
জাপান দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বিদেশি কর্মী ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার নীতি গ্রহণ করে আসছে। তবে এবার সেই বিদেশীদের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ প্রকট হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীদের বিদেশিদের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপের প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা ইতোমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্ক ফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিদেশী অপরাধ ও সেবার অপব্যবহার রোধে ‘কমান্ড সেন্টার’
প্রধানমন্ত্রী ইশিবা ১৫ জুলাই চালু করেছেন নতুন এই টাস্ক ফোর্স, যা এক ধরনের ‘কমান্ড সেন্টার’ হিসেবে কাজ করবে। এতে বিদেশীদের জমি ক্রয়-বিক্রয়, অনাদায়ী সামাজিক বীমা, সরকারি সেবার অপব্যবহার এবং অভিবাসন সংক্রান্ত নীতিমালা একত্রে দেখা হবে। তিনি বলেন, “কিছু বিদেশী অপরাধে জড়িত এবং অনেকেই সরকারি সেবার অপব্যবহার করছে, সেগুলো রুখতেই এ উদ্যোগ।”
বিদেশী চিকিৎসা খরচ পরিশোধ না করলে মিলবে না ভিসা
সরকার জানিয়েছে, ভবিষ্যতে যেসব বিদেশী নাগরিক জাপানে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করে দেশ ছাড়বে, তারা নতুন করে আর ভিসা পাবেন না। যদিও পুরো পরিকল্পনা এখনো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
বিদেশীর সংখ্যা বেড়েছে, জন্মহার কমেছে
গত এক দশকে জাপানে বিদেশী নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৩৮ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩% হলেও এক দশকে এই বৃদ্ধি বিশাল। জাপানের জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি হলেও জন্মহার ক্রমাগত কমছে এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীর হার বাড়ছে। এই কারণে জাপান বাধ্য হয়েছে বিদেশি শ্রমিক ও পর্যটকদের জন্য দরজা খুলতে। তবে সমাজে এই পরিবর্তন সহজভাবে মেনে নিচ্ছে না অনেকেই।
পর্যটক ভিড়ে অসন্তুষ্ট স্থানীয়রা, দোষারোপ করা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি ও জমির দামে ঊর্ধ্বগতির জন্য
জাতীয় পর্যটন সংস্থার তথ্য মতে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে জাপানে রেকর্ডসংখ্যক ২ কোটি ১৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের তালিকায় জাপান ছিল বিশ্বের অষ্টম এবং এশিয়ার শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য।
তবে এই পর্যটন প্রবাহে অনেক স্থানীয় বাসিন্দা অসন্তুষ্ট। তারা বলছেন, পর্যটকদের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, কিছু বিদেশী সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন অথচ বীমা করছেন না, আবার অনেকেই জায়গা বা ফ্ল্যাট কিনে রিয়েল এস্টেটের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
সাধারণ নাগরিকদের মতামত: বিদেশীদের প্রতি বিরক্তি
একজন ৭৮ বছর বয়সী টোকিওর নাগরিক বলেন, “বিদেশীরা এখানে এসেছে কারণ নিজেদের দেশে তারা ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না।” ২৩ বছর বয়সী কৌমা নামামী বলেন, “খবরে দেখেছি, অনেক সরকারি সহায়তা বিদেশীদের হাতে যাচ্ছে এই সাহায্য আগে জাপানিজদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া উচিত।”
নির্বাচনী রাজনীতিতে অভিবাসন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ
নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিদেশীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ রাজনৈতিক এজেন্ডায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে “জাপানিজ ফার্স্ট” নীতি নিয়ে প্রচারণা চালানো ছোট ডানপন্থী দল ‘সানসেত’ অভিবাসন বিরোধী অবস্থানে সবচেয়ে সোচ্চার। তারা ট্রাম্পের ‘জাতীয়তাবাদী’ বক্তব্যের আদলে প্রচার চালাচ্ছে এবং এর ইতিবাচক প্রভাব জনমতের ওপর পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সানসেত হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তবে ১০-১৫টি আসন পেলে প্রধানমন্ত্রী ইশিবার দল এলডিপি’র জোটের সংখ্যা কিছুটা হলেও ঝুঁকির মুখে পড়বে। উল্লেখ্য, ১৫ বছর পর ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এলডিপি ও তাদের মিত্র দল কোমিতো।
‘বিদেশী বিরোধীতা নয়, সময়ের দাবি’ দাবি সানসেতের
সানসেত দলের সাধারণ সম্পাদক সোহে কামিয়া বলেন, “আমরা চাই না বিদেশীরা জাপানে চাকরি বা ব্যবসার মালিক হোক। এটা বৈষম্য নয়, বরং সময়ের দাবি।” অন্যদিকে চিবারকান্দা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেফ্রি হল বলেন, “বিদেশীদের বিরুদ্ধে ভুল ধারণা ছড়িয়ে এলডিপির ভোট কমাতেই এই প্রচার।”
অর্থনীতির জন্য বিদেশীরা অপরিহার্য
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, অভিবাসন বন্ধ হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় কর্মী সংকটে পড়বে। জন্মহার কমার কারণে আগামী কয়েক দশকে জাপানে কর্মক্ষম মানুষের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের পর থেকে জাপান এক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই রয়েছে।
Jahan