
প্রতীকী ছবি
বার্ধক্য এমন একটি ধাপ, যা নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। এর মধ্যে একটি হতে পারে বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা। আপনি জানেন, যখন মনে হয় আপনার মস্তিষ্ক আর আগের মতো তীক্ষ্ণ নেই। আমরা সবাই এমন দিন পার করি যখন মনে থাকে না গাড়ি কোথায় রেখেছি বা পুরনো কোনো পরিচিতের নাম মনে করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এটা কখন গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অভ্যাস বুদ্ধিবৃত্তিক পতনের কারণ হতে পারে এবং আমাদের মধ্যে অনেকেই এ সম্পর্কে সচেতন নই। মনোবিজ্ঞান এই অভ্যাসগুলো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয় এবং সেগুলো কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করতে পারে তা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। চলুন এই ৯টি অভ্যাস সম্পর্কে জেনে নিই:
১. আপনি আপনার নিজস্ব পথে আটকে আছেন:
বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধির জন্য নমনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও রুটিন এবং নীতিগুলো আমাদের ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস বা অভ্যাসে খুব বেশি কঠোর হওয়া আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিকে সীমিত করতে পারে। জীবন সর্বদা নতুন অভিজ্ঞতা এবং শেখার সুযোগ দেয়। তবে পরিবর্তন প্রতিরোধ করা স্থবিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
শুধুমাত্র কাগজে ছাপা বই পড়তে পছন্দ করা এবং ই-বুক এড়িয়ে চলা হয়তো জ্ঞানের একটি বড় উৎস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছে। এটি আপনার প্রিয় অভ্যাস পরিত্যাগ করার বিষয়ে নয়, বরং যেখানে প্রয়োজন, সেখানে নমনীয়তা গ্রহণ করা এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো। পরিবর্তনের প্রতি প্রতিরোধ আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে।
২. আপনি আপনার মস্তিষ্ককে অনুশীলন করাচ্ছেন না:
যেভাবে শারীরিক ব্যায়াম আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে, তেমনি মানসিক ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্ককে তীক্ষ্ণ রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিউরোপ্লাস্টিসিটি অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিজেকে পুনর্গঠন করার ক্ষমতা, উদ্দীপনার উপর নির্ভরশীল।
পাঠ্য পড়া, ধাঁধা সমাধান বা নতুন দক্ষতা শেখার মতো কাজগুলো মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করে এবং এর স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। যদি আপনি নিয়মিত মানসিক উদ্দীপনামূলক কার্যকলাপে জড়িত না থাকেন, তবে আপনি নিজের অজান্তেই বুদ্ধিবৃত্তিক পতনের দিকে অগ্রসর হতে পারেন।
৩. আপনি বিশ্রামের শক্তিকে উপেক্ষা করছেন:
সাধারণ বিশ্বাসের বিপরীতে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ রাখতে সর্বদা সক্রিয় থাকা প্রয়োজন নয়। বিশ্রাম বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধির জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ঘুম শুধুমাত্র শারীরিক বিশ্রামের জন্য নয়; এটি দিনের তথ্যগুলোকে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, দিনের মধ্যে নিয়মিত বিরতি নেওয়া, মননশীলতা অনুশীলন করা বা কেবল মনের ঘোরাঘুরি করাও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে। তবে, বর্তমানে প্রচলিত ‘ব্যস্ততার’ সংস্কৃতিতে বিশ্রামকে প্রায়শই অবমূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু যদি আপনি নিজের জন্য বিশ্রাম এবং প্রতিফলনের সুযোগ না দেন, তবে আপনি অজান্তেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারেন।
৪. আপনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া অবহেলা করছেন:
আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে বন্ধুদের সাথে দেখা করা বা সামাজিক ইভেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য আপনার সময় নেই? ব্যস্ত জীবনে, কাজ বা বিশ্রামের কারণে সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে উপেক্ষা করা সহজ। তবে একটি তথ্য আপনার চিন্তা বদলাতে পারে। সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
অন্যদের সাথে জড়িত হওয়া মস্তিষ্ককে অনন্য উপায়ে উদ্দীপিত করে। কথোপকথন আমাদের দ্রুত চিন্তা করতে, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে এবং এমনকি পৃথিবী সম্পর্কে নতুন কিছু শিখতে চ্যালেঞ্জ জানায়।
৫. আপনি শরীরকে পুষ্টি দিচ্ছেন, কিন্তু মনকে ক্ষুধার্ত রাখছেন:
‘আপনি যা খান, তাই আপনি’ এই প্রবাদটি আপনার মনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সঠিক পুষ্টি আমাদের জ্ঞানীয় কার্যকারিতার উপর বড় প্রভাব ফেলে। অপুষ্টি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক দক্ষতার অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে, নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ একটি খাদ্য আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা বাড়াতে পারে।
৬. আপনি নতুন প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন:
নতুন প্রযুক্তি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং আপনি ঠিক কোন একটি বিষয় আয়ত্ত করেছেন, তখনই নতুন কিছু চলে আসে। এটি যেকোনো মানুষকে পরিচিত জিনিসের সাথে লেগে থাকতে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু এখানে বিষয়টি হল, নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলা আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শুধু নতুন ডিভাইস বা সফটওয়্যার ব্যবহার শেখার মাধ্যমেই মস্তিষ্কের চ্যালেঞ্জ হয় না, এটি আমাদের আশেপাশের বিশ্বের সাথে সংযুক্ত রাখে।
৭. আপনি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি এড়িয়ে চলছেন:
ধরা যাক, আপনি একটি পার্টিতে আছেন এবং কেউ এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে যা সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। আপনি কি কথোপকথনে জড়িত হন এবং শিখতে চেষ্টা করেন, নাকি চুপচাপ সরে যান? চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হতে পারে। এটি আমাদের আরামের জোন থেকে বের করে এবং আমাদের অসহায় বোধ করতে পারে। কিন্তু এটি বৃদ্ধি অর্জনের জন্য মূল্যবান সুযোগও প্রদান করে।
৮. আপনি শারীরিক কার্যকলাপ অবহেলা করছেন:
আমি যখন প্রথম দৌড়ানো শুরু করি, তখন আমার ফিটনেস ভালো ছিল না এবং এটি একটি কঠিন কাজ মনে হয়েছিল। কিন্তু এটি চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি একটি আকর্ষণীয় বিষয় লক্ষ্য করেছিলাম। শুধু আমার শরীরই শক্তিশালী হচ্ছিল না, আমার মনও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। এটি শুধু আমার কল্পনা নয়। নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাড়ায়, স্ট্রেস এবং উদ্বেগ কমায় এবং এমনকি নতুন মস্তিষ্ক কোষ উৎপন্ন করতে সাহায্য করে।
৯. আপনি আজীবন শেখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না:
যারা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েন তারা প্রায়ই শেখা বন্ধ করে দেন। আজীবন শেখা বুদ্ধিবৃত্তিক তীক্ষ্ণতা বজায় রাখার চাবিকাঠি। এটি শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে নয়, বরং কৌতূহল বজায় রাখা এবং নতুন কিছু শেখার ইচ্ছার বিষয়ে। বিশ্ব সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং এর বোঝাপড়া বাড়ানোর সুযোগ অফুরন্ত। তাই নতুন কোনো শখ গ্রহণ করা, বহুমুখী পাঠ করা বা এমন একটি বিষয়ে কোর্স করা যা সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না- শেখার সুযোগকে গ্রহণ করুন।
এম হাসান