ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

অপরাজিতা

সমুদ্র পাড়ের পথকন্যা

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ১৭ জুলাই ২০২৫

সমুদ্র পাড়ের পথকন্যা

সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সমুদ্র। নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকতের নাম কক্সবাজার। সমুদ্রের নীল জলরাশি যে কোনো মানুষের মন কাড়বে। এই সুন্দর প্রকৃতি বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। অপরূপ সুন্দর বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত এটি। কক্সবাজার গেলে সকালে-বিকেলে সমুদ্র তীরে বেড়াতে মন চাইবে। সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে শুধু মানুষ আর মানুষ। পর্যটকরা সমুদ্র তীরজুড়ে প্রতিদিন মেতে থাকে আনন্দ-উল্লাসে। মনোরম সৈকতে লাখ লাখ মানুষের ঢল দেখে অবাক হয়ে যান ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। প্রকৃতির অপরূপ রূপে হারিয়ে যায় সকলে। এসব সৈকতে শত শত শিশু প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ছেলে শিশুর পাশাপাশি মেয়ে শিশু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই সব সি বিচে কাজ করে। এর মধ্যে এই শিশুরা কেউ পানি, কেউ ঝিনুকের মালা, কেউ চকোলেট চিপস, কেউ ঘোড়া দিয়ে পর্যটকদের ঘোরাচ্ছে আর কেউ পর্যটকদের ছবি তোলার কাজ করছে, কেউ খেলনা বিক্রি করছে। এদের মধ্যে মেয়ে শিশুদের দিয়ে অনেক পর্যটক মাদক আনা-নেওয়ার কাজ করার অভিযোগ করে।  
সুগন্ধা সি বিচে পানি বিক্রি করছে কক্সবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শিশু ফারজানা। তার বাড়ি শহরের দক্ষিণ বোনার পাড়া এলাকায়। তারা দুই ভাই বোন। বাবা মহিউদ্দিন মারা গেছে কয়েক বছর আগে। মা কহিনূর বেগম একা সংসার চালাতে পারছেন না। প্রতিদিন স্কুল শেষে বিচে এসে বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পানি বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার ও তার পড়াশোনার খরচ চালায়। 
মাহিনা বেগম উপকুনিয়া বেসরকারি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। অভাবের কারণে তার পড়াশোনা হয়নি। তারা তিন ভাই-বোন। শহরের সমিতি পাড়ার ১নং ওয়ার্ডে তার বাড়ি। বাবা আবদুর রশিদ মা সেলিনা বেগম। অসুস্থ বাবাকে সহায়তা করার জন্যই কাজ করছে বিচে। চরম অভাবের সংসার তাদের। করোনার সময় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় তার। বাধ্য হয়ে সুগন্ধা বিচে পানি চিপস ও চকোলেট বিক্রি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আয় করে। একই এলাকার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী হ্যাপি সংসারের অভাবের কারণে এক বছর আগে থেকে ঝাল মুড়ি আর পানি বিক্রি করছে। উপকুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী মাহিয়া পানি বিক্রি করে যে আয় করে তা দিয়ে চলে তাদের সংসার। কক্সবাজার শহরের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী সৈকত পয়েন্টে প্রায় শতাধিক মেয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জীবনের প্রয়োজনে সারাদেশে থেকে আসা পর্যটকদের কাছে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। নানা সময় হয়রানি ও মানসিক নির্যাতিত হলেও নীরবে সব কিছু সহ্য করে তারা। এদের আয়ের ওপর তাদের সংসারের মানুষগুলো নির্ভর করে অনেকাংশে।  
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার শুঁটকি পল্লিতে কর্মরত ১৪ হাজার ৩৬৬ জনের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী, ১৭ শতাংশ পুরুষ এবং ২০ শতাংশ শিশু কাজ করে। শিশুদের মধ্যে আবার ৭২ শতাংশ মেয়ে শিশুশ্রমে জড়িত। শ্রমে জড়িত ৫৯ শতাংশ শিশু ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে আর ১৪ বছরের নিচে রয়েছে শতকরা ৪১ জন।  
জরিপে আরও দেখা যায়, ২৩ শতাংশ শিশুকে জোরপূর্বক শিশুশ্রমে জড়ায় তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ ছেলে শিশু আর ১৯ শতাংশ মেয়ে শিশু। এদের মধ্যে যৌন হয়রানির তথ্যও পাওয়া যায়। কিন্তু এসব নিরসনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 
দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় কক্সবাজারে শিশুশ্রম হচ্ছে বেশি। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া এবং বিষ মিশানো শুঁটকি পল্লিতে শ্রম দিচ্ছে শিশুরা। এটা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানলেও এ শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যার ফলে শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে প্রায় পড়ে এ শিশুরা। অকালে তাদের জীবন পর্যন্ত ঝরে যায়।  
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার শুঁটকি পল্লিতে কর্মরত ১৪ হাজার ৩শ’ ৬৬ জনের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী, ১৭ শতাংশ পুরুষ এবং ২০ শতাংশ শিশু কাজ করে। শিশুদের মধ্যে আবার ৭২ শতাংশ মেয়ে শিশুশ্রমে জড়িত। এদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। 
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও মহেশখালী, কুতুবদিয়া সোনাদিয়া মাতারবাড়ি, শাহপরী, সেন্টমার্টিন, মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর, হিমছড়ি ঝরনা, পাথুরে সৈকত ইনানী-পাটুয়াারটেক, টেকনাফ সমুদ্র সৈকত, নেচার পার্ক, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, রামুর বৌদ্ধ পল্লিসহ কক্সবাজারকে করেছে আরও আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। ভ্রমণবিলাসী পর্যটকরা এসব এলাকায় প্রতিদিন যায়। এখানেও মেয়ে শিশুরা প্রতিনিয়ত সকালে থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে। তাদের আয়ে চলে সংসার। স্থানীয়রা বলছেন এসব শিশু বিভিন্ন সময় পর্যটকসহ অনেকের কাছে নানা রকম হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়। তখন তাদের দেখার কেউ থাকে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। 

প্যানেল/মো.

×