ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

সম্পর্ক মধুর কিন্ত লড়াই গভীর! ইন্টারনেট সেন্সরশিপ লড়াইয়ে কে জিতবে মাস্ক না মোদী?

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৬ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ১৬:৫৪, ৬ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্ক মধুর কিন্ত লড়াই গভীর!  ইন্টারনেট সেন্সরশিপ লড়াইয়ে কে জিতবে মাস্ক না মোদী?

ছবি: জনকণ্ঠ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ধনকুবের ইলন মাস্কের মধ্যে এক নিঃশব্দ কিন্তু শক্তিশালী সংঘর্ষ চলছে—মাঠ হলো সোশ্যাল মিডিয়া, আর ইস্যু হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘X’ (আগের টুইটার) ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছেন। অভিযোগ—সরকার ‘X’–এ প্রকাশিত বহু পোস্ট মুছে ফেলার জন্য চাপ দিচ্ছে, আর এতে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার খর্ব হচ্ছে।

❝ এক পোস্ট, এক তোলপাড় ❞
২০২৩ সালে ‘X’-এ একটি পোস্টে ভারতের শাসকদলের এক নেতাকে “অপ্রয়োজনীয়” বলা হয়। পোস্টটি করেছিল এক গৌণ অ্যাকাউন্ট, যার অনুসারী ছিল মাত্র কয়েকশ। কিন্তু মহারাষ্ট্রের সাতারার পুলিশ সেটিকে এতটাই বিপজ্জনক মনে করে যে, বলে—এটা “সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা” ছড়াতে পারে।

এমন অসংখ্য পোস্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ভারত সরকার বিভিন্ন সময় ‘X’–কে চাপ দিয়েছে মুছে ফেলার জন্য। মাস্কের প্রতিষ্ঠান এসব নির্দেশকে "অসাংবিধানিক ও অবৈধ" বলে দাবি করে। মার্চ ২০২৫-এ তারা সরাসরি কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলা করে।

❝ ‘সহযোগ’ পোর্টাল: নিয়ন্ত্রণের নতুন অস্ত্র ❞
আগে কেবল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কিংবা আইটি মন্ত্রণালয়ই অনলাইন কনটেন্ট মুছতে বলত। কিন্তু ২০২৩ সালে মোদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয়—পুলিশ থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি সংস্থা এখন সরাসরি পোস্ট অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে।

এরপর ২০২৪ সালের অক্টোবরে চালু হয় ‘সহযোগ’ নামের একটি ওয়েবসাইট, যাকে ‘X’ বলছে—একটি “সেন্সরশিপ পোর্টাল”।

এই পোর্টালে গিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা সহজেই কোনো কনটেন্ট মুছে ফেলার অনুরোধ পাঠাতে পারেন। কিন্তু ‘X’ এতে যোগ না দিয়ে উল্টো আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।

❝ ব্যঙ্গচিত্র, মুদ্রাস্ফীতি আর ‘লাল ডাইনোসর’ ❞
রয়টার্সের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ভারত সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় ১৪০০টি পোস্ট সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ‘X’–কে।

এর মধ্যে যেমন রয়েছে ভুয়া খবর ও শিশু নির্যাতনের মতো গুরুতর বিষয়, তেমনি রয়েছে ব্যঙ্গচিত্র, রাজনৈতিক সমালোচনা ও খবর প্রকাশের পোস্ট—যা আসলে গণতন্ত্রে একেবারেই স্বাভাবিক চর্চা।

উদাহরণস্বরূপ, চেন্নাই পুলিশ এক ব্যঙ্গচিত্র মুছে ফেলতে বলে যেখানে মোদির সঙ্গে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা যায় মুদ্রাস্ফীতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা এক বিশাল লাল ডাইনোসরের সঙ্গে লড়তে। আরেকটি ব্যঙ্গচিত্রে বন্যা মোকাবেলায় ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়। পুলিশ বলছে, এসব পোস্ট "উসকানিমূলক"।

অন্যদিকে রেল মন্ত্রণালয় চেয়েছে, দিল্লি স্টেশনে পদদলিত হয়ে ১৮ জন নিহত হওয়ার খবর সরানো হোক—এমনকি সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির রিপোর্টও মুছে ফেলতে বলা হয়েছে।

❝ নিজের দলে আঘাত, বাকস্বাধীনতার সংকট ❞
মজার বিষয় হলো, শুধু বিরোধীদের নয়—সরকারের সমর্থকরাও এই সেন্সরশিপের শিকার হচ্ছেন। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী মমতা ব্যানার্জির একটি ব্যঙ্গাত্মক ছবি পোস্ট করেছিলেন, যেটি নিয়েও পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে। যদিও পোস্টটি এখনো অনলাইনে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের সেন্সরশিপ গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সুব্রামানিয়াম ভিনসেন্ট বলেন,

“সরকার নিজে যদি ঠিক করে দেয় কোন কনটেন্ট বেআইনি, এবং সেই হিসেবে পোস্ট মুছে দেয়—তবে তা ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।”

❝ মাস্ক বনাম মোদি: সম্পর্ক রয়ে গেছে, কিন্তু লড়াই গভীর ❞
ইলন মাস্ক নিজেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একজন নির্ভীক সমর্থক হিসেবে পরিচিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে সরকারের সঙ্গে লড়েছেন কনটেন্ট নিয়ে।

ভারতের ক্ষেত্রেও তিনি পিছু হটছেন না। যদিও মোদি ও মাস্কের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে এখনো ভালো সম্পর্ক রয়েছে—এই আইনি লড়াই একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে:
ভারতের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি আজ নিরাপদ?


মোদি সরকারের কঠোর সেন্সরশিপ নীতির বিরুদ্ধে ইলন মাস্কের 'X'–এর আইনি লড়াই এখন এক নজিরবিহীন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সরকারি নজরদারি, ‘সহযোগ’ পোর্টাল, ব্যঙ্গচিত্র ও সংবাদ রিপোর্ট সরানোর চেষ্টাগুলো সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে—ভারতের অনলাইন জগতে মতপ্রকাশের অধিকার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে।
 

মারিয়া

×