শ্রীমতি কল্যাণী ঘোষ সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছা পূরণের আশা থেকে তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন সাগরিকা
শ্রীমতি কল্যাণী ঘোষ সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছা পূরণের আশা থেকে তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন সাগরিকা। আদর করে বলতেন, সাগর। স্বামী সুবোধ ঘোষ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের দু’বিঘা ফসলি জমি ছিল। সুবোধ ঘোষ শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে তার জমি চাষ করতেন। তাতে যে ফসল হয় তা দিয়ে সুন্দরভাবে সংসার চালানো দায়। অতিরিক্ত কিছু আয়ের উদ্দেশ্যে পরের জমিও চাষ করতেন। জমির মালিক পেত অর্ধেক, বাকি অর্ধেক তার।
কল্যাণী ঘোষ সংসার গোছানো, মেয়ের সেবাযতœ ছাড়াও বেতের মোড়া বানাতেন। কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে তার ভালো লাগত। ফলে সময় যে কেমন করে কেটে যেত তা তিনি টের পেতেন না। তার একটা গোপন ইচ্ছা ছিল সাগর দেখার। শৈশবে তার ছোট মামার কাছে মুগ্ধ বিস্ময়ে কল্যাণী সাগরের গল্প শুনতেন। ছোট মাামা জাহাজের নাবিক ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে তিনি সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি পাড়ি দিতেন। দিবারাত্রির বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রের বিচিত্র রূপ তিনি দেখেছেন। সমুদ্রে ডলফিনসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের বিচিত্র খেলা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। সে সব গল্প তিনি কল্যাণীকে বলতেন। কল্যাণী সমুদ্র দেখার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু কোথায় গেলে সমুদ্র দেখা যাবে তা কিশোরী কল্যাণীর জানা ছিল না।
একবার হঠাৎ করে তাদের এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। একে দাঙ্গা না বলে হামলা বলা ভালো। কেননা, দাঙ্গা হয় দু’পক্ষের মধ্যে। হামলা করে একতরফা সংখ্যাগুরুর দল সংখ্যালঘুদের ওপর। ওই হামলা করেছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা। তারা নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজয় উৎসব করতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়, তাদের অনেককে হত্যা করে, আহত হয় তারও বেশি।
ছোট মামা খবর পেয়ে দেশে আর ফিরে আসেননি। মামী, দিদা, মামাতো ভাইবোনসহ সবাই এক কাপড়ে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ইন্ডিয়া চলে যায়। ইন্ডিয়ায় তাদের আত্মীয়স্বজন ছিল। কল্যাণী ঘোষরা যাননি, তারা এদিক ওদিক পালিয়ে মাটি কামড়ে বেঁচে ছিল। মুসলমান প্রতিবেশীরা তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের আশ^াস দিয়েছিল। ছোট মামা চলে গেছেন, কিন্তু ছোট মামা তার সমুদ্র দেখার অভিজ্ঞতার ভা-ার রেখে গিয়েছিলেন কল্যাণীর কাছে। কল্যাণী সমুদ্র দেখার স্বপ্ন দেখত। স্বামী আর একমাত্র কন্যা সাগরিকাকে নিয়ে তার সময় কাটে। তবু স্বপ্ন তার পিছু ছাড়ে না। কল্যাণী মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে আপন মনে বলে, ‘গরিবের কেন ঘোড়া রোগ হয়?
স্কুল ছুটি থাকলে কিংবা অনেক সময় রাতেও সুবোধ ঘোষ গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াত। ছেলেমেয়েরা তাঁর বাড়িতেই আসত। তিনি তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিতেন না। অনেক ছাত্র অনেক সময় তাদের লাউ, কুমড়া, আলু, দুধ, গুড় দক্ষিণা হিসেবে নিয়ে আসত। সুবোধ ঘোষ তা নিতে আপত্তি করতেন না। শিশুদের তিনি পড়ালেখা শিখিয়ে আনন্দ পেতেন। তাদের মাঝে তিনি দেশের ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্ন দেখতেন। শিশুদের মাঝে থেকে তিনি অনেকটা শিশুদের মতোই হয়েছিলেন। শিশুদের মতো তিনি লাভ লোকসানের হিসাব করতেন না।
গ্রামবাসীরা তাকে সুবোধ পন্ডিত বলে ডাকত। এই পন্ডিত নামটি ছিল তার খুব প্রিয়, তার আত্মসম্মানের একটি সুন্দর জায়গা। এ জন্যে তিনি নিজের মধ্যে অতি সংগোপনে একটি ক্ষুদ্র গর্ববোধ পুষতেন। এ গর্ব ছিল শিক্ষক হবার গর্ব। শিক্ষকতা পেশা হচ্ছে সব পেশার সেরা। গাধাকে পিটিয়ে মানুষ করার আনন্দ কজনে পায়! শুধু খেয়ে পরে বাঁচলে মানুষের গর্ববোধ থাকে না। জনসেবাই মানুষকে গর্ববোধ করতে শেখায়। শিক্ষকতা মানুষকে আশার আলো দেখায়, গর্ববোধ শেখায়।
একদিন অকস্মাৎ কল্যাণীদের সংসারে অপ্রত্যাশিতভাবে দুঃখের ঘনঘটা নেমে আসে। সুবোধ পন্ডিত আত্মহত্যা করেছেন। স্কুলের কড়িকাঠে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। গ্রামবাসীরা খবর পেয়ে স্কুলে ভিড় করেছে। সেদিন সকালে স্থানীয় এমপি সাহেব এসেছিলেন স্কুল পরিদর্শনে। সুবোধ পন্ডিত তখন ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। তাকে দেখা সত্ত্বেও ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে তিনি কেন এমপি সাহেবকে সালাম বললেন না এটা ছিল সুবোধ পন্ডিতের বড় অপরাধ।
এমপি সাহেব সুবোধ পন্ডিতকে স্কুলের সব ছাত্র শিক্ষকের সামনে কান ধরে উঠবস করান। এ দৃশ্য দেখে ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেটাও সেদিন তার দুষ্টামি বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাউমাউ করে কেঁদেছিল। এই অপমান সুবোধ পন্ডিত সইতে পারেননি। তার ভেতরের সম্মান বোধ তাকে ধিক্কার দিয়েছিল। তাই তিনি আত্মহত্যা করে তাঁর অপমানের শোধ নিয়েছেন নীরবে।
এমপি সাহেবের সঙ্গে পূর্ব থেকে সুবোধ পন্ডিতের একটা বিবাদ ছিল। তিনি সুবোধ ঘোষকে তার দুই বিঘা জমি এমপি সাহেবের নিকট বিক্রি করতে বলেছিলেন। এমপি সাহেব বলেছিলেন, সুবোধ পন্ডিত তোর দুই বিঘা জমি আমার কাছে বিক্রি করে দিয়ে সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে যা। এ দেশে থেকে আর কী হবে। তোর আত্মীয়স্বজন সবাই ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইন্ডিয়া হিন্দুদের দেশ। সেখানে গেলে তোরা সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকবি। আমাদের দেশ কতদিন তোরে সুরক্ষা দেবে। সুবোধ পন্ডিত তার প্রস্তাবে রাজী হননি।
সামান্য সুখ শান্তির জন্য তিনি মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করতে না পারা ছিল সুবোধ পন্ডিতের বড় অপরাধ। তাকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ এমপি সাহেব আজ পেয়েছেন। এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করলেন না। মনের খেদ মিটিয়ে তিনি সুবোধ পন্ডিতকে অপমান করে নির্যাতন করেছেন। একজন শিক্ষকের কাছে সম্মান হারানোর চেয়ে বড় শাস্তি আর হয় না। তাই সুবোধ পন্ডিত সম্মান রক্ষার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। গ্রামবাসী এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসীর মেরুদ- আজও সোজা হতে পারেনি। প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য তারা মুখ বন্ধ করে মেনে নেয়।
এই দুই বিঘা ফসলি জমি ছাড়া কল্যাণী ঘোষদের আর কোনো সহায় সম্বল ছিল না। আগে এই জমি নিজেরা চাষ করতেন। এখন তা বর্গা দিতে হয়েছে। ফলে ফসল নেমে এসেছে অর্ধেকে। পাশের জমিগুলো এককালে সুবোধ ঘোষদের ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেসব জমি বেদখল হয়ে যায়। অনেক মামলা মোকদ্দমা করেও সেসব সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মামলা দীর্ঘদিন চালাবার মতো আর্থিক সংগতি তাদের ছিল না। ক্যল্যাণী ঘোষ জমির পাশ দিয়ে আসা যাওয়ার সময় দীর্ঘনিঃশ^াস ফেলেন।
কল্যাণী প্রতিবেশীদের বাড়িতে ছুটা কাজ নেন। তাতে মা মেয়ের দু’বেলা কোনো মতে চলে যায়। বেতের মোড়া বানিয়ে তা বাজারে বিক্রি করে দু’পয়সা আয় হয়। মেয়ে সাগরিকাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। এখন সরকার মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। মেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে হয় না, বই কিনতে টাকা দিতে হয় না। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় সাগরিকা বৃত্তির টাকাও পেয়ে থাকে।
লেখাপড়ায় সাগরিকার দারুণ আগ্রহ। শিক্ষা সাগরিকাকে বড়ো হতে শেখায়। সে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সাগরিকা যখন আইএ ক্লাসে পড়ে তখন এক ছেলে গোপনে তার খাতায় লিখে দেয়, ‘সাগর জলে সিনান করি সজল এলো চুলে, বসিয়াছিলে উপল উপকূলে।’ সাগরিকা রাগ করে না। কবিতার লাইন দুটি সে বারবার পড়ে আর রোমাঞ্চিত হয়।
সাগরিকা দেখতে খুব সুন্দরী। আর এই রূপ, এই সৌন্দর্য এক সময় তার লেখাপড়া করে বড় হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দত্তদের বাড়ির বড় ছেলে সুনীল দত্তের সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। দত্তরা বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার।
সুনীল দত্ত সরকারি চাকরি করে। কল্যাণী ঘোষ এমন সুপাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না। সাগরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর একটা দারুণ দুশ্চিন্তা ছিল। তার মৃত্যুর পর সাগরিকাকে দেখবে কে? মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব মায়ের দুশ্চিন্তা থাকে। সব দিক বিবেচনা করে সাগরিকা মায়ের ইচ্ছার কাছে নিজের বড়ো হবার ইচ্ছা বিসর্জন দেয়।
বিয়ের পর সাগরিকা মায়ের মতোই সমুদ্র দর্শনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ছোটবেলায় মা তাকে তার ছোট মামার কাছ থেকে শোনা সমুদ্রের নানান রোমাঞ্চকর গল্প শোনাত। সে সব গল্প সাগরিকা আজও ভোলেনি। সমুদ্র দর্শনের স্বপ্ন তার রক্তের মধ্যেই ছিল। সাগর দেখার স্বপ্ন সে উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে।
একদিন সাগরিকা তার স্বামীকে বলে, তুমি তো তোমার শাখা অফিসগুলো পরিদর্শন করতে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করো। একবার কক্সবাজারের অফিস পরিদর্শনে যাও না কেন? তা হলে আমার সমুদ্র দর্শনও হবে। প্রস্তাবটা সুনীল দত্তের ভালো লাগে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। সুনীল দত্ত কক্সবাজার জেলা শাখা পরিদর্শনের সফরসূচি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। দুই সপ্তাহ পর তার সফরসূচি বাতিল করে চিঠি এলো। সচিব বলেছেন, সরকারি খরচে জেলা শাখা পরিদর্শনের নাম করে বিনোদন ভ্রমণ করা যাবে না।
মায়ের মতো সাগরিকারও সমুদ্র দর্শনের স্বপ্নসাধ অপূর্ণ থেকে যায়। বছর কয়েক পর সাগরিকার এক ফুটফুটে ছেলে হয়। সাগরিকা ওর নাম রাখে সমুদ্র। পুত্র সমুদ্রকে দেখে সাগরিকা তার নিজের ও মায়ের সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছা পূরণ করে।