ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ প্রতারক

মো. জাকির হোসেন

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৫ আগস্ট ২০২২

গল্প ॥ প্রতারক

ভ্যানচালক জহির

আষাঢ় মাসসকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টিঅনেকদিন পর ঠাণ্ডা আবহাওয়া পেয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ভ্যানচালক জহিরসকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁইছুঁই হলেও আরামের ঘুম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে নাকিন্তু গরিবের আরাম করার উপায় কোথায়! উঠতে হবে তাকেরিকশাভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবেআজ সোমবার কালীবাড়ির হাটবারকালীবাড়ির হাট সপ্তাহে দুবারই বসেসোমবার আর শুক্রবারগত শুক্রবার অতিবৃষ্টির কারণে হাটে যেতে পারেনিআজ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই যেতে হবেহাতে টাকাকড়ি নেই একদম

জহির দুপুরের খাবার না খেয়েই বেরিয়ে পড়লওর বাড়ি থেকে কালীবাড়ি পাঁচ কিলোমিটারবৃষ্টির কারণে রাস্তার বেহাল অবস্থাভাগ্যে ভাল বলতে হবেভ্যান নিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজন যাত্রী পেয়ে গেলসে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে না থেকে দুজন নিয়েই চলল হাটের দিকেচলতে চলতে পথে যদি আরও কিছু যাত্রী পাওয়া যায় তবে তুলে নেবে

বৃষ্টির কারণে বাজারমুখো মানুষের ভিড় কমতারওপরে এই এলাকায় রিকশা-ভ্যানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়অনেকেই ভ্যান নামিয়েছেএতে ইজিবাইক রিকশা-ভ্যানওয়ালাদের বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছেএখন সহজে কেউ রিকশা-ভ্যানে উঠতে চায় নাকিছুদূর যেতেই জহির আরও দুইজন যাত্রী পেয়ে গেলতারা নিজেদের বাগানের শাক-সবজি, তরিতরকারি নিয়ে উঠেছে, হাটে বিক্রির জন্যযাত্রীরা সবাই জহিরের পরিচিতখোশগল্প করতে করতেই ভ্যান চালাচ্ছে সে

কালীবাড়ির হাটে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে গেলযাত্রীরা যে যার মতো নেমে চলে গেছেআজ হাটে লোক সমাগম কমজহিরের মনটা খারাপ হয়ে গেলবৃষ্টির যা অবস্থা তাতে ফিরতি পথে আর কোন খ্যাপ পাবে বলে মনে হয় নানিরুপায় হয়ে ভ্যান নিয়ে একটা বড় গাছের নিচে বসে থাকে। 

অনেক অপেক্ষার পর বৃষ্টি থামল ঠিকইতবে আকাশে কালো মেঘ এখনও গোমড়া হয়ে আছেএখনও সন্ধ্যা হয়নিকিন্তু চারদিক কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারহাট অনেকটাই লোকশূন্য হয়ে পড়েছেখ্যাপের আর আশা নেইখালি ভ্যান নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে। 

নিজের রিকশা-ভ্যানটির দিকে তাকিয়ে জহিরের মন খারাপ হলোবৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছেবেশিদিন হয়নি সে অনেক উন্নতমানের কাঠ ও যন্ত্রপাতি দিয়ে মনের মতো করে ভ্যানটি বানিয়ে নিয়েছেত্রিশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছেএভাবে ভিজতে থাকলে কাঠ নষ্ট হয়ে যাবেনিজের জিনিস যতœ করে ব্যবহার করতে হবেসঙ্গে সঙ্গে জহির কাঁধের গামছা দিয়ে ভ্যানটি মুছতে শুরু করল

ভ্যান মুছে যখন বেরিয়ে আসবে ঠিক তখন একজন লোক এসে জহিরের সামনে দাঁড়াললোকটির বিমর্ষ মুখদুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারালোকটি বলল,

ভাই খ্যাপ নিয়া যাবা?’

কোথায় যাইবেন, কী নিয়া যাইবেন?’

কলাতলীর হাট

কলাতলীনামটা উচ্চারণ করেই একটু ভাবে জহিরএটা তো ওর বাড়ির দিকে নয়উল্টা দিকের রাস্তাকলাতলী খ্যাপ নামিয়ে সাত আট কিলোমিটার ঘুরে বাড়ি ফিরতে হবেযদিও ওদিকের রাস্তা ভালতারপরও বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবেপুরোদিনটা তো বৃষ্টিই খেয়ে দিলযদি সেরকম ভাড়া পাওয়া যায় . . .

তয় কী মাল নিয়া যাইবেন, তা তো কইলেন না?’

ক্ষীণকণ্ঠে লোকটি জানাল, কোন মালামাল না ভাই, একটা লাশ নিয়া যামু

জহির আঁতকে ওঠে

লাশ!

লোকটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ছেলের লাশবারো বছর বয়সবিকালবেলা উঠানে বৃষ্টির পানিতে খেলতেছিলহঠা ঠাডা পড়ল মাথায়অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়া আইছিলামডাক্তার দেইখা কইল . . . কথা শেষ না করেই শব্দ করে কান্না শুরু করে দিল লোকটি

জহির ঠাডাপড়া লাশের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলগাঁও-গ্রামে মানুষের কাছে ঠাডাপড়া লাশ নিয়ে অনেক কেচ্ছা-কাহিনী শুনেছে সেসত্য মিথ্যা জানে নাতবে ওগুলোর সবই ভয়ে শিউরে ওঠার মতো কাহিনীএই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ঠাডাপড়া লাশ নিয়ে যেতে পারবে না সেতাছাড়া কলাতলী যাওয়ার মাঝামাঝি জায়গায় একটি শ্মশানঘাট আছেওটা খুবই ভয়ঙ্কর জায়গাওখানে মাঝেমাঝেই ভূত-পেত্নীর আক্রমণের শিকার হয় লোকজনএসব ভেবেই  শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল

জহির বলল, ভাই, আপনি অন্য গাড়ি দেখেনআমি যামু না

লোকটি জহিরের হাত চেপে ধরে অনুনয় করে

ভাই না করিস নাবিপদে পড়ে গেছিসারাদিন বৃষ্টি, তার মধ্যে রাত হয়ে গেছেহাসপাতালের সামনে একটা গাড়িও নাইঅনেক কষ্টে তোমারে পাইছিভাড়া যা চাও দিমুতাও না কইরো না, ভাইমরণ তো সবারই আসবোলাশেরে কষ্ট দিতে নাইলাশের সঙ্গে আমরা দুইজন লোক যামুতোমার ভয়ের কিছু নাইসব লাশই একঠাডাপড়া লাশ বইলা মানুষ হুদাই ভয় পায়চিন্তা কইরো নাতোমারে এক হাজার টাকা দিমু

ভাড়ার কথা শুনে জহিরের ভয় অনেকটা দূরীভূত হয়কেননা কলাতলী হিসেবে এক হাজার টাকা ভাড়া অনেক বেশিসারাদিন খ্যাপ মারতে পারেনিএ রকম একটা খ্যাপ দিয়ে যদি পুষিয়ে নেয়া যায়, মন্দ কী

জহির একটু ইতস্তত করে বলে, ‘লাশ কোথায়?’

হাটের দক্ষিণ মাথায় কামারপট্টির পরেই, হাসপাতালের সামনে

তারপর লোকটি ভ্যানে উঠে বসেজহির হাসপাতালের সামনে চলে যায়হাসপাতালের সামনে গাছের নিচে আধো আলো আধো অন্ধকারে একজন দাঁড়িয়ে আছেতার সামনেই কাঁথা দিয়ে মোড়ানো লাশদুজন মিলে ভ্যানে লাশটি তুলে নিজেরা দুই পাশে বসলএকজন অস্ফুটস্বরে জহিরকে বলল, ‘এবার চালাও

অল্প সময়ের মধ্যেই কালীবাড়ির হাট ছেড়ে কলাতলীর রাস্তায় চলে এসেছেঘন অন্ধকারনিজের শরীরও ঠিকমতো দেখা যায় নাঅন্ধকারের মধ্যে খুব সাবধানে ভ্যান চালাচ্ছেএই মুহূর্তে ভ্যান গাড়িটা ভীষণ ভারি মনে হচ্ছে জহিরের কাছেলাগছে যেন ভ্যানে কোন মানুষ নয়অসম্ভব ভারি কোন পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেলাশের সঙ্গে আরোহী দুজন এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও এখন কথা বলতে শুরু করেছে

তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শ্মশানঘাটশ্মশানঘাটে নাকি প্রতি অমাবস্যা রাতে অপবিত্র আত্মারা ভূত-পেত্নীর রূপ ধরে বিচরণ করেওরা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে থাকেএই রাতে এখান থেকে যারা চলাচল করে তাদেরই ঘাড় মটকে রক্ত খায়মনুষ্যরক্ত পান করলে ওদের আত্মা নাকি পবিত্র হয়গত অমাবস্যায়ও একজন রিকশা চালকের ঘাড় মটকে রক্ত পান করেছে ওরাকথাগুলো বলেই বুকে থুথু ছিটায় লোক দুজন

জহিরকে উদ্দেশ্য করে একজন বলে ওঠে, ‘ভ্যানওয়ালা ভাই, আইজ যে অমাবস্যার রাইত, তা কি তুমি জানো?’

এই কথা শুনে জহির প্রচ- ভয় পেয়ে যায়কিন্তু ওদের তা বুঝতে দেয় নাজহির মনের মধ্যে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘জানি নাঅমাবস্যা পূর্ণিমার খবর রাখার সময় কোথায়? তয়, যেরকম অন্ধকার রাইত তাতে অমাবস্যা হইলেও হইতে পারে’ 

ভাই, একটু দেখেশুনে সাবধানে যাওলাশের গাড়ি তার ওপরে সামনেই শ্মশানঘাটগাড়িতে ঠাডাপড়া লাশ না থাকলে চিন্তা ছিল না

ঠাডাপড়া লাশে সমস্যা কী?’ জহির বলল

তুমি বুঝবা নাএই লাশ নিয়া ওদের অনেক হিশাব নিকাশ আছে

জহির আর কথা বাড়ায় নাসর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল মারতে থাকেকিন্তু গাড়িটাকে এই মুহূর্তে আরও বেশি ভারি মনে হচ্ছেসময় যেন ফুরাচ্ছে নাকাছের কলাতলীকেই দীর্ঘতম রাস্তা মনে হচ্ছেভয়ে ভয়ে জহিরের ভ্যান শ্মশানঘাটের কাছে চলে আসেচারদিক সুনসানজায়গাটার দুই পাশেই ঘন জঙ্গলতার মাঝে বাঁশঝাড়এ কারণে অন্ধকারটা এখানে আরও বেশিজহির দোয়া-কালাম যতটুকু জানে মনে মনে পড়তে থাকেএই পথটুকু পার হতে পারলেই আর কোন সমস্যা নেই

এরই মধ্যে ভ্যান থেকে একজন হঠা বলে ওঠে, ‘গাড়ি থামাও

আঁতকে ওঠে জহির

ক্যান কী হইছে!

তোমারে কইতে ভুইলা গেছিসামনে রাস্তা কাটাডান দিকে নাইমা জঙ্গলের পাশ দিয়া ভ্যান টাইনা তুলতে হইবআমরা দুজন না নামলে তুমি গাড়ি টানতে পারবা নাআমরা কাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াইতুমি আসবলেই ওরা দুজন নেমে পড়ে

নেমেই রাস্তা ছেড়ে সোজা জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করেভয়ে জহিরের শরীর ফুলতে থাকেনিরুপায় সেযে করেই হোক তাকে তো কলাতলী পৌঁছতে হবেপ্যাডেল মারা বন্ধ করে নিচে নেমে ভ্যান টানতে শুরু করেকিছুদূর গিয়ে সত্যি সত্যি কাটা রাস্তার দেখা পায়রাস্তার ডান দিকে নামতে গিয়ে ভয়ে তার পা অবশ হয়ে আসেমনে হতে থাকে, পেছন থেকে কেউ যেন তার পা টেনে ধরেছেআশপাশে তাকিয়ে লোক দুটিকে দেখতে পায় না

এমনকি তাদের পায়ের শব্দও কানে আসে নাঅনেক কষ্টে ভ্যানটি জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে নিয়ে আসেএখন গাড়িটি টেনে তুলতে হবে রাস্তায়তুলতে আরও বেশি কষ্ট হবেজহির ভ্যানের হ্যান্ডেল ধরে প্রাণপণে টেনে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেচাকা ঘুরতে শুরু করেছেগাড়িটি রাস্তার ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছেআর একটু অগ্রসর হলেই মেইন রাস্তায় উঠে যাবেঠিক তখনই জহিরের পেছন থেকে কেউ একজন তার শার্ট টেনে ধরল

প্রচণ্ড রকম চমকে গিয়ে পেছনে তাকালভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য দেখতে পেল সেকাঁথায় মোড়ানো লাশটি লিকলিকে একটি হাত বের করে জহিরের শার্ট টেনে ধরেছেঅন্য হাতটি গলার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেজ্বলজ্বল করছে লাশের চোখ দুটিদৃশ্যটি দেখে জহির প্রচণ্ড জোরে একটি চিকার দিয়ে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল

ইতোমধ্যে লাশটি ভ্যান থেকে নিচে নেমে পড়েছেলাশটি অজ্ঞান জহিরকে ধাক্কা মেরে রাস্তার ঢালের দিকে ফেলে দিলজহির গড়াতে গড়াতে ঢালের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল

সবদিক লক্ষ্য রেখে সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন চলে এলো ভ্যানের কাছেলাশটি ফিসফিস করে বললো, ‘যে ভয় দেখাইছি তাতে ভ্যানওয়ালার কম্ম সাবাড়এই জীবনে ওর আর হুস আইবো বইলা মনে হয় নাচল, ভ্যান লইয়া আমরা দ্রুত কাইটা পড়ি

তারপর ওরা তিনজন ভ্যান গাড়িটি নিয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে অন্য একটি রাস্তা ধরে পালিয়ে যায়

পরদিন ভোরবেলা এলাকাবাসী জহিরকে জঙ্গলের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়অচেতন লোকটিকে ঘিরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকেসঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসীর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, হায় হায়, শ্মশানঘাটে ভূতের হাতে আরও একটি মানুষের প্রাণ গেলআজব ব্যাপার ওই ভিড়ের মধ্যে প্রতারক আর খুনীরাও মিশে যায়তারাও অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে থাকে, হায় হায় আরও একটা মানুষরে ভূত-পেত্নীতে মেরে ফেলল!

এদিকে গুজব রটনাকারী আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোর কারণে ঢাকা পড়ে যায় প্রকৃত ঘটনামাঝখান দিয়ে ভূত-পেত্মীর ওপর দোষ চাপিয়ে খুনী আর প্রতারকরা মুখ টিপে হাসে!

×