ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রণব মজুমদার

ত্রিদিব দস্তিদারের কাব্য শ্রবণের আনন্দ

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

ত্রিদিব দস্তিদারের কাব্য শ্রবণের আনন্দ

শীত নেমে এলেই হই কাব্যপ্রভায় সমুজ্জ্বল! উদ্বেলিত হই জীবনানন্দে! পাঠের উল্লাস আমাকেও দীর্ঘ পরিভ্রমণে শক্তি দেয় ! মিটিয়ে দেয় মনতৃষ্ণা! ভাবি, দর্শন না থাকলে জীবনের যৌক্তিকতা কোথায়? মননশীলতার মাহাত্ম্য তো এখানেই! কবিতা ও ছড়ার পাঠক আমি ছেলেবেলা থেকেই। তারপর গল্প! মফঃস্বল শহরের পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে আমার বেড়ে ওঠা। শিক্ষাব্রতী মা বাবার পরিমন্ডলে পাঠাভ্যাসে গড়ে ওঠে সেই স্পৃহা! সচেতন হবার পর কালোত্তীর্ণ ও যুগদর্শনের একটা কবিতা এমন শীতের পড়ন্ত বেলায় আমায় এতোটাই জীবনানন্দ দিয়েছিলো যে আমি তখন থেকেই মননশীল কবিতার প্রেমিক! সেই কবিতার স্রষ্টা অকাল প্রয়াত মনন ও ভূষণে যুবক ত্রিদিব দস্তিদার। আমরা তাঁকে মনে রাখনি! নিভৃতে কাঁদে তাঁর হৃদয়ঘনিষ্ঠ মননশীল শব্দাবলী! হয়তো মৃত্যুর দিনক্ষণ ভুলে গেছে তাঁর ‘প্রিয়জন’! তাঁকে নিয়ে কোন স্মরণ সভা নেই! দেশের সাহিত্য সাময়িকীর পৃষ্ঠাগুলোতে অব্যক্ত থেকেছে তাঁর গৃহপালিত পদ্যেরা! অথচ ত্রিদিবের বন্ধু ও ভালোবাসার মানুষের অভাব ছিল না! আক্ষেপ করে বলতেন দু’একজন পাঠক হৃদয়ে আমার রচনা ধারণ করলেই আমার শ্রম সার্থক। তবুও কথা থেকে যায়। যে সবাইকে ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে জীবন দিয়ে গেলো তাঁর জন্য আমাদের প্রেম কোথায়? শত্রু-মিত্র প্রেমিক সেই কবিকে আমরা মনে রাখিনি! যে সৃষ্টি মনোজগৎকে নাড়া দেয়, প্রচন্ড ভাবিয়ে তোলে সে মননশীল রচনা আমাকে জীবন দেয়! আলো দেয়! সে আলো আর প্রাণে আমাকে উদ্বুদ্ধ করে শিল্পের শাখা ও প্রশাখায় পরিব্রাজনে! সৃষ্টি হয় বোধের। মননশীল লেখকের অধিকাংশের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় তাঁর সৃৃজনী কর্মে। সত্যি একজন দেবলোকের সন্ধান পেয়েছিলাম তিরিশ বছর আগে। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাস। মহানগরীর বাংলা মোটরে অবস্থিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের নিচতলায় বিজয় দিবস উপলক্ষে আমরা সূর্যমুখী সংগঠনের আয়োজন! আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিচারপতি কে.এম. সোবহান। আমাদের বার্ষিক বিজয় উদযাপনের দিনে কবিতা পাঠের সেই আয়োজনে সপ্রতিভ ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে গেলেন মাইক্রোফোনের সামনে! সাদাকালো গোছানো শ্মশ্রুমন্ডিত এক যুবক! হাতে বালা, কানে দুল! গলায় মালা! রংচটা জিনসের সঙ্গে হলুদ গেঞ্জি পরা এবং তার ওপর প্রান্তে কালো চশমা ঝোলানো। মনে হলো বিজয়ের আনন্দে বাসন্তী রং তাঁর মনের অলিন্দে বাসা বেঁধেছে! দরাজ কণ্ঠে ও সাবলীল ভঙ্গিতে পাঠ করে চলেন নিজের কাব্য সম্ভার- ‘বাটখারা পড়ে গেলে চ্যাপ্টা হয় ওজন কমে না বাটখারা পড়ে গেলে লম্বা হয় ওজন বাড়ে না মানুষ পড়ে গেলে হাতল খোঁজে মানুষ বাড়ে না মানুষ পড়ে গেলে স্বপ্ন খোঁজে ভ্রান্তি কমে না!’ বস্তুজগৎকে মানবজীবনের সঙ্গে সুষমভাবে কাব্যকলায় সম্পৃক্ত করার দক্ষ কারিগর তিনি! কী হৃদয়জাত অনুভব তাঁর! সাবলীল মননশীলতা! কবিতা শ্রবণের পর মনে হলো যেন সেদিন জীবন্ত সুখ দুঃখের সংসারে আমি প্রবেশ করেছি। কবি আমায় মনতৃপ্তিতে ভরিয়ে দিলেন! অসীম ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! আমার অন্তর্নিহিত প্রেমে কবি ত্রিদিব দস্তিদারের অপরাবাস্তব এই কবিতা। পঙক্তিমালাগুলো রোপিত হলো আমার মনোজগতে। কবিতা লেখার প্রেরণা আমার ঠিক তখন থেকেই। কবিতাটি কবিকণ্ঠে আরও শুনেছি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নানা অনুষ্ঠানে। কবি ত্রিদিব দস্তিদার বলেছিলেনও তাঁর রচিত প্রিয় কবিতার অন্যতম এটি। যে কোনো সৃজনশীল ব্যক্তি তাঁর সৃষ্টি সুখে উল্লাস করেন তখনই যখন তিনি একনিষ্ঠ পাঠক বা শ্রোতা পান। কবি ত্রিদিব দস্তিদার আমাকেও তাঁর রচনার মনোজ্ঞ শ্রোতা পেয়ে সেদিন বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার ভালোবাসায় দীর্ঘসময় পথ চলা। মননশীল কবিতার টানে পিছু নেই তাঁর দর্শনে। দেখা হয় তাঁর কর্মক্ষেত্র বীমা অফিসে, মহানগরীর অভয় দাস লেনের ভোলাগিরি আশ্রমের বাসস্থানে এবং ভালোলাগার জায়গাগুলোতে। তাঁর সৃষ্ট কাব্যের অক্ষরসমষ্টি শোনাতেন কখনও কখনও একান্তভাবে। সংসার বিবাগী অজাতশত্রু মানুষটির কাব্যপ্রেম ছিল অবারিত। চেতনার স্ফূলিঙ্গে জীবনবোধের সত্তাগুলো। বিরহ ব্যথার অন্তর্নিহিত প্রেম কবিতায় শরীরে মূর্ত। গ্রীক পুরাণ ইউরিডাইস ও অর্ফিয়ুস কাহিনীর নিষ্ঠুরতম অধ্যায়টুকু কবি ত্রিদিবের হৃদয়গত ছিল প্রবল প্রেম ও দ্রোহের মিশ্রণে! কাহিনীকে তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারের ছিন্নভিন্ন লাখো প্রাণের পুনরুজ্জীবন দেখতে চেয়েছেন। অস্ত্রহাতে তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা উত্তর চেতনাগত পরিবর্তন হয়নি মুক্তিযোদ্ধা এই কবির। তাই বিভিন্ন সময় তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত মননশীল কাব্য আমার মনে এখনও দোলা দেয়। কবি ত্রিদিবের কী সজীব মনঃস্থ কাব্যমালঞ্চ! ‘যে যাত্রা আমাকে তোমার দিকে নিয়ে যায় তা অগস্ত্য... নৈবচ নৈবচ যে বিত্ত আমাকে তোমার দিকে নিয়ে যায় তা বিত্তহীন... নৈবচ নৈবচ যে অগ্নি আমাকে তোমার দিকে নিয়ে যায় তা দীপ্তিহীন... নৈবচ নৈবচ যে প্রাপ্তি আমাকে তোমার দিকে নিয়ে যায় তা অপ্রাপ্ত... নৈবচ নৈবচ যে শ্রান্তি আমাকে তোমার দিকে নিয়ে যায় তা অশ্রান্ত... নৈবচ নৈবচ! অন্তর্মুখী প্রেমে নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। কাব্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র ৬টি কাব্যগ্রন্থ গৃহপালিত পদ্যেরা, অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো, আদি অন্তে তোমাকে চাই, ভালোবাসার শাদাছড়ি এবং পোড়াবো তাজমহল বইগুলোতে ত্রিদিবের প্রেম ও দ্রোহ মূর্তমান! গুণীজনরা বলেন- পঞ্চাশের পর সৃজনশীল ব্যক্তির চেতনা জাগ্রত হয় পরিশীলিতভাবে ও সুচারুরূপে। সে সময় পাননি তিনি, মর্ত্যলোক ছেড়ে মাত্র ৫২ বছরে ঠাঁই হয়েছে তাঁর ত্রিদিবে! যদি পেতেন তাহলে ২০০৪ সাল থেকে আজ অবধি কমপক্ষে কাব্যপ্রেমিক ত্রিদিব দস্তিদারের গ্রন্থ সংখ্যা দাঁড়াতো ২৫। একাকীত্বের একান্ত বেদনায় ২০০৪ সালের ২৫ নবেম্বর অনেকটা নীরবে প্রস্থান সর্বজনগ্রাহ্য কবি ত্রিদিবের। ৩১ ডিসেম্বর কবি ও বীর মুিক্তযোদ্ধা ত্রিদিব দস্তিদারের জন্ম দিবস। কবির জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর অপ্রকাশিত কবিতাসহ সমগ্র রচনা একত্রে প্রকাশ করার জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই। কবি ত্রিদিব দস্তিদারের ৬৭তম জন্মবার্ষিকীতে কবির রচনাশৈলীর মতো আমিও বলছি ‘ভালোবেসে কি ফতুর করা যায়? ভালোবাসা ফতুর হয় না কখনো তবে আমি তোমাকে ভালো বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো।’
×