ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ॥ আবিষ্কার ও প্রযুক্তিতে সমতার বিশ্

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ৩ মার্চ ২০২৩

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ॥ আবিষ্কার ও প্রযুক্তিতে সমতার বিশ্

সম্পত্তিতে নারীদের বঞ্চনার ইতিহাস সেই বহু কালের

একজন গৃহবধূ ও তিন সন্তানের জননী। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করা এই মেধাবী নারীকে অধিকার আদায়ের বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। সাবলীলভাবে যা বললেন, মুগ্ধ হওয়ারই মতো। তিন সন্তান ছেলে কি মেয়ে এমন প্রশ্নের উত্তরই দিলেন না। সহজাত প্রবৃত্তিতে উত্তর এলোÑ আমি ৩ জনকেই সন্তান হিসেবে বড় করেছিÑ মানুষ ভাবতেও শিখিয়েছি। ৮ মার্চ নারী দিবস নিয়ে তার সুচিন্তিত বক্তব্য প্রাসঙ্গিক এবং এক প্রকার সচেতন দায়বদ্ধতা।

সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই নারী কোনো পেশায় সম্পৃক্ত না হওয়ার বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না। শুধু বললেন, অধিকারের মাত্রায় তো পারিবারিক আবহই যথেষ্ট। প্রতিটি পরিবার যদি নারীদের তাদের অধিকারটুকু দিয়ে দেয় তাহলে পুরো সমাজে সেটা প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে? সঙ্গত কারণে তা পরিবারেই প্রতিনিয়ত অভ্যাসে পরিণত করতে হবেÑ ক্রমান্বয়ে পুরো সমাজে সম্প্রসারিত হতে সময়ও নেবে না। তিনি মূলত তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই সব ধরনের অধিকার ও সমতা পেয়ে এসেছেন। বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও বঞ্চনার শিকারই হননি।

এদেশের চিরায়ত পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে অধিকার অর্জনকেও সেভাবেই ভেবেছেন। তিনি পেয়েছেনও সব। ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে একজন কন্যাশিশু প্রথম বঞ্চনার শিকার হয় তার নিজের পরিবারে। অন্য ঘরে যাওয়ার ব্যাপারে তো আরও পরেই আসে।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে চারুকলা বিভাগে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা দিলরুবা বিবাহিত ও এক সন্তানের মা। তবে ২১ শতকের দ্বিতীয় দশকের ক্রান্তিলগ্নে শিক্ষার্থী হিসেবে নারী দিবসের তাৎপর্য তার কাছে অনেকখানি পরিষ্কার। অনেক মেধা ও মনন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীরা এখনো পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে সেটাই উঠে এলো তার মতামতে। যে আদর্শ আর অধিকারের মাত্রায় নারী দিবস আন্দোলনে রূপ নেয় সেখানে আজও নারী পুরুষের বৈষম্য ঘুচেনি।

নারী শ্রমিকের বেলায় তো অনেকখানিই। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন বৈষম্য নেই সেটা যেমন ঠিক পাশাপাশি বিভিন্ন নারী হরেক অসাম্যের শিকার হতেও এগিয়েই থাকে। নারী দিবসের মহান তাৎপর্যে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয় থাকলেও সেভাবে অর্জিত না হওয়ার চিত্রও সুখকর নয়। যেমন আগের মতো আর যৌথ পরিবার নেই। আধুনিকতার নির্মাল্যে তা সম্ভবও নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের শিক্ষিত ও সক্ষম মায়েরা সন্তান বাসায় রেখে চাকরি করা কঠিনতম পর্যায়।

যদিও সব প্রতিষ্ঠানেই ‘শিশু দিবা যতœ কেন্দ্র’ থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও চাকরিজীবী মায়েদের তুলনায় সংখ্যা এত অপ্রতুল যাতে মায়েরা কর্মজীবী হতেও সাহস পাচ্ছেন না। তবে দিলরুবা বলেনÑ নারী পুরুষের শ্রম মজুরিতে যে তারতম্য যার কারণে নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে বাধ্য হয় সেটা এখনো সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে কৃষি নারী শ্রমিক, নির্মাণ নারী শ্রমিক ও পোশাক নারী শ্রমিকরা এখনো তার পুরুষ সহকর্মীর চাইতেও কম মজুরি পানÑযা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ও কাক্সিক্ষত নয়। এমন সব নিত্য বিভাজন দূর না হলে নারী দিবস তার প্রত্যাশিত অবস্থান থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে পারে। এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব সময়ের জন্য অপরিহার্য। শুধু নির্দিষ্ট দিনে তাকে আটকে রাখা যাবে না।

বিশিষ্ট আইনবিদ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার কাছ থেকে জানা গেছে অনেক। প্রথমেই জানালেন- এবারের নারী দিবসের বিশেষ বার্তা। যেহেতু আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্যে এগিয়ে চলেছি- সেখানে আবিষ্কার ও প্রযুক্তির বিশ্বে সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ই এবারের অঙ্গীকার। নারী নেত্রী ও আইনজ্ঞ হিসেবে প্রযুক্তির বলয়ে হরেক অপরাধ প্রবণতা এবং নারীদের বিভিন্নভাবে বিপদে, ফাঁদে ফেলার অপতৎপরতা সেসব বিষয়ও সামনে নিয়ে আসেন। অপরাধ চক্রকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে নারী সমাজকে নিশ্চিত ও স্বস্তিকর জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে আইনি কার্যক্রমও অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া নারীদের সম্পত্তিতে সমঅধিকার নিয়ে আসাও অনন্য কর্ম পরিকল্পনা। 
সম্পত্তিতে নারীদের বঞ্চনার ইতিহাস সেই বহু কালের। আজও তার সুষ্ঠু সমাধান অদৃশ্য। এখান থেকেও সমসংখ্যক নারীকে মুক্ত করাও নারী দিবসের বিশেষ তাৎপর্যে উঠে আসে। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে নারী আন্দোলনকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করা সময় ও যুগের চাহিদা। আবিষ্কার ও প্রযুক্তিতে নারীদের সুদক্ষভাবে তৈরি হতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণও অত্যন্ত জরুরি। এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সচেতন দায়বদ্ধতায় আমলে নিয়ে নারী অগ্রগতির ধারাকে আরও শক্ত ও প্রাসঙ্গিক করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। 
সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় কোনো একটি অংশকে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। তাহলে অধিকার, আন্দোলন সবই তার যথার্থতা হারাবে। পারিবারিক সম্পত্তিতে লিঙ্গসমতা আনা অপরিহার্য। প্রয়োজনে তা সংস্কার করাও একান্ত জরুরি।
কেবল একজন উদীয়মান সংবাদকর্মিই শুধু নন বরং একটি সাপ্তাহিক নারী কাগজ ‘আমার গৌরব’ এর সম্পাদকও। নিজের অক্লান্ত চেষ্টা ও পরিশ্রমের কারণে আজ একটি জায়গা করতে পেরেছেন। বাল্য বিয়ের শিকার আফরোজা অতি অল্প বয়সে মাও হয়েছেন, ২ কন্যা সন্তানের মা বললেন মেয়েদের বড় করছেন মানুষ হিসেবে। চারপাশের হরেক ঝড়ঝঞ্ঝা সামলিয়ে নিজেকে তৈরি করা অত সহজ ছিল না। সেখানে সাংবাদিকতার জগৎও কঠিনকে অতিক্রম করার মতোই।

তবে তিনি হেঁটে চলেছেন নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ। তার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে নারী দিবসের প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্ভার নিয়ে। অনেকের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আফরোজা জানান, সার্ধশত বছর অতিক্রম করা এই দিন আজও তার পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমকে সেভাবে সফলতায় ভরিয়ে তুলতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। সেখানে ব্যক্তিক ক্ষমতাকে আরও জোরদার করতে হবে। যাতে সামষ্টিক বাধাকে পার করা যায়। তিনি যেমন করেছেন। রক্ষণশীল সমাজ কখনো সব কিছু হাতের মুঠোয় এনে দেয় না। লড়াই করে লক্ষ্যে পৌঁছানো জীবনের অবধারিত অঙ্গীকারনামায় নিয়ে আসতে হবে।

নিজেকে শক্ত হাতে চারপাশের অভিশাপ ও জঞ্জাল মুছে দিতে হবে। দুই কন্যাকেও সেভাবে তৈরি করার অনন্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। মান্ধাতা আমলের সমাজ সংস্কার এখনো নারীর সামনে এগিয়ে যাবার যাত্রাকে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। সব আবর্জনা উপড়ে ফেলে নিজেকে জোর কদমে এগিয়ে নিতে হবে। এমন অনুপ্রাণিত বোধ সব নারীর মধ্যে জিইয়ে থাকাও পরিস্থিতির নিয়ামক শক্তি। নারীদের লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত- আর একটা মাত্র দিনের তাৎপর্যে তা বেঁধে রাখা ঠিক নয়। এটা দৈনন্দিন চর্চা করার একটা গুরুদায়িত্ব। সেটাই সংশ্লিষ্টদের সব সময় করে যেতে হবে।

×