
ছবি: প্রতীকী
জীবনের ব্যস্ততায় আপনি হয়তো টেরও পান না, কখন যে আপনার চারপাশের জগৎটা ছোট হতে শুরু করেছে—রাস্তায় হাঁটা কমে গেছে, অফিসে যাওয়ার দিন কমেছে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার প্ল্যান একের পর এক বাতিল হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্ল্যান করতে করতে তা ধীরে ধীরে ভেস্তে যাচ্ছে, কেউ ঠিক করতে পারছে না নির্দিষ্ট দিন বা স্থান।
এমন অবস্থায় আপনি হয়তো হালকা বিষণ্ণতা বা সংযোগ বিচ্ছিন্নতার অনুভব করতে পারেন। বদলে যেতে পারে অভ্যাস ও মেজাজ। কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন—আপনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন?
অনেকেই এই ‘নিঃসঙ্গ’ শব্দটির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন না, বিশেষ করে যখন তাদের বন্ধু আছে বা তারা সুখী একটি সম্পর্কে রয়েছেন। কিন্তু নিঃসঙ্গতা মাঝেমধ্যে আমাদের সবার জীবনে এসে পড়ে। আর সেটি বুঝতে পারাই এর থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ।
নিঃসঙ্গতা আসলে কী?
নিঃসঙ্গতা হলো এমন এক মানসিক কষ্ট, যা তখন হয় যখন আমাদের সম্পর্কগুলো মান ও পরিমাণ—দুই দিক থেকেই আমাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। এটা একা থাকা নয়, বরং সংযোগের অভাব। আপনি হয়তো বন্ধুদের মাঝে থেকেও নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন, আবার একা থেকেও একদম শান্তিতে থাকতে পারেন।
এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয়। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তারা নিঃসঙ্গ, যতক্ষণ না এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে।
কীভাবে বুঝবেন আপনি নিঃসঙ্গ?
শরীরেও আপনি নিঃসঙ্গতার প্রভাব টের পেতে পারেন—ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব, শূন্যতা বা ভিতরটা ফাঁকা লাগা। কেউ কেউ বলেন, মনে হয় শরীরের কোনো অঙ্গ হারিয়ে ফেলেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক ব্যথা (যেমন নিঃসঙ্গতা) মস্তিষ্কে শারীরিক ব্যথার মতোই অনুভূত হয়।
আচরণগত লক্ষণ:
- দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন
- ঘুমাতে সমস্যা হওয়া বা ঘুম ভেঙে যাওয়া
- খাওয়াদাওয়ায় পরিবর্তন (অতিরিক্ত খাওয়া, কম খাওয়া বা একঘেয়ে খাওয়া)
- যেসব কাজ একসময় উপভোগ করতেন, সেগুলো এড়িয়ে চলা (যেমন—ব্যায়াম ক্লাস, সিনেমা, খেলাধুলা ইত্যাদি)
মানসিক অনুভূতি:
- দীর্ঘস্থায়ী মন খারাপ বা দুঃখবোধ
- ক্লান্তিভাব
- সংযোগ বিচ্ছিন্ন লাগা
- অন্যদের মাঝে থেকেও ‘আমি এই জায়গার কেউ না’ এমন অনুভব
- প্রত্যাখ্যান বা সমালোচনায় অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা
কিন্তু মনে রাখবেন—আপনি একা নন, আপনি ‘ভাঙা’ নন। নিঃসঙ্গতা হচ্ছে একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
নিঃসঙ্গতা আমাদের ব্রেইনের ‘সতর্ক সংকেত’
প্রয়াত মার্কিন স্নায়ুবিজ্ঞানী জন ক্যাসিওপো নিঃসঙ্গতাকে বিবর্তনের অংশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অতীতে ‘গোত্র’ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই ছিল বিপদ। তাই মস্তিষ্ক এমন এক কষ্ট তৈরি করেছে, যা মানুষকে আবার সংযোগের দিকে ঠেলে দেয়। নিঃসঙ্গতার ব্যথা আমাদের নিরাপদ রাখার একটি অ্যালার্ম সিস্টেম।
আধুনিক সমাজে এখনো নিঃসঙ্গতা স্বীকার করাটা অনেকের কাছে ‘দুর্বলতা’ মনে হয়। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এটা আরও বেশি। কেউ কেউ ভাবেন, নিঃসঙ্গ মানে আমি ‘হেরে গেছি (loser)’। এই মানসিকতা মানুষকে চুপ করে থাকতে বাধ্য করে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে।
দীর্ঘস্থায়ী নিঃসঙ্গতার ঝুঁকি কী?
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী নিঃসঙ্গতা—
- হতাশা
- উদ্বেগ
- রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস
- হৃদরোগ
- অকাল মৃত্যু—এসবের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
এছাড়া, এটি একটি চক্রে পরিণত হয়। আপনি বারবার প্রত্যাখ্যানের ভয় পান, সম্পর্ক এড়িয়ে চলেন, ফলে আপনি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
সম্পর্ক, চাকরি, বন্ধু—সবই আছে, তবু কেন নিঃসঙ্গ?
কারণ এটি শুধু মানুষের সংখ্যা নয়, মানসম্পন্ন সংযোগের বিষয়। আপনার জীবনে বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে, কিন্তু গভীর সংযোগ, অভিন্ন পরিচয়বোধ বা কমিউনিটির অভাব থাকলে আপনি নিঃসঙ্গ বোধ করতেই পারেন।
এখন আপনি বুঝেছেন আপনি নিঃসঙ্গ। তাহলে কী করবেন?
প্রথমেই ভাবুন—কোন ধরনের সংযোগের অভাব বোধ করছেন?
- একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
- একজন জীবনসঙ্গী?
- সাধারণ সামাজিক মেলামেশা?
- কোনো সম্প্রদায় বা উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজ?
তারপর মনে করুন—আগে কী করলে আপনি বেশি সংযুক্ত অনুভব করতেন? হয়তো কোনো ক্লাব বা সংগীতে যোগ দেওয়া, খেলাধুলা, স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রম, বা দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে আলাপচারিতা—এসব ছোট ছোট বিষয়ই হতে পারে শুরুর পথ।
যদি তাতেও সমাধান না হয়, তবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
নিঃসঙ্গতার সামাজিক কাঠামোগত কারণও আছে
সবসময় এটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বা মানসিক অসুস্থতার ফল নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এলাকার খারাপ পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, কাজের চাপ, সামাজিক রীতিনীতি, এমনকি কোভিড-পরবর্তী সময়ের প্রভাবও মানুষের নিঃসঙ্গতার পেছনে দায়ী।
এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনও সামাজিক সংযোগের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে—গরমের তীব্রতা, দাবানল বা দুর্যোগ এড়িয়ে চলতে গিয়ে মানুষ আরও আলাদা হয়ে পড়ছে।
কথা বলুন, নিজের ভেতরের কষ্ট স্বীকার করুন
নিঃসঙ্গতা মানবিক, স্বাভাবিক এবং প্রতিকারযোগ্য। নিজে বুঝুন, অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করুন—তাহলে একে অপরের নিঃসঙ্গতা কিছুটা হলেও কমে যাবে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন।
রাকিব