ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো, অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ২১:১৪, ৫ জানুয়ারি ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

আইয়ুব আল আমিন

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শুক্রবার ২৫
তিনি তার নতুন চশমাটা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ওটা কোথায় রেখেছিলেন? তিনি জবাব দেওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি একটি ঘুমন্ত শিশুকে ছুঁয়ে দেখলাম, জীবনে প্রথমবার। এটা আমার মায়ের শরীর। জানালার বাইরে মে মাস এসে হাজির। মে মাসের সেই শিশির পড়ার দৃশ্য- মনে পড়ে তিনি ফ্লানেলের উপর কিছু শিশির জমিয়ে এনে আমার গালে ঘষে দিতেন যেন আমার ত্বকটা আরেকটু মসৃণ হয়। আমার প্রথম দীক্ষা অনুষ্ঠানে- সেটা মে মাসেই ছিল, তিনি সুন্দর একটা কালো রংয়ের গাউন পরেছিলেন, মাথায় ছিল চওড়া কাঁধওয়ালা একটি হ্যাট, পায়ে ফিতে-তোলা হাইহিল জুতো, “একটি চমৎকার দেখতে মহিলা”। তখন তার বয়েস হবে পঁয়তাল্লিশ। আর আমি এখন তার চেয়ে এক বছরের কম, চুয়াল্লিশ। 
তিনি ঘুুমাচ্ছেন এখনো, চোখ দুুটো খোলা। তার খড়ি ওঠা পা দুুুটো দেখছি, যোনি উন্মুক্ত হয়ে আছে। আমি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলাম। আমার মায়ের পাশের বিছানার মহিলাটা তার বিছানাটা পরিপাটি করে সাজিয়েই যাচ্ছে- একটি কম্বল খুলছে আর ভাঁজ করছে, ভাঁজ করছে আর খুলছে। নারী। চিরাচরিত নারী। 
জুন, রবিবার ৩
তিনি ডাইনিংরুমে ছিলেন। তার উল্টোপাশে বসা মহিলাটিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, ঠোঁটে ছিল বিদ্রƒপের হাসি- এটা ঠিক কৌতূহল আর বিদ্রƒপের মাঝামাঝি কিছু (আমি কখন আর কোথায় তাকে এমনভাবে হাসতে দেখেছিলাম?)। মহিলাটির চোখ দুটো জলে ভেজা, তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনিও আমার মায়ের বিদ্রƒপ করা মুখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে আছেন। এটি একটি দেখার মতই দৃশ্য বটে। আজকে এখানের সব মহিলারাই কেমন যেন উন্মাদ। আমার মায়ের রুমমেটদের একজন, চিৎকার করছে- ‘এই! কেউ আমাকে মাখন-রুটি দাও’। আরেকজন মহিলা বিড়বিড় করতে করতে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অদ্ভুত ঘোরগ্রস্ত পাগলের দল। যেন যাদুটোনা ভর করেছে সবার উপর। 
বৃহস্পতিবার ৭
প্রতি সপ্তাহে যখনই আসি- আমার দিনগুলো যেন এখানেই শেষ হয়। তিনি এখনো আমার শাশুড়িকে প্রচ- হিংসা করেন। আজ বললেন, “এটা যদি রেম-ের মা হতো ( তিনি সম্ভবত বোঝাতে চাইলেন আমার স্বামী ফিলিপের মা), আমি নিশ্চিত যে- বাড়িতে তার জন্য একটি রুমের ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতি তোরা’। আমার মায়ের রুমমেট- উল্টোদিকের বিছানার ওই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলেই আমার ভয় লাগে। যখনই আমি ঘরে ঢুকলাম, তিনি আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন, “আমি পায়খানা করব”। আমি তাকে সেখানে নিয়ে গেলাম। যখন তিনি বেরিয়ে এলেন- আবার চিৎকার শুরু করলেন, আর তার হাতের ডায়াপারটি উড়িয়ে দেখাতে লাগলেন, জেদ ধরলেন- আমি যেন এটা তাকে পরিয়ে দিই। সে যা চাইলো আমি তাই করলাম। তার নাক দিয়ে সর্দি বের হচ্ছে, তাই নাকটিও পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমার মা বসে বসে দেখছিলেন সব আর বললেন, “এই মহিলাটা অসম্ভব! তার নিজেরই তো তিনটি ছেলেমেয়ে আছে। তারপরেও সে এমন করে”। 
শুক্রবার ১৫
আজ আমি যখন পৌঁছালাম, তিনি লিফটের কাছে বসেছিলেন। তাকে দেখে খুবই ক্ষিপ্ত মনে হলো। আমার দিকে তাকালেন, খুব নিঃশব্দে কিছু কথা বললেন, যার কিছুই আমি শুনতে পারলাম না, তাই বুঝতেও পারলাম না। আমরা দুজন করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলাম। তিনি আজ কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন আর মেঝেতে হাতের বিস্কুটটা গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলেন। আমার খুব কান্না পেল যখন আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাকে তার কতটা প্রয়োজন আর আমি কোনোভাবেই তার চাহিদাটুকু পূরণ করতে পারছি না (আমার মনে পড়ছে ছোটবেলায় আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম) আর এখন আমি আমার সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসি আমার প্রেমিক ‘এ’ কে, যখন এই সময়ে ও আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। 
বিদায় নিয়ে যখন আমি লিফটের কাছে যাই নিচতলায় নামতে- পিছুপিছু লিফটের সামনে এসে তিনি দাঁড়ালেন, লিফটে আমার মুখোমুখি, তাকে দেখতে ফ্রেমে বাঁধাই করা একটি ছবির মতো মনে হয়, লিফটের দরজা দুটো যখন টেনে দিই আপতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে- চোখের সামনে থেকে তাকে যেন আমি ধাক্কা মেরে মুছে দিচ্ছি। 
প্রতিবার সেই একই রকমের দেখা-সাক্ষাৎ, বারবার আর একঘেয়ে, আমরা দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে থাকি, দুুই একটি কথা বলি, আধো আধো বোলে, সতর্কভাবে, অল্পকিছু শব্দগুচ্ছ। এই হাসপাতালের সবরোগীকেই আমি চিনি। ফেরার পথে দেখলাম, একজন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারী রোগী তার অহংকারী হাবভাব নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে করিডোরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে হাঁটাহাঁটি করছে। উনাকে দেখে আমার র‌্যাভেল অপেরার ভাঙ্গা ঘড়িটার কথা মনে পড়ে গেল, ‘ দ্য চাইল্ড অ্যান্ড দ্য এনচেনমেন্টস’ । আজ আমি লক্ষ্য করলাম ষাটোর্ধ্ব একজন লোককে, যিনি মনে হলো তার স্বামী হতে পারেন। লোকটার চোখ ছিল লাল, নেভি স্যুট পরা। 
বের হয়ে আসছি যখন- শুনলাম একজন নার্স ফোনে উচ্চস্বরে কাউকে জিজ্ঞেস করছে, “আজ কেউ কী মরতে যাচ্ছে নাকি?”
শনিবার ২৩
হাসপাতালের নিচের তলায় হলরুমে পাজামা পরা এক বৃদ্ধ লোক সবসময় ফোন করতে ব্যস্ত। অন্যএকদিন তিনি আমাকে টেলিফোন নম্বরসহ একটি কাগজ দিলেন। বললেন- আমি যেন একটু ফোন করি। আমি তার কথামতো ফোন করলাম । কিন্তু নাম্বারটা ছিল ভুল। তিনি সারাদিন কাউকে না কাউকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেন। হতে পারে তার ছেলেমেয়ে বা কোনো একটি সংস্থা। আশা। একমাত্র আশাই মানুষকে প্রতিদিন এভাবে বাঁচিয়ে রাখে। 
আমার মায়ের রুমমেট পাশের বিছানার মহিলাটির নাক থেকে ক্রমাগত সর্দি ঝরছে, সর্দিতে জামাটা ভিজে নোংরা, একাকার। কিন্তু আমার মা চরম এক উদাসীনতায় ডুবে ছিলেন। তিনি এসবের কিছুই লক্ষ্য করেননি, নিজেকে অন্য মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তার সমস্ত ব্যক্তিগত জিনিস এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছেন। তিনি একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আমার মনে পড়ল- সেইদিনগুলোর কথা, যখন আমার বাড়িতে ছিলেন, কত আগ্রহ নিয়েই না তিনি তার জিনিসপত্র, প্রসাধনীর ব্যাগটা খুঁজতেন তিনি; সারাক্ষণ কাছে কাছে রাখতেন এগুলো। এক সময় তার যা যা ছিল, তার সবই এখন হারিয়ে গেছে। চলে গেছে । তার সেই প্রিয় ঘড়িটা এবং সেই ওডিকোলনটাও হাওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু খাবারটুকুই তার জন্য পড়ে আছে। 
হাসপাতালে এখানে প্রতিবার এলে আমি সবসময় সেই একই পরিদর্শনকারীদের দেখি। 
জুলাই, বৃহস্পতিবার ১২
স্পেন থেকে ফিরে এসে তাকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। আমাকে ডাইনিংহলের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে তিনি খাবারের টেবিল ছেড়ে ধুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালেন (তাকে এভাবে উঠতে দেখে আমার বোর্ডিং স্কুলের সেই ছুটির দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন বন্ধ স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আর যখনই সিঁড়িতে তার ছায়া দেখতে পেলাম, আমি লাফিয়ে নেচে উঠেছিলাম। এখনেও যেন সেই একই রকমের উত্তেজনা)। এখন তিনি উঠে দাঁড়িয়েই খুব গর্বের সঙ্গে বললেন, “ওই তো আমার মেয়ে আসছে”। “আমার মেয়ে”। মায়ের পাশে বসে থাকা অন্যান্য মহিলারা মায়ের কথা শুনে আমাকে দ্যাখে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “কি যে সুন্দর দেখতে তোমার মেয়েটা!” আমি তার আনন্দটুকু টের পাচ্ছি। চারপাশের মানুষের বলা থেকে তার গর্বটুকুও অনুভব করতে পারছি।

নিচেরতলায় নেমে আমরা হাসপাতালের বাগানে গেলাম। সেখানে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। হঠাৎ মনে পড়েছে আমার বয়েস যখন দশ ছিল, ঠিক এমনই একটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে আমি তার সঙ্গে আমার এক অসুস্থ মামাকে দেখতে রুয়নের হোটেল ডিউ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। মামা মূত্রথলি অস্ত্রপচারের রোগী ছিলেন, তিনি অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে সেরে উঠছিলেন। এটা ছিল হোটেল ডিউয়ের ভেতরে একটি হাসপাতাল; সুন্দর আর প্রখর সূর্যতাপে উজ্জ্বল একটি দিন; সেখানে নারী ও পুরুষরা মেরুন রংয়ের বাথরোব পরে এদিকে সেদিকে হাঁটছে। শুরুতে আমার কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও পরে খুব ভালো লাগছিল। কারণ, আমার মায়ের সঙ্গে এসেছি। আমার মা খুব সুন্দরী দেখতে, সুস্থ, সবল শরীরের একজন নারী, যিনি রোগবালাই আর মৃত্যুর হাত থেকে বহু বহু দূরে আছেন। (চলবে...)

×