ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

ভারতীয় নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশীদের তথ্য

জাহিদুল ইসলাম ॥

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ৯ আগস্ট ২০২৫

ভারতীয় নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশীদের তথ্য

নিজ দেশ ভারতে আধার কার্ড প্রকল্পে আজীবন নিষিদ্ধ, আফ্রিকার কেনিয়াতে কোম্পানির ৯ পরিচালকের বিরুদ্ধে ঝুলছে গ্রেফতারি পরোয়ানা, ঘুষ ও অনিয়মের মাধ্যমে কাজ পাওয়ার অভিযোগ আছে শ্রীলঙ্কাতেও। এমনকি অভিযোগ আছে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিক্রির। এরপরও সেই কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই তথ্য। ফলে দেশের নাগরিকসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আইটি খাত সংশ্লিষ্টরাসহ নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, ডিজিটাল স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের জন্য ২০১৬ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সঙ্গে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই চুক্তি শেষ হওয়ার তারিখ ছিল ২২ জুন, ২০২১। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের (এমএসপি) সঙ্গে চুক্তি করে বিআরটিএ। কিন্তু কী কারণে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বহাল থাকাবস্থায় নিষিদ্ধ অপর প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিতে হলো — সে সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই রয়েছে নিষেধাজ্ঞা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা। এছাড়া চুক্তির পর ব্যর্থতা ও বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনাও রয়েছে। এরমধ্যে কেনিয়াতে এমএসপি জাল ট্যাক্স স্ট্যাম্পের কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল। ফলশ্রুতিতে বিষাক্ত ও নকল সার এবং চিনি সহ বিভিন্ন পণ্য কেনিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে সেখানে জনস্বাস্থ্য সংকট এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটায়। এতে এমএসপি’র বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও হয়, যা এখনো চলমান। কেনিয়াতে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে কোম্পানির ৯ জন পরিচালকের বিরুদ্ধে।

দক্ষিণ সুদানে লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয়ের পর এমএসপি কর্তৃক তৈরিকৃত একটি ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবস্থা কখনোই কার্যকর করা যায়নি। এদিকে নেপালে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে নিম্নমানের ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ ও ব্ল্যাকমেইলিং করেছিল বলে জানা যায়। ঘুষ-অনিয়মের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে শ্রীলঙ্কাতে। এছাড়া লাইবেরিয়া ও মরিশাসেও একই ধরনের ব্যর্থতা, ঘুষ, চুক্তি লঙ্ঘন ও তথ্য ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে।

খোদ নিজের দেশ ভারতের আধার কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে এমএসপিকে কালো তালিকাভুক্ত করে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। তাদের বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়াই নাগরিকদের তথ্য বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছিল। তেলেঙ্গানার সামাজিক সুরক্ষা সেবা “মিসেভা” প্রকল্প থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না কোম্পানিটি।

অথচ বিতর্কিত এই কোম্পানিকেই ১২০ কোটি টাকার ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ দিয়েছে বিআরটিএ। সেই সঙ্গে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয় নাগরিকের সকল সংবেদনশীল তথ্য। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিয়ে স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের আমলে চারবার সংশোধন করা হয়েছে দরপত্রের শর্ত।

বিআরটিএ’র দরপত্রের একটি শর্ত ছিল যে, ৫ বছরের মধ্যে দরদাতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকা চলবে না। পতিত সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশের কারণে দরপত্র যাচাই কমিটি এই শর্তকে পাশ কাটাতে বাধ্য হয়। এছাড়া কাজ পাইয়ে দিতে শুধু চারবার দরপত্রের শর্তেই সংশোধন করা হয়নি, বরং দরপত্র বাতিল করে বাদ দেওয়া হয় যোগ্য কোম্পানিকে। প্রথম দরপত্রে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান সেল্প সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে দরপত্রের সকল শর্ত পূরণ করলেও তাদের কাজ না দিয়ে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করে কাজ দেওয়া হয় এই মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকেই।

বিআরটিএ’র একজন কর্মকর্তা জানান, সেই সময় প্রথম দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল ফ্রান্সের সেল্প এসএএস। মাদ্রাজ গোয়েন্দাবৃত্তি করে সেই তথ্য আগেই জেনে যায়। তারা বিআরটিএ-কে চিঠি দিয়ে ফ্রান্সের কোম্পানির ঘাটতি সম্পর্কে আগাম তথ্য জানিয়ে দেয়। সেই সময়ে গোপন দরপত্রের তথ্য এমএসপি কিভাবে জানলো — এমনটা জানিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন দরপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ’র একজন কর্মকর্তা।

যেভাবে তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ:
ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা গাড়ির মালিকানার স্মার্ট কার্ডের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য তোলা হচ্ছে ছবি, নেওয়া হচ্ছে আঙুলের ছাপ। সেই সঙ্গে দিতে হচ্ছে ঠিকানাসহ গ্রাহকের সকল তথ্য। এসব তথ্য সরাসরি সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতীয় এই কোম্পানি মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। এতে বাংলাদেশী নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের নাগরিকের তথ্য যে কোম্পানিটি পাচার করছে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং অতীত কর্মকাণ্ড এটাই প্রমাণ করে, তারা বাংলাদেশের নাগরিকের সব তথ্য পাচার করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপদজনক। বিআরটিএ বলছে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় তারা কাজটি দিয়েছেন ভারতীয় কোম্পানিকে।

বাংলাদেশে আগেও ছিল এমএসপি’র ব্যর্থতার ঘটনা:
শুধু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স নয়, এর আগে ২০১৫ সালে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) মাইগ্রেশন কার্ড তৈরির দায়িত্বও পেয়েছিল এমএসপি। কিন্তু সে যাত্রায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এমএসপি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদ্রাজ সিকিউরিটিজের আগে এই কাজটি করেছে দেশীয় একটি আইটি প্রতিষ্ঠান। দেশীয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ৫ বছরের ১৫ লাখ কার্ড সরবরাহের চুক্তি থাকলেও চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই বছর আগেই ১৪ লাখ কার্ড সরবরাহে বাধ্য করে বিআরটিএ। অথচ ২০২০ সালের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ সিকিউরিটিজের সঙ্গে ৫ বছরে ৪০ লাখ (প্রতিবছর গড়ে ৮ লাখ) স্মার্ট কার্ড সরবরাহের চুক্তি হলেও প্রতিষ্ঠানটি তিন বছরে মাত্র ১৬ লাখ কার্ড সরবরাহ করতে পেরেছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা বা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি।

বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ব্যর্থতার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে না পারায় বিআরটিএ’র সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে আবেদন ও পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়া ব্যক্তিদের ভোগান্তি চরমে। এখন পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছে। কিন্তু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড না পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না তারা। শুধু তাই নয় এর কারণে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষ চালক রফতানিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অন্যান্য দেশ সে স্থান দখল করে নিচ্ছে।

জানতে চাইলে এমএসপি’র এইচ আর ম্যানেজার আশরাফ উদ্দিন মোস্তফা বলেন, সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা কার্ড বিতরণ করতে পারিনি। কারণ ২০২৩-২৪ সালের দিকে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছিল। এছাড়া করোনার কারণেও সমস্যা হয়েছিল। সে কারণে আমরা তিন বছরে ২৪ লাখের জায়গায় ১৬ লাখ কার্ড বিতরণে সক্ষম হয়েছি। সর্বশেষ আমরা সাড়ে ৩ লাখ কার্ড এনেছি। কিন্তু বিআরটিএ প্রিন্টের জন্য অনুমোদন দিচ্ছে না।

কার্ড সংকটের বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, এমএসপি আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি, ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। এছাড়া কিছু কার্ডের মান খারাপ থাকায় আমরা সেগুলো প্রিন্ট করতে দেইনি।

এদিকে নানা কারণেই ভারতীয় এই কোম্পানির প্রতি শঙ্কা প্রকাশ করেছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তাতে ভারতীয় এই বিতর্কিত কোম্পানিকে কোনোভাবেই আর রাখা উচিত নয় বলে মনে করছেন তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারেনি, যার ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং কেনিয়াতে তাদের নয়জন পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ফলে এমন একটি কোম্পানির কাছে বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য নিরাপদ নয়। প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় হওয়ায় এসব তথ্য ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের হাতে যাওয়া নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রথা পালনে বিরুদ্ধাচরণেরও অভিযোগ রয়েছে। হিজাব পরিহিত কোনো মুসলিম নারী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ছবি তুলতে আসলে তাকে হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয় বলে জানা গেছে। কেউ যদি হিজাব খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তবে তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই ফিরে যেতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুলের ধানমন্ডি শাখার ইন্সট্রাক্টর এবাদত হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাদের এখান থেকে একাধিক নারী যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে যখন বিআরটিএতে পরীক্ষা দিতে গেছেন তখন হিজাব খুলে ছবি তুলতে বলা হয়। যে কারণে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স না করেই ফিরে যান। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

শুধু তাই নয়, সরবরাহকারী এই ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে বিআরটিএ’র দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে, যা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিআরটিএ-তে জনবল সংকট এবং জবাবদিহিতার অভাবে নানা অনিয়মে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হচ্ছে।

আফরোজা

×