ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেতাত্মার সঙ্গে আত্ম প্রতিকৃতি

মূল : মেং জিন, ভাষান্তর : মুহাম্মদ সালাহউদ্দীন

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রেতাত্মার সঙ্গে আত্ম প্রতিকৃতি

প্রেতাত্মার সঙ্গে আত্ম প্রতিকৃতি

গুগুকে রাস্তায় দেখলাম। সে পাবলিক লাইব্রেরির বাইরে বেঞ্চে বসে ছিল।
তুমি এখানে কি করছ? আমি বললাম।
সে ষোলো বছর আগে মারা গিয়েছিল। এমন কী যখন সে জীবিত ছিল, সে  আমাকে দেখতে কখনোই সাগর পাড়ি দেয়নি, যদিও বিদ্বেষ বা উপেক্ষার কারণে নয়। আমি জানি, আমি তাকে যা বোঝাতে চেয়েছিলাম, সে আমাকে তার চেয়ে বেশি বোঝাতে চেয়েছিল। সে আমাকে আরও বেশি বোঝাতে চেয়েছিল কারণ এতদিন ধরে গুগু প্রায় ধর্মীয় অনুভূতিতে মৃত্যুকে অনুধাবন করেছিল। আমার জানা মতে এই ধরনের প্রথম ব্যক্তি সে।
গুগু আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল। আমি হয়তো আশা করেছিলাম মৃত্যু তাকে পরিবর্তন করবে, পূর্ণতা দান করবে, যাকে সম্ভবত, একটি প্রখর আলোর সঙ্গে শেয়ার করা যেতে পারে। কিন্তু আমি তাকে শেষবার যেমন দেখেছিলাম, সে দেখতে ঠিক সেরকমই ছিল, আজ থেকে বিশ বছর আগে জিনহুয়াতে, নিটোল গাল এবং ধীর গতির গুগু যেন এ্যাকোয়ারিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চুল ছিল প্রায় ছেলেদের মতো ছাঁটা। গুগু চপ্পল ও একটি দীর্ঘ নীল আলখাল্লা পরেছিল, যেন সে এখনও বাড়ি ছেড়ে যেতে ভয় পায়।
আমার মনে হয়, তুমি কী পড়ছ তা দেখতে চেয়েছিলাম, সে বলল। আমি বলতে চাচ্ছি যে, ইদানীং তুমি একজন লেখক।
 আমি বললাম, ঠিক আছে। তাকে দেখানোর জন্য আমি আমার পিঠে ঝুলানো ব্যাগ খুললাম। ভিতরে ছিল ঐতিহ্যবাহী চীনা কাব্যতত্ত্বের পা-িত্যপূর্ণ আলোচনার দুটি বই, একটির বিষয়বস্তু ছিল কাচের মাধ্যমে স্মৃতিকে দেখা ও অন্যটি ছিল কাচের মাধ্যমে স্থানকে দেখা। এছাড়াও সেখানে ছিল সং রাজবংশ আমলের ভূচিত্রের একটি আর্টের বই। জেমস এবং স্টিফেন নামের দুজন ব্যক্তি কাব্যতত্ত্বগুলো লিখেছিলেন। এই ধরনের বই যার নিছক অস্তিত্ব বছরের পর বছর ধরে আমাকে ভয় দেখিয়েছিল বা ক্ষুব্ধ করেছিল। বইগুলো ছিল খুব ভারী। দুপুরে রোদের সময় এগুলো নিয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে আমার পিঠ ঘেমে যেত।
পাতার উপর আঙুল বুলিয়ে গুগু আফসোস করে বলল, ওগুলো ইংরেজীতে লেখা। আমি মনে করি তুমি কখনই নিজেকে চীনা ভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ করতে শিখনি।
তখন আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে গুগু ইংরেজীতে কথা বলছে, অথচ এই ভাষাটি সে জানত না। আমি সঙ্গে সঙ্গে  কৃতজ্ঞতা এবং লজ্জা বোধ করলাম। আমার কাছে এই বইগুলো ছয় মাস ছিল কিন্তু এখনও পড়া হয়নি। সেগুলো ফেরত দেয়ার মেয়াদ দুইবার উত্তীর্ণ হয়েছিল। আমি ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, যাতে আবার বইগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারি, কিন্তু সেগুলো শুধু আমার জন্য পুনঃঅনুমোদিত হয়েছিল, কারণ এই শহরের পাঠকদের কেউ তাদের পড়তে চায় না, পিছনের পকেটে থাকা ক্যাটালগ কার্ড অনুসারে ষোলো বছর তাদের স্পর্শ করা হয়নি।
গুগু চিত্রকলার শক্তি সম্পর্কে  উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করে :  এগুলো এমন কিছু বিষয়ের বিকল্প হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে, যা দর্শকদের মধ্যে সেই বিষয়ের প্রতি আবেগ সক্রিয় করে প্রকৃতবোধ জাগিয়ে তুলবে। প্রকৃতির রূপগুলো কেবল ভৌতিক পদার্থই নয়, চিত্তগ্রহী বা সুরুচির মতো অভৌত গুণাবলীর অধিকারীও; এবং বাহ্যিক আকৃতির পরিবর্তে এই গুণগুলোর দ্বারাই সংবেদনশীল মানুষের আত্মা প্রভাবিত হয়। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন: খুব মজাদার। দেখ, তুমি যত বেশি লিখছ, আমি ততই বিসদৃশ দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি বাস্তবতা এবং অবাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে  মৌলিকভাবে আগ্রহী নও।
 
কিন্তু আমার উপন্যাসটি ছিল আত্মদর্শন নিয়ে, আমি বলেছিলাম। প্রতিটি চরিত্রই তাদের বাস্তবতার সংস্করণ নিয়ে কথা বলে এবং বিভিন্ন বাস্তবতা এমন কিছু যোগ করে যা সমাধানের চেয়ে অজানা বলে মনে হয়। ‘আমি’ বা ভ্রমগ্রস্থ শোকের সেই গল্পটি বা একটি শহরকে কেন্দ্র করে লেখা সেই অস্পষ্টতার গল্পগুলো কী এই রকম নয়?  আমরা যাদেরকে প্রকৃত বাস্তবতা হিসেবে বিশেষাধিকার দিয়েছি, কিন্তু সেগুলোর একান্ত প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে তাদের মধ্যে কোন না কোনভাবে বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়েছে।
সে উঠে দাঁড়াল এবং বইগুলো ফেরত দিতে বই রাখার বিনের কাছে গেল। গুগু একটু খুঁড়িয়ে উঠছিল, যেমনটা শেষবার আমি তাকে দেখেছিলাম। এটি আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল। যতক্ষণ না সে মারা যেতে সফল হয়েছিল, সেই প্রচেষ্টা থেকে প্রাপ্ত আঘাত নিশ্চয়ই অনেক আগেই সেরে গিয়েছে। আমি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু সে বিরতি ছাড়াই চলতে থাকে। স্বচ্ছন্দ গতিতে, যেন সে আগেও অনেকবার এসব করেছে, গুগু এক এক করে বইগুলো ধাতব বিনের মুখের মধ্যে ফেলে দিল।
আমি বইগুলো নিয়ে শোক না করার চেষ্টা করেছি। ইচ্ছে করলে এখনও আমি তাদের পড়তে পারি। যখনই আমার প্রয়োজন হবে, আমি একটি অনলাইন পোর্টালে তাদের অনুরোধ করতে পারব এবং কয়েক দিনের মধ্যে সেগুলো আমার আশেপাশের শাখায় পৌঁছে দেওয়া হবে। ইচ্ছে করলে আমি এখন লাইব্রেরির ভিতরে যেতে পারি এবং বিন থেকে সেগুলো উদ্ধার করার জন্য গ্রন্থাগারিককে বলতে পারি। পাবলিক লাইব্রেরি হলো একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান; তারা আমার সঙ্গে বাড়াবাড়ি না করে ইতোমধ্যেই ক্ষমা করে দিয়েছে, অন্যরা যা করত না। আমার কাছে অন্যমনস্কতা ও অবহেলা কেবল তখনই এসেছে যখন এটি আমার সঙ্গে মানানসই হয়েছে এবং সাধারণত কিছু বোকা গল্পের সেবার মাধ্যমেও।
গুগু বলল, ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মকালে তোমার বানানো গল্পটা মনে আছে?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। দুপুরের খাবারের পর অনেক অলস সময়ের মধ্যে এটা ছিল একটা সময়, যখন আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা ছিল। মেয়েদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল: গুগু তখন কম্পিউটারে গেম খেলছিল, তার চার বছরের মেয়ে এবং আমি বোকার মতো বাঁশের বিছানায় বসেছিলাম। গল্পটি ছিল অমৌলিক আখ্যানগুলোর মধ্যে একটি কোলাজ কার্টুন, যা শনিবার-সকালের পত্রিকা থেকে কেটে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেখানে পিয়ানোর দোকান লুট করা একটি ক্ষেপাটে ইঁদুর সম্পর্কে অসার গল্প বলা হয়েছিল, এটিই আমার মনে পড়েছিলÑ  পুলিশ কিভাবে অপরাধীকে খুঁজছিল, অভিযান পরিচালনার জন্য আশপাশের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, তখন তাদের অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল। একটি ইঁদুর? যুক্তিবাদী মানুষ জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন একটি ইঁদুর পিয়ানো নিতে চাইবে?
গুগু বলল, এটা এমন একটি নিখুঁত গল্প ছিল। মজার, আঁকড়ে ধরার, যার কাঠামো সম্পূর্ণরূপে কল্পনা থেকে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই সময় আমি ভেবেছিলাম তোমার লেখার প্রতিভা থাকতে পারে। এখন আমি অবাক হয়ে ভাবছি তোমাকে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছি কিনা।
আমি খুব সংবেদনশীল ছিলাম, আমি বললাম।
আসলে, মাত্র দশ বছর বয়সে গুগু আমাকে একজন লেখক বলে সম্বোধন করছে শুনে আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম, যদিও আমি ভালভাবে জানতাম যে, অন্য প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে এটি পুনরাবৃত্তি না করাই উত্তম। তারা শুনলে বলত, তুমি গুগুকে বিশ্বাস করতে পার না বা তুমি কী তার মতো শেষ হতে চাও? এমনকী তার মেয়েও পরের গল্প শোনার জন্য চোখ ঘুরিয়েছিল, আমার হাত টানছিল। কিন্তু গুগুর প্রশংসায় আমার গলা পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে গেল; যা কয়েক দশক ধরে আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল।
আমি বিষয়গুলোকে আলাদা করে রাখতে চেয়েছিলাম, সে বলল। কিন্তু তুমি তাদের ছেড়ে দিয়ে গলিয়ে মিশ্রিত করো।
আমি বললাম, এটা অন্যায়। আমি  সুচিন্তিত হওয়ার চেষ্টা করছি।
এটা যথেষ্ট নয়, সে বলল। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তব এবং অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার। একটি অস্তিত্ববান এবং অন্যটি বিপজ্জনক। সীমানাগুলো দ্রবীভূত করা নেই। একটি বাস্তবতা যা সত্যিই আতঙ্কজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তুমি সমসাময়িক জীবনের কঠোরতা নিয়ে অভিযোগ করতে পারো, তবে এটি তোমার মতো করে চিন্তাভাবনা করছে যা সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে।
সে যেভাবে এসেছে সেভাবেই চলে যেতে লাগল। আমি তাকে যেখানে দেখতে পেয়েছি সেই বেঞ্চে বসেছিলাম এবং তার অভিযোগগুলো বিবেচনা করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে এই সত্য অনুধাবন করেছি যে, মানুষের অভিজ্ঞতা দ্বৈততার মধ্যে পরিচ্ছন্নভাবে নির্ধারণ হয় না। সম্ভবত, এটা সত্য যে, গুগু কিভাবে বেঁচে ছিল এবং মারা গিয়েছিল, এইভাবে দেখার মাধ্যমে তা পরিষ্কার করেছে। কিন্তু আমি কখনই তাকে মনে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করিনি।
আমি তাকে অন্য পাহাড়ের ব্লকের ওপর দিয়ে খুঁড়িয়ে যেতে দেখেছি। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল যা আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এর পরিবর্তে, আমি নিজের পক্ষালম্বন করতে গিয়ে সমস্ত সময় নষ্ট করেছিলাম। আমি ভাবছিলাম, যেমন বলা যায়, ব্যথা এখনও তাকে আঘাত করে। আমি যেমন ভাবছিলাম, মৃত্যুর মধ্যে তার নিজের জীবনের প্রতিটি সংস্করণ ছিল। আমার দৃষ্টির সীমায় সে কী এখন খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কারণ আমি তাকে যেভাবে চিনতাম? যখন সে সুস্থ ছিল, আমি যদি আমার দিদি বা বাবার মতো তাকে চিনতাম, তখন সে কিভাবে  উপস্থিত হতো?    
আমি যেমন ভাবছিলাম, সে যা দেখেছে ও শুনেছে সেগুলো সম্পর্কে এখন কথা বলেছিল, তখনও তাকে বাতিকগ্রস্ত বলা যায়। আমি কল্পনা করেছিলাম ভূত-প্রেত আরও উদার প্রকৃতির। আমি কল্পনা করেছি গুগু নতুন পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আগুনের চারপাশে বসে তার অদ্ভুত মনের কথা বলছে। অন্য প্রেতাত্মারা প্রশংসার সঙ্গে হেসে মাথা নাড়বে অথবা সহানুভূতিশীল হয়ে মাথা নাড়বে। তার গল্পগুলোর কোন্ অংশগুলো আসল এবং কোন্ অংশগুলো নকল এই প্রশ্ন ছাড়াই উভয় ক্ষেত্রেই তারা তাকে প্রকৃতভাবে গ্রহণ করবে, অন্ততপক্ষে সঙ্গীর্ণ অর্থে নয়।
তুমি আবার সেখানে যাও, গুগু বলল। আমি তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কারভাবে শুনতে পেলাম যেন সে এখনও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক আছে, আমি বললাম। আমি তার উন্মোচিত চিন্তার একই আদর্শ রীতির মধ্যে সবেমাত্র ফিরে যাচ্ছিলাম।
তখন তুমি এটা কিভাবে লিখতে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যদি আমার মতো থাকতে?
সে সাড়া দিল না। গুগু এখন অনেক দূরে, তার শরীর পাহাড়ের চূড়া ছুয়ে অন্যদিকে অদৃশ্য হতে শুরু করেছে। এটি ছিল একটি অসময়ের গরম দিন। ফুটপাথের আস্তরণের ফাঁকে ঘাসের গোছায় পোকামাকড় গুঞ্জন করছে এবং দূরে পাহাড়ের সেতুবন্ধ তীব্র তাপে ঝলমল করছিল। গুগু ছিল বিকেলের ঝাপসা কুয়াশায় অপসৃত কালো ধোঁয়া। আমি বিনের ভিতরের বইগুলোর কথা ভেবেছিলাম, যা আমাকে বিষয়গুলো ভিন্নভাবে দেখতে সাহায্য করতে পারে, এমনকী, যা আমাকে মুক্ত করতে পারে উত্তর-আধুনিকতার তালগোল পাকানো প্রবৃত্তি থেকেও। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তার পিছনে ছুটলাম। আমার জন্য অপেক্ষা কর, আমি ডাকলাম। আমি খুব দ্রুত হাঁটলাম, কিন্তু এখন আর তাড়াহুড়ো নেই।

×