কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব বিশ্বাস, অন্তরঙ্গ অনুভব ও উপলব্ধি থেকে নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন কবিতার স্বরূপ। সে কারণেই ঈড়ষবৎরফমব, ড়িৎফংড়িৎঃয, শেলি বা মালার্মের মতো আরও অনেক কবি-সাহিত্যিকরা কবিতার প্রকৃত রূপ নিয়ে কখনই একমত হতে পারেননি। তাদের এসব বিরোধের মধ্যেই উঠে এসেছে নানান মতবাদ এবং কবিতার সংজ্ঞা নির্ণয়ের ঘনিষ্ঠ প্রয়াস। ডরষষরধস ড়িৎফংড়িৎঃয বিশ্বাস করতেন, কবিতা হবে... ‘ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং’ অর্থাৎ তার মতে ‘আন্তরিক অনুভূতি প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা থেকেই উৎসারিত হয় কবিতা।’ পাশাপাশি ঞযড়সধং ঐধৎফু মানতেন- ‘বসড়ঃরড়হং ঢ়ঁঃ রহঃড় সবধংঁৎব’ আবেগের শিল্পিত প্রকাশই হবে কবিতা। আবার ঞযড়সধং ঈধৎষুষব বিশ্বাস করতেন কবিতা আসলে সঙ্গীতময় চিন্তা [সঁংরপধষ ঃযড়ঁমযঃং] তিনি বিশ্বাস করতেন- ব্যক্তিগত অনুভব, উপলব্ধি কখনও কখনও অদৃশ্য কোন সুরের মূর্ছনায় নিরন্তর ছন্দময় হয়ে ওঠে আমাদের অন্তর মহলে, তার থেকেই বোধহয় জন্ম নেয় কবিতা। এ রকম অসংখ্য মতবাদের মধ্যে না গিয়ে আমরা বরং অৎপযরনধষফ গধপষবরংয-এর সেই অমোঘ উক্তিটিতেই ফিরে আসবÑ ‘অ ঢ়ড়বস ংযড়ঁষফ হড়ঃ সবধহ, ইঁঃ নব’ অন্য কিছু নয়, ‘হয়ে ওঠা’ ই কবিতার মূল শর্ত।
কবি নাহিদা আশরাফীর কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’ পুনর্বার হাতে নিতেই ‘অধরা মাধুরী’ কবিতা সম্পর্কে কাব্যজগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করা কি ভাবতেন সেই সব কথা সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের কয়েকজনের ভাবনার হাত ধরে নতুন করে আবিষ্কার করলাম এই কবিকে। ‘নতুন করে’ শব্দ দুটি ব্যবহার করলাম বিশেষ একটি কারণে। এই কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় প্রচ্ছদে কিছু লেখার সময়, পা-ুলিপিটি পড়েছিলাম বেশ কয়েকবার। এবার বইমেলায় বইটি হাতে পেয়ে আবার পড়তে গিয়ে মনে হলো নতুন করে নাহিদার কবিতা পড়ছি। মায়াময় মুগ্ধতামাখানো অসংখ্য পঙ্ক্তি ছড়িয়ে আছে এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায়। শেষ কবিতাতেই চোখ আটকে গেল প্রথমে...
‘ও কুয়াশা
শরীর বিছাও স্নানঘরের দেয়ালে।
ও শিশির
এসো স্নানের জলে মেশাব তোমায়।
ও সবুজ,
স্পর্শ বুনে চলো আপন খেয়ালে।
ও জীবন,
উষ্ণতা তোমায় ছুঁয়ে দেখতে চায়।’ [স্নানপর্ব]
অভিজাত আরশি থেকে উঁকি মারা মধ্যবিত্ত জ্যোৎস্না আর তারা-ভেজানো জলে সুখময় স্নানের মায়াবী অনুষঙ্গে এক অলৌকিক আবহ উপহার দিয়েছেন কবি। শেষ থেকে শুরু করেছিলাম... এবার প্রথম কবিতায় আসি। অনাবিল, অনবদ্য এক প্রেমের কবিতা- ‘হৃদয়হরণ পর্ব’ Ñ
‘তুমি চাইলেই
আইনস্টাইনকে দিয়ে লিখিয়ে নেব
এক শ তিয়াত্তরটি প্রেমের কবিতা।
আর রবিবাবু বানিয়ে দেবেন
আস্ত এক থিওরি অফ রিলেটিভিটি।
তুমি চাইলেই-
ভ্যানগগ বিটোফেনে তুলবে ঝড়।
গাইবে রাগ মল্লার বা ভৈরবী।
আর তোমার উপেক্ষিত হাসির বিনিময়ে
আমি লিখে দেব হৃদয়ের ভিটেমাটি।
প্রথম ও শেষ এই দুটি কবিতার সহজ, সরল, আত্মনিষ্ঠ ভাষা প্রকাশভঙ্গির মাধুর্য, নিয়ন্ত্রিত মগ্ন উচ্চারণে অবাক হয়েই তাঁর কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমরা, পাঠকেরা সকলেই জানি, শুধুমাত্র সত্যের প্রকাশ নয়, কবির উপলব্ধ সত্যকে বাস্তবের তুলনায় আরও অধিকতর সত্য করে তোলাই হয়ত কবির কাজ। দৃশ্যমান সত্যকে বোধ বা চৈতন্যের রং, খড়, মাটি দিয়ে তার সৃষ্টির মাধুর্যে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন কবি, এটাই স্বাভাবিক। কবি নাহিদা আশরাফীর কবিতায় অবগাহন করলে, এই সরল সত্যটি আবার সামনে দাঁড়ায়। নাহিদার একটি কবিতা ‘আমিহীন আমি’ Ñ
‘জলভরা দীঘির পুরোটাই দিতে হলো আকাশকে ।
বিনিময়ে চাঁদ এক রাতের জন্য আমার হলো।’
অথবা অন্য একটি কবিতা ‘জেগে ওঠা বসন্ত’
‘আস্ত একটা শীতকাল নিলামে তুলেছি।
সাথে তেইশটি হেমন্তের কুয়াশা।’
পরিশুদ্ধ আবেগের প্রেমময় অনাবিল আত্মিক প্রকাশ তাঁকে পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে ইতোমধ্যেই। দিনযাপনের দুঃখ-ক্লান্তি হতাশা মাখানো কিছু সুন্দর স্বপ্নিল কবিতা ছড়ানো রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। বিরহ বা বিষাদ তার কলমে মূর্ত হয় মুগ্ধ অবয়বে।
‘একখানা জিডি করব।
একটা নীল পাঞ্জাবি, এলোমেলো চুল
একজোড়া উথালপাতাল চোখ
আর একটা সর্বনাশা হাসির বিরুদ্ধে।’ [জিডি]
কিংবা,
বর্ষা এলেও তুই এলি না ঘরের দাওয়ায়।
তোর অভাবে কদম আভাও শূন্যে হারায়। ......
একটিবার তো আমায় নিয়ে ভাবতে পারিস হতচ্ছাড়া। [হতচ্ছাড়ার জন্য পঙ্ক্তিমালা]
বিরহমধুর উচ্চারণে কি অনায়াসে তিনি লিখতে পারেনÑ
‘ইচ্ছে করে ঠোঁটছুরিতে নিত্য আমি খুন হই
তোমায় নিয়ে লিখব বলে নির্মলেন্দু গুণ হই।’ [তোমায় নিয়ে লিখব বলে]
প্রত্যেক কবিই অর্জন করতে চান নিজস্ব ভাষা ও আঙ্গিক। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা অর্জনের প্রয়াসে সম্ভবত নাহিদা জেনেছেন সেই পরম সত্যটি কবিতার ভাষা যদি আপাত সরল না হয়, পাঠকের কাছে তা পৌঁছবে না কোনদিন। প্রথম পাঠে, কবিতার ভাষা যদি আকর্ষণ না করে পাঠককে, তাহলে কবিতার আত্মাও অধরা থেকে যাবে তাদের কাছে। এই প্রসঙ্গে ঞ.ঝ. ঊখওঙঞ বলেছিলেন- ‘ঊসড়ঃরড়হ ধহফ ভববষরহম ঃযবহ ধৎব নবংঃ বীঢ়ৎবংংবফ রহ ঃযব পড়সসড়হ ষধহমঁধমব ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব- ঃযধঃ রং, ওহ ঃযব ষধহমঁধমব পড়সসড়হ ঃড় ধষষ পষধংংবং...’ কবি নাহিদা আশরাফীর কবিতার ভাষা সরল এবং স্বতন্ত্র। অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় তিনি তৈরি করেছেন কবিতার মায়াবী শরীর। যা সতত উজ্জ্বল।
নানা প্রশ্ন এবং প্রতিপ্রশ্নের মধ্যে তার মায়াময় কলম খুঁজেছে ভালবাসা ও প্রাথিত প্রেমিকটিকে, অলৌকিক মন্ত্রের মত, সমপর্ণের পূর্বমুহূর্তে উচ্চারিত হয় কিছু মায়াশব্দ...
‘আকাশটাকে উল্টে দিতেই দিব্যি একটা ঝুড়ি হলো,
যার জঠরে এক পৃথিবী প্রেম সাজালাম
তোমার পায়ে লুটিয়ে দিতে।
ঝুড়িটা কি আনতে পারি?’
অনেক কবিতাতেই তিনি নারীদের বেদনা ও যন্ত্রণা জটিল জীবনের কথা বলেছেন, বলেছেন অসহায় শিশুদের কথা। সুখের কথা, তার সমস্ত উচ্চারণই কবিতার শর্ত মেনে...। শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রেমবিরহ, মিলনের আর্তিও মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কখনও কখনও কিছু নীরব আর্তনাদ। কবিতা মূলত শব্দেরই শিল্প। শব্দ জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় ভাষা। ভাষাকে গতি দেয় ছন্দ। বিষয়, ভাষা ও ছন্দের সহজাত মিশ্রণে অনুভূতির জগত থেকে জন্ম নেয় কবিতা। ছন্দ প্রসঙ্গে আব্দুল মান্নান সৈয়দ যথার্থই বলেছিলেন... ‘ছন্দ কবির বাহন নয়- ব্যক্তিত্ব’ ছন্দময় শব্দ ব্যবহারের সময় যে কোন কবিই সচেতন থাকেন শব্দের অন্তর্লীন স্রোতের সঙ্গে ছন্দের মিশ্রণ যেন পূর্ণতার ছোঁয়া দিতে পারে কবিতাকে। কবিতার সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করার আগে কবি নাহিদা আশরাফী যে দীর্ঘদিন ভাষা, ছন্দ ও শব্দনির্মাণের পাঠ নিয়েছেন, সন্ধান করেছেন সেই মায়াবী প্রকাশভঙ্গি, তা স্পষ্ট তাঁর প্রতিটি কবিতায়... প্রায় সমস্ত রকম ছন্দে তিনি প্রকাশ করেছেন নিজেকে। যে কবিতার শিরোনামে কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ সেই ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’ কবিতাটিতেই যাই-
‘ভালবাসা নয় কোনো পুঁথিপাঠ
নয় কোনো শব্দের অভিধান
হয়নি তো জানা আজ প্রেম কী
প্রেম জানে শুধু ওই পাখিপ্রাণ’
অথবা ‘জলগোলাপের চাষি’ র সুরেলা উচ্চারণÑ
মেঘবাড়িতে গোপন সভায়
মেঘফুলেদের মন্ত্রণা।
বর্ষা দুপুর জানান দিল
‘মানুষ আমি যন্ত্র না’
এমন অসংখ্য পঙ্ক্তি ছড়িয়ে আছে তাঁর কবিতায়। বিভিন্ন ছন্দে, নতুন ভঙ্গিতে, অনুপম ও অনিবার্য ভাষায় তিনি নিজেকে হাজির করেছেন পাঠকের দরবারে...।
যে কথাটি, আগেই লেখা জরুরী ছিল, সেটাই এখন বলে রাখি। আমি কাব্য সমালোচক নই, সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমি নিজের মতো করে নিজের মুগ্ধতার কথা, সামান্য হলেও জানিয়ে রাখলাম। নাহিদার কবিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে সম্যক আলোচনা করার মতো গুণী মানুষের অভাব নেই... শীঘ্রই, হয়ত সে সব চোখে পড়বে আমাদের। কবি ও পাঠকের মুগ্ধ বোঝাপড়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে কবিতার সার্থকতা। শব্দ, ভাষা, আঙ্গিকের পূর্ণ উপাচার নিয়ে কবি হয়ত পাঠকের চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে পারেনÑ শব্দহীন আলোয় আঁধারে নিঃশব্দ দরজা খুলে পাঠক কবিকে তাঁর অন্দর মহলে ডেকে নেবেন কিনা তা পাঠকের নিজস্ব বিচারের ওপরই নির্ভর করে।
মৃণাল বসুচৌধুরী