ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চেনা জীবনের শৈল্পিক উপস্থাপন

শিল্পী নাজনীন

প্রকাশিত: ০১:২৩, ৭ অক্টোবর ২০২২

চেনা জীবনের শৈল্পিক উপস্থাপন

ঘুণপোকাদের জলসাঘর

জীবন আসলে কী? জন্ম মুহূর্ত থেকে সাদা চোখে যা দেখি আমরা সেটুকুই, না কি আড়ালে আরও কিছু থাকে তার? থাকে আরও গহীন, গোপন কোন পাঠ? থাকে অব্যক্ত আরও কিছু কান্না ও হাহাকার, হৃদয় বিদীর্ণ করা আরও কোনো আর্তচিৎকার, যা চিৎকৃত হওয়ার আগেই সভয়ে আবার গিলে ফেলি আমরা সমাজ আর লৌকিকতার চাপে, জীবনের অদৃশ্য চিতায় নিজেকে তুলে দিয়ে অবিরত পুড়ি, হয়ে থাকি জীবন্মৃত?
সম্প্রতি পড়া হলো লেখক সায়মা ইসলামের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘুণপোকাদের জলসাঘর’। গ্রন্থটি পাঠ শেষে উপরিউক্ত প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেল অনেকক্ষণ, ভাবাল। গ্রন্থটিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে রচিত মোট এগারোটি গল্প আছে। গল্পের সরল বুনন ও উপস্থাপন আলাদা কোন আবেদন তৈরি না করলেও গল্পে ব্যবহৃত বেশ কিছু উপমা ও চিত্রকল্প চমৎকৃত করে, মুগ্ধতা ছড়ায়। ‘জালবন্দী ঘোলা¯্রােত’ গল্পটি গ্রন্থে স্থান পাওয়া প্রথম গল্প।

লেখক গল্পের অবতারণা করেছেন ‘রাতের আকাশ তার অন্ধকারের জাল টেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই সঙ্গে উত্তাল পদ্মার বুক থেকে রাতের শেষ জালটিও নৌকায় টেনে তুলল তমিজুদ্দিন, রবিউল আর পরান।’ -এই বাক্যদুটির মধ্য দিয়ে। গল্পের শুরুতেই ব্যবহৃত এই উপমা ও চিত্রকল্প পাঠককে মুগ্ধ করে, গ্রন্থপাঠে প্রলুব্ধ করে, যদিও শেষপর্যন্ত গ্রন্থটি পাঠকের মুগ্ধতাকে পুরোপুরি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া এগারোটি গল্পের বিষয় নির্বাচনে দারুণ নৈপুণ্যের প্রমাণ দিয়েছেন লেখক।

জীবনের প্রতি পরতে লুকিয়ে থাকে যে ঘুণপোকা, যা ধীরে ধীরে ক্ষইয়ে দেয় আমাদের বোধের পারদ, জীবনের সহজ ছন্দটুকু বিকল করে দিতে  অতি গোপনে জলসা বসায় আমাদের মনের গোপন ঘরে, তারই প্রতিচ্ছবি লেখক এঁকেছেন তার ‘ঘুণপোকাদের জলসাঘর’ নামক গ্রন্থে। দারিদ্র্যের কাছে পরাজিত, সমর্পিত নিম্নবিত্তের জীবন যেমন লেখক তার গল্পে তুলে এনেছেন পরম মমতায়, তেমনি মধ্যবিত্তের আপাত সুখী জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, অন্তর্দ্বন্দ্ব-বিষে নীল হওয়া যে যন্ত্রণাদগ্ধ গৃহীজীবন, সেটি তিনি  চিত্রিত করেছেন দারুণ মুন্সিয়ানায়।

গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠক চরিত্রগুলোকে চিনতে পারে অতি সহজেই, গল্পের চরিত্রগুলো তার চিরচেনা সমাজ থেকে উঠে আসা অতি সাধারণ চরিত্র। কিন্তু চেনা এসব চরিত্রের জীবনের যে ছবি লেখক এঁকেছেন তার গল্পে, যে আলো ফেলেছেন এসব জীবনের একান্ত অন্দরমহলে, তার ঔজ্জ্বল্যে পাঠকের চোখ থেকে অন্ধকার পর্দা সরে যায় এক লহমায়, জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কদর্যরূপ তার মনোজগতকে আমূল নাড়িয়ে দেয়।

অথচ এই অতি চেনা আটপৌরে জীবন তার কাছে নিত্যকার দর্শনে বৈচিত্র্যহীন, জীর্ণ। দেখা আর তাকিয়ে থাকার মধ্যে যে বিস্তর তফাৎ, লেখক পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে সেটি দেখিয়েছেন তার কুশলী বুননে, অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে জীবনের নানা বাঁক স্পর্শ করে। চেনা জীবনের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে যে অন্ধকার গোপন কুঠুরি, অসমতল নিষ্ঠুর বাঁক, সেগুলো আবিষ্কার করে লেখক তার চিরচেনা জীবনকে চেনে নতুন করে, দেখে নতুন দৃষ্টিতে, এবং এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণই লেখকের।

গ্রন্থটিতে দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিম্নবিত্তের অসহায় আত্মসমর্পণ আছে, অভাবের চোরা স্রোতে টালমাটাল নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনযুদ্ধ আছে, আছে মধ্যবিত্তের জটিল জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সরল বয়ান। এছাড়া আদিকাল থেকে নারীর ওপর চলা যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতা যেমন গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে পারিবারিক অশান্তি ও অবহেলা একটি শিশুর মনোজগতকে কতটা প্রভাবিত করে এবং কীভাবে সে ধীরে ধীরে জড়িয়ে যায় জঙ্গী কার্যক্রমে তার নিদারুণ চিত্রও।

সেইসঙ্গে অবশ্যম্ভাবীরূপে এসেছে মানবজীবনের চিরন্তন প্রবাহ প্রেম। গ্রন্থে প্রেম ও বঞ্চনা যেন একই বৃন্তে ফুটে থাকা দুটি কুসুম। যেখানে রনি, হারুন, ও আজগর মোল্লার মতো প্রবঞ্চকদের যেমন দেখা মেলে, তেমনি গাউস, সানু ভাই  আর এহসানদের মতো একনিষ্ঠ প্রেমিকদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে পাঠকের। যা গ্রন্থটিকে পাঠকপ্রিয় করে তুলতে অনেকখানি ভূমিকা রাখে। গ্রন্থের সবশেষ গল্পটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা দারুণ একটি প্রেমের গল্প যা পাঠ করতে গিয়ে পাঠকের চোখ ভিজে ওঠে, করুণার্দ্র হয় হৃদয়।
গল্পের চরিত্র নির্মাণ এবং সংলাপ রচনা আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে। বিশেষ করে গল্পের নারী চরিত্রগুলো অধিকতর দুর্বল। যেন তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজচালিত একেকটি পাপেট। যাদের নিজস্ব কোন জীবন নেই, অন্যের জীবন তারা যাপন করে, অন্যের ইচ্ছেয় তাদের হাসা-কাঁদা-বেঁচে থাকা। তারা যেন তৃণের মতো করে বেড়ে ওঠে আর কোন একটি হাতের প্রত্যাশায় উন্মুখ, অধীর থাকে, যে হাতটি তাদের  উৎরে নেবে জীবন নামক নদী সন্তরণে।

কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ প্রায় পেরিয়ে এসে নারী কি আদতেই এতটা দুর্বল? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা পাঠকের মনে উঁকি দেয়। অবশ্য ‘আটপৌরে তেষ্টা’ গল্পের হেনার মেয়ে সানজিদা পাঠকের মনে খানিকটা হলেও আশার সঞ্চার করে, তার মাধ্যমে পাঠক যুগ পরিবর্তনের খানিকটা আভাস পায়।
গ্রন্থে ‘এই কাঙালের প্যাটে আর য্যান কোন বাচ্চা না দেয় খোদায়’ এমন শক্তিশালী সংলাপ খুব বেশি চোখে পড়েনি। গল্পের কিশোর চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব আরও কুশলী চিত্রায়ন দাবি করে। এছাড়া পুরো গ্রন্থে অনেকগুলো বানানবিভ্রাট পাঠকের মনে বিরক্তি জাগায়, ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, যা লেখকের শ্রমকে ম্লান করে দেয় খানিকটা হলেও।

×