ভ্যানচালক জহির
আষাঢ় মাস। সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। অনেকদিন পর ঠাণ্ডা আবহাওয়া পেয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ভ্যানচালক জহির। সকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁইছুঁই হলেও আরামের ঘুম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু গরিবের আরাম করার উপায় কোথায়! উঠতে হবে তাকে। রিকশাভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ সোমবার কালীবাড়ির হাটবার। কালীবাড়ির হাট সপ্তাহে দুবারই বসে। সোমবার আর শুক্রবার। গত শুক্রবার অতিবৃষ্টির কারণে হাটে যেতে পারেনি। আজ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই যেতে হবে। হাতে টাকাকড়ি নেই একদম।
জহির দুপুরের খাবার না খেয়েই বেরিয়ে পড়ল। ওর বাড়ি থেকে কালীবাড়ি পাঁচ কিলোমিটার। বৃষ্টির কারণে রাস্তার বেহাল অবস্থা। ভাগ্যে ভাল বলতে হবে। ভ্যান নিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজন যাত্রী পেয়ে গেল। সে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে না থেকে দুজন নিয়েই চলল হাটের দিকে। চলতে চলতে পথে যদি আরও কিছু যাত্রী পাওয়া যায় তবে তুলে নেবে।
বৃষ্টির কারণে বাজারমুখো মানুষের ভিড় কম। তারওপরে এই এলাকায় রিকশা-ভ্যানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। অনেকেই ভ্যান নামিয়েছে। এতে ইজিবাইক রিকশা-ভ্যানওয়ালাদের বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন সহজে কেউ রিকশা-ভ্যানে উঠতে চায় না। কিছুদূর যেতেই জহির আরও দুইজন যাত্রী পেয়ে গেল। তারা নিজেদের বাগানের শাক-সবজি, তরিতরকারি নিয়ে উঠেছে, হাটে বিক্রির জন্য। যাত্রীরা সবাই জহিরের পরিচিত। খোশগল্প করতে করতেই ভ্যান চালাচ্ছে সে।
কালীবাড়ির হাটে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে গেল। যাত্রীরা যে যার মতো নেমে চলে গেছে। আজ হাটে লোক সমাগম কম। জহিরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টির যা অবস্থা তাতে ফিরতি পথে আর কোন খ্যাপ পাবে বলে মনে হয় না। নিরুপায় হয়ে ভ্যান নিয়ে একটা বড় গাছের নিচে বসে থাকে।
অনেক অপেক্ষার পর বৃষ্টি থামল ঠিকই। তবে আকাশে কালো মেঘ এখনও গোমড়া হয়ে আছে। এখনও সন্ধ্যা হয়নি। কিন্তু চারদিক কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাট অনেকটাই লোকশূন্য হয়ে পড়েছে। খ্যাপের আর আশা নেই। খালি ভ্যান নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে।
নিজের রিকশা-ভ্যানটির দিকে তাকিয়ে জহিরের মন খারাপ হলো। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বেশিদিন হয়নি সে অনেক উন্নতমানের কাঠ ও যন্ত্রপাতি দিয়ে মনের মতো করে ভ্যানটি বানিয়ে নিয়েছে। ত্রিশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এভাবে ভিজতে থাকলে কাঠ নষ্ট হয়ে যাবে। নিজের জিনিস যতœ করে ব্যবহার করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জহির কাঁধের গামছা দিয়ে ভ্যানটি মুছতে শুরু করল।
ভ্যান মুছে যখন বেরিয়ে আসবে ঠিক তখন একজন লোক এসে জহিরের সামনে দাঁড়াল। লোকটির বিমর্ষ মুখ। দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারা। লোকটি বলল,
‘ভাই খ্যাপ নিয়া যাবা?’
‘কোথায় যাইবেন, কী নিয়া যাইবেন?’
‘কলাতলীর হাট।’
‘কলাতলী’ নামটা উচ্চারণ করেই একটু ভাবে জহির। এটা তো ওর বাড়ির দিকে নয়। উল্টা দিকের রাস্তা। কলাতলী খ্যাপ নামিয়ে সাত আট কিলোমিটার ঘুরে বাড়ি ফিরতে হবে। যদিও ওদিকের রাস্তা ভাল। তারপরও বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। পুরোদিনটা তো বৃষ্টিই খেয়ে দিল। যদি সেরকম ভাড়া পাওয়া যায় . . .
‘তয় কী মাল নিয়া যাইবেন, তা তো কইলেন না?’
ক্ষীণকণ্ঠে লোকটি জানাল, কোন মালামাল না ভাই, একটা লাশ নিয়া যামু।’
জহির আঁতকে ওঠে।
‘লাশ!’
লোকটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ছেলের লাশ। বারো বছর বয়স। বিকালবেলা উঠানে বৃষ্টির পানিতে খেলতেছিল। হঠাৎ ঠাডা পড়ল মাথায়। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়া আইছিলাম। ডাক্তার দেইখা কইল . . . কথা শেষ না করেই শব্দ করে কান্না শুরু করে দিল লোকটি।
জহির ঠাডাপড়া লাশের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। গাঁও-গ্রামে মানুষের কাছে ঠাডাপড়া লাশ নিয়ে অনেক কেচ্ছা-কাহিনী শুনেছে সে। সত্য মিথ্যা জানে না। তবে ওগুলোর সবই ভয়ে শিউরে ওঠার মতো কাহিনী। এই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ঠাডাপড়া লাশ নিয়ে যেতে পারবে না সে। তাছাড়া কলাতলী যাওয়ার মাঝামাঝি জায়গায় একটি শ্মশানঘাট আছে। ওটা খুবই ভয়ঙ্কর জায়গা। ওখানে মাঝেমাঝেই ভূত-পেত্নীর আক্রমণের শিকার হয় লোকজন। এসব ভেবেই শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল।
জহির বলল, ভাই, আপনি অন্য গাড়ি দেখেন। আমি যামু না।’
লোকটি জহিরের হাত চেপে ধরে অনুনয় করে।
‘ভাই না করিস না। বিপদে পড়ে গেছি। সারাদিন বৃষ্টি, তার মধ্যে রাত হয়ে গেছে। হাসপাতালের সামনে একটা গাড়িও নাই। অনেক কষ্টে তোমারে পাইছি। ভাড়া যা চাও দিমু। তাও না কইরো না, ভাই। মরণ তো সবারই আসবো। লাশেরে কষ্ট দিতে নাই। লাশের সঙ্গে আমরা দুইজন লোক যামু। তোমার ভয়ের কিছু নাই। সব লাশই এক। ঠাডাপড়া লাশ বইলা মানুষ হুদাই ভয় পায়। চিন্তা কইরো না। তোমারে এক হাজার টাকা দিমু।’
ভাড়ার কথা শুনে জহিরের ভয় অনেকটা দূরীভূত হয়। কেননা কলাতলী হিসেবে এক হাজার টাকা ভাড়া অনেক বেশি। সারাদিন খ্যাপ মারতে পারেনি। এ রকম একটা খ্যাপ দিয়ে যদি পুষিয়ে নেয়া যায়, মন্দ কী।
জহির একটু ইতস্তত করে বলে, ‘লাশ কোথায়?’
‘হাটের দক্ষিণ মাথায় কামারপট্টির পরেই, হাসপাতালের সামনে।’
তারপর লোকটি ভ্যানে উঠে বসে। জহির হাসপাতালের সামনে চলে যায়। হাসপাতালের সামনে গাছের নিচে আধো আলো আধো অন্ধকারে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই কাঁথা দিয়ে মোড়ানো লাশ। দুজন মিলে ভ্যানে লাশটি তুলে নিজেরা দুই পাশে বসল। একজন অস্ফুটস্বরে জহিরকে বলল, ‘এবার চালাও।’
অল্প সময়ের মধ্যেই কালীবাড়ির হাট ছেড়ে কলাতলীর রাস্তায় চলে এসেছে। ঘন অন্ধকার। নিজের শরীরও ঠিকমতো দেখা যায় না। অন্ধকারের মধ্যে খুব সাবধানে ভ্যান চালাচ্ছে। এই মুহূর্তে ভ্যান গাড়িটা ভীষণ ভারি মনে হচ্ছে জহিরের কাছে। লাগছে যেন ভ্যানে কোন মানুষ নয়। অসম্ভব ভারি কোন পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লাশের সঙ্গে আরোহী দুজন এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও এখন কথা বলতে শুরু করেছে।
তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শ্মশানঘাট। শ্মশানঘাটে নাকি প্রতি অমাবস্যা রাতে অপবিত্র আত্মারা ভূত-পেত্নীর রূপ ধরে বিচরণ করে। ওরা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে থাকে। এই রাতে এখান থেকে যারা চলাচল করে তাদেরই ঘাড় মটকে রক্ত খায়। মনুষ্যরক্ত পান করলে ওদের আত্মা নাকি পবিত্র হয়। গত অমাবস্যায়ও একজন রিকশা চালকের ঘাড় মটকে রক্ত পান করেছে ওরা। কথাগুলো বলেই বুকে থুথু ছিটায় লোক দুজন।
জহিরকে উদ্দেশ্য করে একজন বলে ওঠে, ‘ভ্যানওয়ালা ভাই, আইজ যে অমাবস্যার রাইত, তা কি তুমি জানো?’
এই কথা শুনে জহির প্রচ- ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু ওদের তা বুঝতে দেয় না। জহির মনের মধ্যে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘জানি না। অমাবস্যা পূর্ণিমার খবর রাখার সময় কোথায়? তয়, যেরকম অন্ধকার রাইত তাতে অমাবস্যা হইলেও হইতে পারে।’
‘ভাই, একটু দেখেশুনে সাবধানে যাও। লাশের গাড়ি তার ওপরে সামনেই শ্মশানঘাট। গাড়িতে ঠাডাপড়া লাশ না থাকলে চিন্তা ছিল না।’
‘ঠাডাপড়া লাশে সমস্যা কী?’ জহির বলল।
‘তুমি বুঝবা না। এই লাশ নিয়া ওদের অনেক হিশাব নিকাশ আছে।’
জহির আর কথা বাড়ায় না। সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল মারতে থাকে। কিন্তু গাড়িটাকে এই মুহূর্তে আরও বেশি ভারি মনে হচ্ছে। সময় যেন ফুরাচ্ছে না। কাছের কলাতলীকেই দীর্ঘতম রাস্তা মনে হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে জহিরের ভ্যান শ্মশানঘাটের কাছে চলে আসে। চারদিক সুনসান। জায়গাটার দুই পাশেই ঘন জঙ্গল। তার মাঝে বাঁশঝাড়। এ কারণে অন্ধকারটা এখানে আরও বেশি। জহির দোয়া-কালাম যতটুকু জানে মনে মনে পড়তে থাকে। এই পথটুকু পার হতে পারলেই আর কোন সমস্যা নেই।
এরই মধ্যে ভ্যান থেকে একজন হঠাৎ বলে ওঠে, ‘গাড়ি থামাও।’
আঁতকে ওঠে জহির।
‘ক্যান কী হইছে!’
‘তোমারে কইতে ভুইলা গেছি। সামনে রাস্তা কাটা। ডান দিকে নাইমা জঙ্গলের পাশ দিয়া ভ্যান টাইনা তুলতে হইব। আমরা দুজন না নামলে তুমি গাড়ি টানতে পারবা না। আমরা কাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তুমি আস।’ বলেই ওরা দুজন নেমে পড়ে।
নেমেই রাস্তা ছেড়ে সোজা জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ভয়ে জহিরের শরীর ফুলতে থাকে। নিরুপায় সে। যে করেই হোক তাকে তো কলাতলী পৌঁছতে হবে। প্যাডেল মারা বন্ধ করে নিচে নেমে ভ্যান টানতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে সত্যি সত্যি কাটা রাস্তার দেখা পায়। রাস্তার ডান দিকে নামতে গিয়ে ভয়ে তার পা অবশ হয়ে আসে। মনে হতে থাকে, পেছন থেকে কেউ যেন তার পা টেনে ধরেছে। আশপাশে তাকিয়ে লোক দুটিকে দেখতে পায় না।
এমনকি তাদের পায়ের শব্দও কানে আসে না। অনেক কষ্টে ভ্যানটি জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে নিয়ে আসে। এখন গাড়িটি টেনে তুলতে হবে রাস্তায়। তুলতে আরও বেশি কষ্ট হবে। জহির ভ্যানের হ্যান্ডেল ধরে প্রাণপণে টেনে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। গাড়িটি রাস্তার ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছে। আর একটু অগ্রসর হলেই মেইন রাস্তায় উঠে যাবে। ঠিক তখনই জহিরের পেছন থেকে কেউ একজন তার শার্ট টেনে ধরল।
প্রচণ্ড রকম চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল। ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য দেখতে পেল সে। কাঁথায় মোড়ানো লাশটি লিকলিকে একটি হাত বের করে জহিরের শার্ট টেনে ধরেছে। অন্য হাতটি গলার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বলজ্বল করছে লাশের চোখ দুটি। দৃশ্যটি দেখে জহির প্রচণ্ড জোরে একটি চিৎকার দিয়ে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
ইতোমধ্যে লাশটি ভ্যান থেকে নিচে নেমে পড়েছে। লাশটি অজ্ঞান জহিরকে ধাক্কা মেরে রাস্তার ঢালের দিকে ফেলে দিল। জহির গড়াতে গড়াতে ঢালের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল।
সবদিক লক্ষ্য রেখে সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন চলে এলো ভ্যানের কাছে। লাশটি ফিসফিস করে বললো, ‘যে ভয় দেখাইছি তাতে ভ্যানওয়ালার কম্ম সাবাড়। এই জীবনে ওর আর হুস আইবো বইলা মনে হয় না। চল, ভ্যান লইয়া আমরা দ্রুত কাইটা পড়ি।’
তারপর ওরা তিনজন ভ্যান গাড়িটি নিয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে অন্য একটি রাস্তা ধরে পালিয়ে যায়।
পরদিন ভোরবেলা এলাকাবাসী জহিরকে জঙ্গলের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়। অচেতন লোকটিকে ঘিরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসীর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, হায় হায়, শ্মশানঘাটে ভূতের হাতে আরও একটি মানুষের প্রাণ গেল। আজব ব্যাপার ওই ভিড়ের মধ্যে প্রতারক আর খুনীরাও মিশে যায়। তারাও অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে থাকে, হায় হায় আরও একটা মানুষরে ভূত-পেত্নীতে মেরে ফেলল!
এদিকে গুজব রটনাকারী আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোর কারণে ঢাকা পড়ে যায় প্রকৃত ঘটনা। মাঝখান দিয়ে ভূত-পেত্মীর ওপর দোষ চাপিয়ে খুনী আর প্রতারকরা মুখ টিপে হাসে!