধনার অভাবে খেই হারিয়ে ফেলেন। তারপরও হয়তো এই বহুসংখ্যক লেখক-কবির মধ্য থেকেই আগামীর পথপ্রদর্শক কেউ বেরিয়ে আসবেন। বাংলা সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। বাঙালি জাতি সেই অপেক্ষায়ই আয়োজন করে বইমেলার। ফসলের মাঝে কিছু আগাছা তো থাকবেই। তাই বলে তো আর ফসল ফলানো বন্ধ হয়ে যাবে না। এর জন্য আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে আমি মনে করি, বছরজুড়েই বই প্রকাশ হওয়া দরকার। উন্নত বিশ্বে তো সেটাই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে দুই এক মাসে বই প্রকাশের কর্মযজ্ঞ চলে। এই কম সময়ে তাড়াহুড়োর মাঝে ভালো বই পাঠক বাছাই করতে পারেন না। এর জন্য আরও সময় দরকার। বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনাবহুল পাঠ-প্রতিক্রিয়া দরকার। মেলার এক মাসে হয়তো সে সুযোগ হয় না। হয়তো কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। ব্যবসা আর পরিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রসার কিন্তু এক কথা নয়। তাই প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় শিক্ষিত রুচিশীল সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। এমনকি সারাদেশে প্রচুর ভালো লেখক আছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রকাশনাশিল্পকে বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে কোনো শিল্প শুধু বিত্তশালীর জন্য হতে পারে না। নি¤œবিত্তের জন্যও শিল্প থাকা জরুরি। তাই শিল্পকে উভয় বান্ধব হতে হয়। লেখক-প্রকাশক-পাঠক মিলেই এ শিল্প টিকে আছে। আর প্রকাশনাশিল্পের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে কতগুলো পরিবার। কেননা প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে আশার আলো দেখে প্রকাশনাশিল্প। তাই পাঠক বরাবরের মতোই আসুক বইমেলায়। মন চাইলে বই কিনবে, না চাইলে ঘুরে ঘুরে দেখুক।
বরাবরই বইমেলার প্রথমদিকে একটু ভাটা থাকে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকেই অমর একুশে বইমেলা জমে উঠবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শুধু তা-ই নয়, বইমেলা উপলক্ষে আরও নতুন নতুন বই প্রকাশ হবে। প্রয়োজনে মেলার শেষদিন পর্যন্ত নতুন বই আসুক। লেখক-পাঠকের সম্পর্কটা আরও গভীর হোক। প্রকাশক-লেখক-পাঠকে মুখর হয়ে উঠুক বইমেলা প্রাঙ্গণ। বই আসুক নতুন ঘ্রাণ আর আবেগ নিয়ে। পাঠকের উপস্থিতিতে লেখক-প্রকাশক-আয়োজকদের মুখে হাসি ফুটুক। তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলতে তুলতে তারা মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করুক। পরবর্তী বছরে আরেকটি সার্থক বইমেলার জন্য অপেক্ষা নিয়ে কাটুক আগামী দিনগুলো। জয় হোক বইমেলার। জয় হোক বাংলা একাডেমির। 

×