লিট ফেস্টের অনুষ্ঠান
মিলনায়তনে চলছে সাহিত্যের আলোচনা। দেশ-বিদেশের লেখকরা বলছেন তাদের সৃষ্টিশীল জীবনের অভিজ্ঞতা। সেসবের সঙ্গে উঠে আসছে জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকারিসহ বৈশ্বিক নানা বিষয়। মঞ্চে হচ্ছে বিবিধ বিষয়খ আলাপ।
উঠে আসছে গল্প-উপন্যাস বিষয়ে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের ভাবনা। সকালের আলোচনা শেষে সন্ধ্যার অবকাশে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত লনে ভেসে বেড়াচ্ছে যাত্রাপালার সংলাপ। তাঁবুতে দেখানো হচ্ছে চলচ্চিত্র। আবার কোনো মঞ্চে চলছে কবিদের স্বরচিত কবিতাপাঠ।
এছাড়া উৎসবের চারপাশজুড়ে রকমারি বইয়ের সম্ভার নিয়ে ছড়িয়ে আছে বুক স্টল। এভাবেই বৈচিত্র্যময়তার আলিঙ্গনে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হলো ঢাকা লিট ফেস্ট। বৈশ্বিক সাহিত্যের এই আসরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা একাডেমির বিশাল আঙিনা জুড়ে।
মহামারির ধকল কাটিয়ে তিন বছরের বিরতি ভেঙে সূচনা হলো লিট ফেস্টের দশম সংস্করণের। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত উৎসবটিতে অংশ নিচ্ছেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। টিকিট কেটে শ্রোতা-দর্শকে আসবে কিনা-এমন ভাবনা ভেঙে দিয়ে প্রথম দিনেই বর্ণিল হয়ে ওঠে চারদিনের এই সাহিত্য উৎসব।
সাহিত্য অনুরাগীশিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক কিংবা চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণী মানুষের দেখা মিলেছে লিট ফেস্টে।তারা শামিল হচ্ছেন ভাবনা ও জ্ঞানের আদান-প্রদানে দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক ও চিন্তাবিদদের এই মিলনমেলায়।
বৃহস্পতিবার পৌসের সকালে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে মনিপুরী নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় এবারের উৎসবের উদ্বোধন হয়। উৎসব উদ্বোধন করেন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ, ভারতীয় লেখক ও সাহিত্যিক সমালোচক অমিতাভ ঘোষ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের তিন পরিচালক ড. কাজী আনিস আহমেদ, সাদাফ সায ও আহসান আকবর।
নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুল রাজাক গুরনাহ বলেন, আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছি। আমি ধারণা করছি এই আয়োজনের মাধ্যমে এমন কিছু দেখবো যা আমি জীবনেও দেখিনি। আমি মনে করি এই আয়োজনের শুরুটা বেশ চমকপ্রদ ছিল।
অমিতাভ ঘোষ বলেন, এরকম একটা আয়োজনে এসে আমি সম্মানিত বোধ করছি। একইসঙ্গে ভালোও লাগছে। কারণ, বাবা-মায়ের সূত্রে আমার জন্মগত উৎপত্তি এই বাংলাদেশে। তাই আমি সব সময় বাংলাদেশের কথা বলি। এছাড়া বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে আঞ্চলিক লিডার, জিডিপিও বেশ ভালো। বিভিন্ন আর্থ-সাসাজিক সূচকে ভালো করছে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে সেলিব্রেট করার অনেক কিছু আছে। এসময় তিনি বাংলায় সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
লিট ফেস্টের পরিচালক ড. কাজী আনিস আহমেদ বলেন, মহামারিতে আমরা অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি। আমি তাদের স্মরণ করি। একজন লেখক যেমন নিভৃতে লিখেন তেমনি একজন বিজ্ঞানী আইসলেশনে কাজ করেন। এখানে যারা উপস্থিত থেকে অংশ নিচ্ছেন তারা অনেক মূল্যবান। এখানে অনেক আলোচনা, বিতর্ক এবং সৃজনশীলতার স্ফুলিঙ্গ দেখা যাবে।
লিট ফেস্টের প্রযোজক ও পরিচালক সাদাফ সায বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই আয়োজন হয়ে আসছে। বিগত বছরগুলোতে নানা চ্যালেঞ্জ এবং বন্ধুদের সহযোগিতায় আজ আমরা এখানে। মহামারি আমাদের একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। মহামারি আমাদের শিখিয়েছে যে আমাদের একে অপরের কত প্রয়োজন। আজকে আমরা উৎসব পালন করছি এই জায়গায়। উন্মুক্ত মন আগামী চারদিন নানা আয়োজন উপভোগ করতে পারবে। আমাদের সঙ্গে বিশ্বের নামকরা লেখকরা অংশ নেওয়ায় আমরা সম্মানিত বোধ করছি।
লিট ফেস্টের আরেক পরিচালক আহসান আকবার বলেন, আমরা জানিনা আমাদের ভবিষ্যৎ কী, কিন্তু আমরা সেটি সাজাতে পারি। আগামী চারদিন ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজনে আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখব।
আয়োজকরা জানান, এবারের চার দিনের এই আয়োজনে থাকবে কথোপকথনের একটি বৈচিত্র্যময় মিশ্রণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সেশন, শিশু ও তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় আয়োজন, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাট্য, সংগীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
এদিন ‘টর্ন এপার্ট’ শিরোনামে সেশনে কথা বলেন, সোমালিয়ান ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন ফারাহ, বুকারজয়ী শ্রীলঙ্কান ঔপন্যাসিক শিহান কারুণাতিলাকা এবং বুকারজয়ী ভারতীয় ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলি শ্রী। আলোচনাটি সঞ্চালনা করেছেন বারবারা এপলার। নুরুদ্দিন ফারাহ বলেন, ‘টর্ন এপার্ট শব্দটি খুব ভয়ংকর একটি শব্দ। নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে হারিয়া যাওয়া। রাজনৈতিকভাবে যারা নিজের দেশ, নিজের ভিটে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারা ভয়ংকরতম নির্মমতার শিকার।’ নুরুদ্দিন ফারাহ ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম এক ‘টর্ন এপার্ট’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ঔপন্যাসিক শিহান করুণাতিলাকা বলেন, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের শেষে আমরা মনে করেছিলাম আমরা এখন এক থাকতে পারবো। তাদের সকলকে নিয়ে তাদের গল্প বলতে পারবো। কিন্তু নৈরাজ্যের কারণে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিলো, তা কখনোই শেষ হয়ে ওঠেনি।
গীতাঞ্জলি শ্রী বলেন, আমাদের মানসিকতাই হয়ে গেছে বিচ্ছিন্নতার। আমরা ভয়াবহ সময়ে বাস করছি, যেখানে কোনও মানবিকতা নেই।
ফ্রম ডন টু ডার্কনেস শীর্ষক অধিবেশনে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, যখন আমরা যুদ্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করছিলাম, তখন কেউ কল্পনা করেনি যে নয় মাসে আমরা ঘরে ফিরবো। আমার মনে হয় এটি অনেকেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে যে আমরা নয় মাসে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি। একটি জাতির আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, সবার মাথার উপর এক অজানা মেঘ ভর করেছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং তার ভাগ্যে কী আছে কেউ জানতো না। কারণ অনেক বড় ষড়যন্ত্র তাকে নিয়ে সাজানো হচ্ছিল। কিন্তু ফ্যাক্ট ছিল যে, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছিলেন এবং তা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল।
উৎসবের প্রথম দিনে জেমকন সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবার এ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন তিন কবি-সাহিত্যিক। এবছর ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি কামাল চৌধুরী। তিনি সম্মাননার সঙ্গে পেয়েছেন পাঁচ লাখ টাকার চেক। তরুণ শ্রেণিতে ‘ঘুমিয়ে থাকা বাড়ি’ পান্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার পেয়েছেন সাকিব মাহমুদ। আর এই শ্রেণিতে ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ উপন্যাসের জন্য তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন সাজিদুল ইসলাম।
তরুণ এই দুই সাহিত্যিক পেয়েছেন এক লাখ টাকার করে চেক। দুপুরে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বর্ণিল আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র। মঞ্চে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা ও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য ও জেমকন গ্রæপের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ।
কবি শামসুর রহমান মিলনায়তনে ‘বড় চিন্তা, ছোট গল্প’ সেশনে কথা বলেন গল্পকাররা। গল্পে গল্পে তারা মেলে ধরেন তাদের লেখার ভাবনা ও অভিজ্ঞতা। গল্প নিয়ে গল্প করেন গল্পকার মাহবুব আজিজ, শাহনাজ মুন্নী, সুমন রহমান, অসীম পলাশ, রুমা মোদক ও মশিউল আলম।
এসআর