ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চরিত্রায়নের জাদুকর

মাজহার মান্নান

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১ ডিসেম্বর ২০২২

চরিত্রায়নের জাদুকর

মাজহার মান্নান

তখন মোবাইল আমাদের হাতে আসেনি। গ্রামে থাকতাম সে সময়ে এবং একটি পত্রিকা হাতে পেতেও অনেক সময় লেগে যেত। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে দুই একটি পত্রিকা আসত। বিকেলে বাজারে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে সেই পত্রিকা পড়তে হতো। পত্রিকা পড়ার নেশা ছিল তীব্র। তাই যত কষ্টই হোক পত্রিকা পড়ে বাড়িতে ফিরতাম। প্রতিদিনের মতোই বিকেলে বাজারে গেলাম পত্রিকা পড়তে। পত্রিকার শিরোনাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষের সেøাগান। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন সেøাগান খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়।

কিন্তু নাটকের একটি চরিত্রের শেষ দৃশ্যে ফাঁসি হতে পারে এমন সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে এবং ফাঁসি যেন না হয় সেই দাবি জানাচ্ছে। এমন নজির দেশে আর কখনো হয়নি এমনকি বিশ্বেও না। একটি চরিত্রকে নাট্যকার কিভাবে রূপায়ন করলেন যে হাজার হাজার দর্শকের মনে সেটা রেখাপাত করল এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজপথে নেমে এলো। এমন ঘটনা আর ঘটবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। একজন লেখকের সার্থকতা ঠিক এখানেই। একজন লেখক ও ঔপ্যনাসিক যখন চরিত্রায়নে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে সক্ষম হন তখনই শুধু এমনটি ঘটতে পারে।

প্রাচীন গ্রীসে সোফোক্লেস যখন কিং ইডিপাস রচনা করলেন তখন পাঠক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নজিরবিহীন। উইলিয়াম সেক্সপিয়ার যখন ম্যাকবেথ, ওথেলো এবং কিং লেয়ারের মতো চরিত্রগুলোকে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানায় রূপায়ন করলেন তখন তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল। জোনাথন সুইফট যখন গালিভারের মতো চরিত্র রূপায়ন করলেন তখন সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে গেল। সাহিত্য বোদ্ধাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল সেটা বিশ্লেষণ করতে করতে। আমাদের দেশেও সাহিত্য বোদ্ধাদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোনো কমতি দেখি না। কিন্তু যখনই হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখনই সাহিত্য বোদ্ধাদের একটু ঢিমেতালে বা গড়িমসি ভাব লক্ষ্য করা যায়।

হুমায়ূনের লেখনীর সাহিত্যমূল্যকে তারা বিশ্বমানের বলতে নারাজ। সাহিত্য সমালোচনা ছাড়া কোনো সাহিত্যই পূর্ণতা পায় না। সাহিত্য সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে গবেষণালব্ধ। ব্যাপক গবেষণা ছাড়া কোনো জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। কিছু খ-িত ও বিচ্ছিন্ন সমালোচনা পাওয়া যায় তার লেখনীকে ঘিরে। আর খ-িত সমালোচনা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্য কতটুকু যাচাই করা সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বের বেশির ভাগ খ্যাতিমান লেখকেরা মৃত্যুর পর বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন।

এদিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। তিনি তার জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এবং মৃত্যুর পরেও সেটা অব্যাহত আছে। সমালোচকরা বলতেই পারেন যে হুমায়ূন শুধু তার পাঠক, শ্রোতা আর দর্শকদের বিনোদন দিতেই লিখে গেছেন, লেখার মৌলিকত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার মুন্সিয়ানায় ঘাটতি ছিল। কেউ আবার বলতে পারেন, হুমায়ূনের লেখনীর সাহিত্য গভীরতা কম। কেউ হয়তো বলবেন তার লেখনীকে ক্লাসিক প্যাটার্নে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও অনেক সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা নিয়ে কোনো সমালোচক প্রশ্ন তুলতে পারেননি। আর চরিত্র রূপায়ণের মাস্টার ছিলেন বলেই তিনি আজ এত জনপ্রিয়।

ম্যাকবেথ, ওথেলো, কিং লেয়ারের মতো সর্বকালের চরিত্র সৃষ্টি করে শেক্সপিয়ার বিখ্যাত হয়েছিলেন। জনাথন সুইফটও গালিভারের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে হিমু, মিসির আলী, শুভ্র এর মতো চরিত্র রূপায়ণ করে হুমায়ূন আহমেদ আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাকের ভাইকে বাঁচাতে দর্শক শ্রেতাদের যে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল বিশ্ব সাহিত্যে বা শিল্পে তা ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করা আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তার লেখনী এবং সৃষ্টি কর্মের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ও প্রায়োগিক প্রভাব ব্যাখ্যা করাই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি রচনায় জ্যাক রুশোর লেখা ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’ লাইনটি অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। একজন লেখকের লেখা একটি দুটি লাইনই সামাজিক কম্পন তৈরি করতে পারে। এমনকি বিশ্ব সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ উক্তিটি বিশ্ব সভ্যাতার ইমেজকে ধারণ করে।

মানুষকে যতই পরাধীন করে রাখা হোক না কেন সে তার সহজাত স্বাধীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন সক্রেটিস, জাঁ জ্যাক রুশো, জনাথন সুইফট, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ সাহিত্যিকবৃন্দ।
জার্মান কবি ও নাট্যকার ইবৎঃড়ষঃ ইৎবপযঃ লিখলেন, আফ্রিকাতে মানবতাবাদের শুরু হয় খাবার টেবিলের সকালের নাস্তা থেকে। তার এই উক্তির পর মানবতাবাদের ধারণা অনেকটাই বদলে গেল। মানবতাবাদের ধারণায় এলো নতুনত্ব। হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর বড় শক্তি ছিল এই নতুনত্ব।

নাটক এবং উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তিন নব নব রূপে উপস্থাপন করতে পারতেন। নান্দনিকতা ছিল হুমায়ূনের লেখনীর প্রাণশক্তি। একটি লেখনীর নান্দনিকতা সেটাকে অমর করে রাখে। মান্নাদের কফি হাউজের গানটি নান্দনিকতার জন্যই অমর হয়ে থাকবে। মান্নাদে সেই কফি হাউজে যেতেন না, কিন্তু গানটিকে এমন নান্দনিক করে গাইলেন যে শ্রোতারা বিশ্বাস করতে শুরু করল এটি তার জীবনেরই গল্প। একটি লেখনী বা সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে শব্দচয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শব্দচয়নে হুমায়ূন এক অনন্য স্রষ্টা। রোমান্টিক সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিলো শব্দচয়নকে কেন্দ্র করে।

ক্লাসিক সাহিত্যের ভারবোজিক এবং জন মিল্টনের ব্যোমবাস্টিক শব্দে সাহিত্য রচনার ধারা থেকে বের হয়ে এলেন ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয, ঔড়হ কবধঃং এবং ঝযবষষু. তাদের হাতে রচিত হলো নতুন যুগের, যে যুগের কাব্য ও সাহিত্যের শব্দগুলো ছিল খুবই সহজ সরল আর প্রাঞ্জল। আর এই সহজ সরল, প্রাঞ্জল ভাষা আর শব্দ হয়ে উঠলো হুমায়ূনের লেখনীর অন্যতম অনুষঙ্গ। সাধারণ মানুষের ভাষা সহজ। আর তাই সহজ ভাষাতেই হতে হবে সাহিত্যকর্ম। হুমায়ূন সাধারণ পাঠকের মন পড়তে পারতেন। হুমায়ূন তার লেখনীতে সহজ সরল আর প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করেছেন কিন্তু ভাষার মাধুর্যতার প্রশ্নে তিনি আপোস করেননি।

ভাষার মাধুর্যতা একটি লেখাকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। লেখার পরতে পরতে যে রস পাঠকরা পেয়ে থাকেন সেটা এই মাধুর্যতার কারণেই। হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে বৈচিত্র্য বিদ্যমান। কমেডি এবং ট্রাজেডির যৌক্তিক সমন্বয় করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। তার অনেক নাটকে এবং লেখায় এর প্রমাণ মিলেছে। পাঠক বুঝতে পারছে অমুক চরিত্রটির ট্রাজিক পরিণতি হবে (যদিও পাঠক মনে মনে সেটা কামনা করছে না) কিন্তু শেষ অবস্থায় সেই চরিত্রটির কমিক পরিণতি হলো এবং পাঠক তার মনের সুপ্ত স্বস্তি পেয়ে গেল। ট্রাজেডি এবং কমিডির এমন সমন্বয় আমরা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকে দেখি।

হুমায়ূন আহমেদ তার কমিক চরিত্রগুলোকে রোমান্টিক ধাঁচে উপস্থাপনে মাস্টার ছিলেন যা সচারাচর অন্যান্য লেখকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অ্যারিস্টটল তার  ‘পয়েটিকস’ এ নাটকের তিনটি ইউনিটির কথা বলেছিলেন যেটা ক্লাসিক নাটকের অপরিহার্য উপাদান ছিল। কিন্তু উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নাটকের সেই তিনটি ইউনিটকে ভঙ্গ করলেন, কিন্তু নাটকে সৃষ্টি করলেন এক নতুন মাত্রা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ঠিক এই দিকটা প্রবল ছিল। তিনি নাটকের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে এসে নাটকের বহুমাত্রিক বিষয়ে প্রাধান্য দিলেন। নাটকের প্লটগুলোকে তিনি ভিন্ন ধাঁচে সাজালেন।

নাটকের কল্পরূপকে জীবন্ত করে তুলতে লাগলেন। প্রতিটি চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যেন কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং সেই ধারাবাহিকতায় সব ধরনের পাঠক, শ্রোতা ও দর্শককে মজিয়ে রাখা এবং হাসি, কান্না, রসবোধে চাঙ্গা রাখার মতো অসাধ্য কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্বের সকল ক্লাসিক সাহিত্যের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা একটি মুখ্য ভূমিকায় থেকেছে। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্র নির্মাণে নিরপেক্ষ থেকে ক্লাসিক সাহিত্যের ধারাকে সমুন্নত রেখেছেন। হিমু, মিসির আলী, শুভ্রসহ আরও যত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন তাদের সবগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘কিং হেনরি ফোর’ নাটকে দেখা যায় রাজার ছেলে তার দুষ্ট বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকে, সময় কাটায়। কিন্তু রাজার ছেলে যখন সিংহাসনে বসল তখন সে নিরপেক্ষ হয়ে গেল। বন্ধুদের অন্যায় আবদারকে সে পাত্তা দিল না। হুমায়ূন আহমেদের রচনার আরেকটি অনবদ্য দিক হল পয়েটিক জাস্টিস। বাস্তবিক ন্যায়বিচার আর কাব্যিক ন্যায়বিচারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। নাটকীয়তার ধাপে ধাপে পয়েটিক জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হয়। পয়েটিক জাস্টিসের মাধ্যমে পাঠক, দর্শক, স্রোতাকে মূলত কিছু বার্তা দেয়া হয় এলিগরিক্যাল ধাঁচে। অনেক সমালোচকের মতে হুমায়ূন আহমেদ সংস্কার নিয়ে লেখেননি।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লেখনীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্কারের আভাস মিলে। লেখার মাঝে জীবনের বাস্তবতাকে তুলে আনা এবং পাঠককে নতুন করে স্বপ্ন দেখায় তার লেখনী। পাঠক ও দর্শকদের মনোজগতে বিচরণ করতে পারতেন হুমায়ূন। বিমূর্তকে মূর্তরূপে এবং প্রাণহীনকে প্রাণ দিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। পাঠকের অনুভূতির জায়গাগুলো তার ভালো করে জানা ছিল। পাঠককে কল্পজগতে বিচরণ করিয়ে বাস্তবতার স্বাদ গ্রহণ করাতে পারতেন। সকল ধর্ম, মত ও পথকে সম্মান করে লিখে গেছেন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রথাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনে দক্ষ ছিলেন। লেখায় ভারসাম্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা, সেন্স অব হিউমার, দেশপ্রেম ও মানবতাবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তুলতে ঝানু ছিলেন।

মিসির আলী সিরিজে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুনিপুণভাবে। সাহসী লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ব্যঙ্গ করতেন উচ্চমার্গের লিখনশৈলীতে যা পাঠকের হৃদয়ে রসদ জুগাতো। তার ব্যঙ্গ রচনার ধাঁচ দেখে জনাথন সুইফটকেই মনে পড়ে যায়। মোটিভেশন এবং চমক তার উপন্যাস এবং নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার সাহিত্যকর্মের প্রতিটি চরণেই যেন নতুন চমকের আস্বাদন। তার গল্প বলার ধরন এবং উপস্থাপন কৌশল স্বতন্ত্র। সাবলীল, ইউনিক এবং ড্রামেটিক সংলাপে তিনি পা-িত্য দেখিয়েছেন। সংলাপে হিউমারকে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিশ্লেষণ এক ভিন্ন সংযোজন তার লেখনীর। গল্পের প্লট এবং চরিত্রগুলোর বিন্যস্তকরণ এমনভাবে তৈরি যেখানে তারা মধ্যপন্থি হয়, আপোষ করে চলে কিন্তু অন্যায় করে না। প্রজ্ঞা ও আবেগের দারুন সমন্বয় চরিত্র রূপায়ণে।

জাদুকরী নির্মাণ কৌশলের কারণে তার উপন্যাসগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে। তার কথাসাহিত্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের অভিনব মনস্তত্ত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। তার নন্দিত নরক উপন্যাস যেটার বড় নজির। হুমায়ূন আহামেদ কোনো বিশেষ শ্রেণির জন্য লেখেননি। তিনি তার লেখনীতে দেখিয়েছেন প্রতিটি মানুষই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশেষ হতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তি কিভাবে নিজের মতো চলতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে সেটার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। সংকট, সংকট উত্তরণ, রোমান্স, রসবোধ সব কিছুতেই ব্যক্তি দর্শনের একটি প্রভাব দেখা যায়। কাহিনী রচনায় বাঙালির রুচি, সংস্কৃতি, ও চেতনাকে ধারণ করতেন তার লেখায়।
ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় অভিনবত্বের সাক্ষর দেখতে পাই। তার শ্যামল ছায়া উপন্যাসে হাসান আলীর রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্পটি পাঠকদের মুগ্ধ করে, নতুন ভাব জগতে নিয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক লেখক। তার দেয়াল উপন্যাসটিতে অসাম্প্রদায়িকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক চেতনা একটি সমাজকে কতটা পিছে ঠেলে দেয় তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাসে। বাঙালি সম্প্রীতির অনন্য নজির দেখা যায় তার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে।

হুমায়ূন আহমেদ তার রচনাগুলোতে কাহিনী, সংলাপ, অ্যাকশন এমনভাবে সাজাতেন যেন যে কেউ পড়লে সে ভাবতে শুরু করত এটা বুঝি তার নিজের জীবনেরই গল্প। কাহিনী বর্ণনার প্রতিটি পর্বে নাটকীয়তা বিদ্যমান। কাহিনীর নাটকীয়তা পাঠককে শুরুতে সংশয়ী ও নৈরাশ্যবাদী করলেও সমাপ্তিতে পাঠক আশাবাদী হয়েছে এবং হতাশা নয়, আশাতেই যে জীবনের পূর্ণতা তা উপলব্ধি করেছে।
অনেক লেখকের ব্যক্তিগত জীবন তার লেখনীর উপর প্রভাব ফেলে। হুমায়ূন আহমেদ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন, কিন্তু তার লেখনীতে এর একটু আঁচও লাগেনি। আর এখানেই হুমায়ূনের বিশেষত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে উপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও চলচিত্রকার। তিনি ছিলেন এমনই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যিনি তরুণ আর কিশোরদের বইমুখী করতে পেরেছিলেন, দর্শকদের নাটকমুখী করতে পেরেছিলেন এবং সুস্থ ধারার বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে মানুষকে সিনেমামুখী করেছিলেন। সুস্থ ধারার বিনোদন দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।

প্রেম, বিরহ, ট্রাজেডি, কমিডি, ট্রাজিক-কমিডি, রোমান্টিক-কমেডি, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা, গান, নাটকসহ নানা বিষয়ে এক ভিন্নমাত্রিক লেখা জাতিকে উপহার দিয়েছেন। বহুব্রীহি, এসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারের মতো মৌলিক এবং হৃদয়গ্রাহী লেখা খুব কম লেখকই উপহার দিতে পেরেছেন। জীবনের অনেক ছোট ছোট বিষয়কে কাব্যময় করে তুলতে পারতেন। তিনি যে চরিত্রগুলোর রূপায়ণ করেছেন সেগুলোর ওপর নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেননি। চরিত্রায়নে উদার নৈতিক দর্শন দৃশ্যমান।

শেক্সপিয়ারের নাটকে সমাজের উচ্চবিত্তকে হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সমাজের মধ্যবিত্তদের হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে। একজন মধ্যবিত্তের মাঝেও যে হিরোইজম কাজ করতে পারে তা তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালিয়ানার গড় বৈশিষ্ট্য তার লেখনীতে উঠে এসেছে। পারিবারিক বলয়ে বাঙালি জীবনের গল্পগুলোকে তিনি শিল্প রূপ দিয়েছেন। সিগমান্ড ফ্রয়েড মানুষের সাবকনসাস মাইন্ডের কথা বলেছেন, যেখানে মানুষ তার কল্পলোকে বিরাজ করে। হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের এই সাবকনসাস মাইন্ডকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি খুব সহজেই পাঠককে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরিয়ে আনতে পারতেন।

ভাষার সারল্যেও ভাবগাম্ভীর্য আর গভীরতা বজায় রেখেছেন। ধর্মীয় নিরপেক্ষতা, নারী-পুরুষের সাম্যভিত্তিক সমাজ চিত্রিত করেছেন। পুরুষতন্ত্র প্রাধান্য পায়নি তার লেখায়। এমনকি ক্ষমতাবান নারীকেও তিনি পারিবারিক বলয়ের ভেতরে রেখেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষ সহজাতভাবেই গল্প পছন্দ করে। কিন্তু সেই গল্পটি হওয়া চাই তার নিজের জীবনের মত। প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প ভিন্ন কিন্তু সবার গল্পগুলো যেন একই সুতায় গাঁথা মালার মতো। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক এই দর্শনটিই বুঝতে পেরেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন গল্পগুলোকে সার্বিকীকরণ করে সবার মনের কথাগুলোকে কাব্যময় করে উপস্থাপন করেছেন।
চরিত্রায়নের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতা, ¯েœহ আর হাস্যরসের মাধ্যমে এক ধরনের বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতা তৈরি করতে পারতেন। ‘এই সব দিনরাত্রি’ এবং আজ রবিবার নাটকে তিনি যৌথ পরিবারের বন্ধনকে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। ‘নিমফুল’ নাটকে ডাকাতের চোখ তোলা হবে বলে চরম কর্মযজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল এবং দর্শকদের মাঝে চরম আশংকা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তাকে পুলিশের মুখোমুখি করে স্বস্তির জায়গা তৈরি করলেন। চরম ক্ষ্যাপাটে চরিত্রকেও তার নাটকে অতি মানবিক রূপে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। কোথাও কেউ নেই নাটকে এমনটি দেখা গেল। তিনি নির্জলা সত্যের আড়ম্বরহীন উপস্থাপন করতে পারতেন।

নেতিবাচক চরিত্রেও যে ইতিবাচক কিছু দিক থাকে তা তিনি দেখিয়েছেন কোথাও কেউ নেই নাটকে। মন্দতেও ভালো কিছু থাকে এটি আমরা শেক্সপিয়ারের নাটকেও দেখি। তার বিখ্যাত একটি লাইন ‘Sweets are the uses of adversity.’ এখানে নাট্যকার মন্দের মাঝে ভালোগুণ আবিষ্কার করেছেন। মিসির আলী, হিমু, শুভ্র চরিত্রগুলোকে সাদা চোখে হয়তো মূল্যহীন মনে হবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যা করা সহজ নয়, তারা তাই করে দেখিয়েছে। এজন্যই এই চরিত্রগুলো সর্বকালের প্রতিরূপ।
সাহিত্যের মূল স্রোতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হুমায়ূন আহমেদ বলতে গেলে উদাসীন ছিলেন। তার সহজাত এবং স্বভাবজাত গল্প বলার ধরন আর ব্যতিক্রমী লেখনীর কারণেই শ্রোতা, দর্শক আর পাঠকরা তার সৃষ্টিকর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা করার জাতীয় দীনতার ছাপ দেখি। তাকে নিয়ে তিক্ত সমালোচনাও কর্ণগোচর হয়েছে। তিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখেন এমন বাচ্য উচ্চারিত হয়েছে।

আমার প্রশ্ন হলো যারা বাণিজ্য করেননি তাদের লেখা জনগণ লুফে নিল না কেন? হুমায়ূন আহমেদের লেখা কেন জনগণের পছন্দ হলো? কি জাদু আর মধু তার লেখায় আছে? যা হোক আমি অতবড় বোদ্ধা নই। তাই অনাকাক্সিক্ষত ব্যাখ্যায় যাব না। যা হোক গতানুগতিক সাহিত্য পাঠ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে মূল্যায়ন করা যাবে না। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হোন। কিন্তু এ দুটি পুরস্কারই তার সৃষ্টিকর্মের জন্য যথেষ্ট নয়। তার সৃষ্টিকর্মগুলোকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়নের সময় এসেছে।

×