ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

৬ পরমাণু বিজ্ঞানী ও ২০ জ্যেষ্ঠ কমান্ডারসহ ৭৮ জন নিহত

ইরানে ইসরাইলের ব্যাপক হামলা

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ জুন ২০২৫

ইরানে ইসরাইলের ব্যাপক হামলা

ইরানের তেহরান ও আশপাশের বিভিন্ন পারমাণবিক এবং সামরিক স্থাপনায় শুক্রবার বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল

ইরানজুড়ে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। শুক্রবার স্থানীয় সময় ভোরে ইরানের অন্তত আট শহরে একযোগে এ হামলা হয়। তেল আবিব বলছে, তেহরান যাতে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের অংশ হিসেবে এই হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয় পারমাণবিক কেন্দ্র এবং বিপ্লবী গার্ডের সদর দপ্তরকেও। হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থা এইওআইএর সাবেক প্রধান ফেরেয়দুন আব্বাসি, পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ও খাতাম-আল-আনবিয়া হেডকোয়ার্টারের প্রধান গোলাম আলি রাশিদসহ ৬ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন।
ইসরাইল পাঁচ ধাপে এ হামলা করেছে। অজ্ঞাতনামা এক ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা টাইমস অব ইসরাইল পত্রিকাকে জানিয়েছেন শত শত হামলা চালানো হয়েছে এবং অন্তত আটটি স্থানে (শহরে) লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। হামলার জবাবে প্রাথমিকভাবে ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালাতে প্রায় ১০০টি ড্রোন পাঠিয়েছে ইরান। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, তারা এসব ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করতে কাজ করছে।
ইরানি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বিবিসি ও রয়টার্স জানিয়েছে, হামলার পর ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্তত ১০০ স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে। এসব হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) বিমানবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহসহ অন্তত ২০ জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হয়েছেন।
এক বিবৃতিতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তেহরানে আইআরজিসির একটি ভূগর্ভস্থ কমান্ড সেন্টারে জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ। বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণ পর কমান্ড সেন্টারটি লক্ষ্য করে বাঙ্কার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরাইলের যুদ্ধ বিমান। এতে আমির আলী হাজিজাদেহসহ ২০ জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ঘটনস্থলেই নিহত হন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, হামলায় তাদের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন এবং তেহরানে বাহিনীর সদর দপ্তরেও হামলা হয়েছে। রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় হামলায় কয়েক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ইরানে ৭৮ জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, যত দিন প্রয়োজন, তত দিন এমন হামলা চলবে। তিনি বলেন, এই হামলা এখানেই শেষ নয়। যতদিন প্রয়োজন হবে, ততদিন ইসরাইল আক্রমণ অব্যাহত রাখবে।
তিনি বলেন, এই হামলা ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। ইরানি বোমা বানানোর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা তাদের নিশানায় রয়েছেন। পাশাপাশি সম্ভাব্য পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করে ইসরাইল।
এদিকে ইসরাইলের হামলায় নিহত প্রত্যেক নাগরিকের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এমন বর্বর শাসকের সঙ্গে শুধু শক্তির ভাষায় কথা বলা উচিত।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্ত থেকেই ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সরকার প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যাতে অবৈধ ইসরাইেলকে তার আগ্রাসনের জন্য অনুতপ্ত করা যায় এবং ইসরাইলিরা এক মুহূর্তও বিশ্রাম নিতে না পারে।
গত ২০০ বছরে ইরান আগ বাড়িয়ে কখনো কোনো যুদ্ধ শুরু করেনি উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা কখনো পিছপা হব না। এই গল্পের শেষ অধ্যায় ইরানই লিখবে।’
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, ইরানের ৮ শহরে কয়েকশ’ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তেহরানের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আয়োজিত একটি বৈঠকের একদিন আগেই এ হামলার ঘটনা ঘটল। ভয়াবহ এ হামলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্সের।
ইসরাইলি হামলায় ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হওয়ার পর নতুন কমান্ডার হিসেবে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ পাকপুরকে নিয়োগ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ব্যাপক হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানকে আরও হামলার  হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে অবিলম্বে চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ইরানে হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুল ফজল শেখারচি বলেছেন, জায়নবাদী এ হামলার জবাব অবশ্যই ইরানি সশস্ত্র বাহিনী দেবে। দেশটি ইতোমধ্যে প্রায় ১০০টি ড্রোন পাঠিয়েছে ইসরাইলে। পাল্টা হামলা ঠেকাতে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে ইসরাইল। সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব দূতাবাস। ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে ইসরাইলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় আঘাত হানার পরও সেখানে তেজস্ক্রিয়তা বা বিকিরণ মাত্রা বৃদ্ধি পায়নি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।  
৮ শহরে কয়েকশ’ বিমান হামলা ॥ ইরানজুড়ে শুক্রবার পাঁচটি ধাপে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। অজ্ঞাতনামা একজন ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা টাইমস অব ইসরাইল পত্রিকাকে এ কথা জানিয়েছেন। এই কর্মকর্তা বলেন, শত শত হামলা চালানো হয়েছে এবং অন্তত আটটি স্থানে (শহরে) লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ইরানের ছয়টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। আর ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত কয়েক ঘণ্টায় অন্তত দুটি ধাপে হামলা চালানো হয়। তবে নিশ্চিত না হলেও এখন তৃতীয় দফার হামলা চলমান থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেসব স্থানে হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেসব হলো রাজধানী তেহরান ও এর আশপাশের সামরিক স্থাপনা; তেহরানের দক্ষিণে নাতাঞ্জ শহর, যেখানে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র অবস্থিত; তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহর, যেখানে একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও দুটি সামরিক ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে; তেহরানের দক্ষিণে ইস্পাহান শহর; তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাক শহর ও পশ্চিমে কেরমানশাহ শহর। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তেহরানজুড়ে ৬ থেকে ৯টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। হামলা হয়েছে আবাসিক ভবনেও।
৬ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত ॥ ইসরাইলের হামলায় ইরানের ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম। এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রকাশিত এক পোস্টে সংস্থাটি এ তথ্য জানায়। নিহত বিজ্ঞানীরা হলেন আবদুল হামিদ মিনুচেহর, আহমদরেজা জুলফাগারি, সৈয়দ আমিরহোসেইন ফাকিহি, মোতলাবিজাদে, মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি ও ফেরেইদুন আব্বাসি। তাসনিমের পোস্টে বলা হয়, ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা আমাদের বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধে নেমেছে।
১০০ ড্রোন পাঠিয়েছে ইরান ॥ ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালাতে প্রায় ১০০টি ড্রোন পাঠিয়েছে ইরান। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী শুক্রবার এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, তারা এসব ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করতে কাজ করছে। এর আগে শুক্রবার ভোররাতে ইরানের বিভিন্ন স্থানে আকাশপথে হামলা চালায় ইসরাইল। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন সাংবাদিকদের বলেন, ইসরাইলের ভূখন্ডের দিকে প্রায় ১০০টি ড্রোন পাঠিয়েছে ইরান, যেগুলো আমরা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডেফরিন জানান, ইরানে ইসরাইলি হামলায় ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়, যেগুলো দেশটির ভেতরে প্রায় ১০০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
কঠোর জবাব দেওয়ার ঘোষণা ইরানের ॥ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলের প্রাণঘাতী হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তেহরান। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুল ফজল শেখারচি বলেছেন, জায়নবাদী এ হামলার জবাব অবশ্যই ইরানি সশস্ত্র বাহিনী দেবে। মুখপাত্র আরও বলেন, ইসরাইলকে তার হামলার চড়া মূল্য দিতে হবে এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আরও বড় হামলার হুমকি ট্রাম্পের ॥ এদিকে ইরানে ইসরাইলের ব্যাপক হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানকে আরও হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে অবিলম্বে চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী রবিবার (১৫ জুন) ষষ্ঠ দফা আলোচনায় যাওয়ার কথা থাকলেও ট্রাম্প বলেছেন, আমি তাদের একের পর এক সুযোগ দিয়েছি। বলেছি ‘চুক্তিটা করো।’ কিন্তু যতবারই কাছাকাছি গেছে, কোনোভাবে তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, এর মধ্যেই অনেক মৃত্যু ও ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু এখনো সময় আছে এই হত্যাযজ্ঞ থামানোর। পরবর্তী হামলা আরও বেশি ভয়ংকর হতে যাচ্ছে। তিনি সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইরানকে এখনই চুক্তি করতে হবে, না হলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এক সময়ের ইরানি সাম্রাজ্য যেটা ছিল, তা রক্ষার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইসরাইল আত্মরক্ষার স্বার্থে একতরফাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় জড়িত নয়। তবে তিনি ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বা স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু বানালে ফল ভালো হবে না।
ইসরাইলের চতুর্দিকে সেনা মোতায়েন ॥ ইসরাইলের সেনাপ্রধান আইয়াল জামির টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, তাঁর সেনাবাহিনী ১০ হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন করছে এবং সব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে চাইবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে। তিনি বলেন, এ অভিযানের প্রস্তুতি আমরা অনেক আগে থেকেই নিচ্ছি। বাস্তব ও তাৎক্ষণিক হুমকির বিরুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য সেনাবাহিনীর সব শাখা ও বিভাগ মিলিয়ে নজিরবিহীন চেষ্টা চালানো হয়েছে, বলেন জামির। এই কর্মকর্তা বলেন, শত শত হামলা চালানো হয়েছে এবং অন্তত আটটি স্থানে (শহরে) লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে ইসরাইলি দূতাবাস বন্ধ ॥ ইরানে হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরাইল বিশ্বব্যাপী তার সব কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাস এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে ইসরাইল তার বৈদেশিক মিশনগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করছে এবং কনস্যুলার সেবাও আপাতত প্রদান করা হবে না।
তবে দূতাবাসগুলো কতদিন বন্ধ থাকবে—সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলার জেরে মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে তেলআবিব। এ ছাড়া দূতাবাস ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তাও এর অন্যতম কারণ হতে পারে।
ইরানের পক্ষে ইরাকের অবস্থান ॥ তেহরানে একাধিক ইসরাইলি হামলার পর ইরান সরকারিভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। এই হামলার প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী দেশ ইরাকেও। কাতার এয়ারপোর্টের ফ্লাইট ইনফরমেশন বোর্ডে দেখা যাচ্ছে, ইরানের পাশাপাশি ইরাকগামী ফ্লাইটগুলো একের পর এক বাতিল হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইনস ইরাকের আকাশপথও এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। কারণ ইরানের প্রতি অনুগত এমন ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে যে, ইরানে যদি মার্কিন বা ইসরাইলি হামলা হয়, তা হলে মার্কিন ঘাঁটিগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির একজন উপদেষ্টা বলেন, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইরাক সরকার টানা আলোচনা চালাচ্ছে, যাতে ইরানের ওপর হামলা হলে ওই গোষ্ঠীগুলো কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া না দেখায়। কারণ, ইরাক কোনো নতুন যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
নেতানিয়াহু কি ট্রাম্পকে অবজ্ঞা করলেন ॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বের বড় বড় সংঘাত থামিয়ে বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সংঘর্ষ-রক্তপাত থামছেই না। গাজা, ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি তার ক্ষমতার মেয়াদের পাঁচ মাস পার হতে না হতেই নতুন করে ইসরাইল ইরানে হামলা চালিয়ে বসল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হামলা পুরো অঞ্চলকে বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এখন ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘মধ্যস্থতাকারী’ হওয়ার স্বপ্ন ছারখার হওয়ার পথে। ইরানের ওপর ইসরাইলের এ হামলাকে ট্রাম্পের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কারণ, তিনি বারবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাঁরা ইরানে হামলা না চালান। অবশ্য ট্রাম্প নিজেও পরমাণু আলোচনা ব্যর্থ হলে ইরানে হামলার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হামলা এখন একেবারে ভিন্ন মাত্রা পেল।
পরমাণু চুক্তি থামাতেই হামলা  ॥ তেহরান ও এর আশপাশে ইসরাইলের নজিরবিহীন হামলা মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আসন্ন পারমাণবিক আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার কৌশল হিসেবে পরিচালিত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের উপপ্রধান এলি গেরানমায়েহ এমনটিই মনে করছেন। তিনি বলেন, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমাবদ্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিত। যদিও কিছু ইসরাইলি কর্মকর্তা দাবি করছেন, এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা হবে। তবে এলি গেরানমায়েহ মনে করেন, হামলার সময় ও ব্যাপকতা এটিই স্পষ্ট করে যে এর মূল লক্ষ্য ছিল আলোচনার পথই বন্ধ করে দেওয়া। তিনি আরও জানান, এই পরিস্থিতিতে রবিবার (১৫ জুন) ওমানের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনা স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সাময়িকভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া থেমে গিয়ে সামরিক উত্তেজনা নতুন করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে যে, এই হামলার পেছনে তাদের কোনো হাত নেই; ইসরাইল এককভাবে এই হামলা চালিয়েছে। এলি গেরানমায়েহ বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবির ফলে ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। নেতানিয়াহুর কৌশলে পা না দিয়ে ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ এড়াতে চাইবে বলেও মনে করেন তিনি।
পরমাণু স্থাপনা স্বাভাবিক আছে ॥ ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে ইসরাইলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় আঘাত হানার পরও সেখানে তেজস্ক্রিয়তা বা বিকিরণ মাত্রা বৃদ্ধি পায়নি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। আইএইএ এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ইরানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় বিকিরণের মাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে। সংস্থাটি আরও জানায়, ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল না এবং সেখানেও কোনো ধরনের ক্ষয়-ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
খাবার মজুত করছে ইসরাইলিরা ॥ তেহরানে হামলার জবাবে ইরানও ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে জেরুজালেমের সুপারশপগুলোয় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পানি। মজুত করার জন্য মানুষ এখন এগুলো হুমড়ি খেয়ে কিনছে। একই কারণে ফাঁকা হয়ে গেছে তেল আবিবের রাস্তাঘাট। রাত ৩টার দিকে সাইরেনের শব্দ ও মোবাইলের সতর্কবার্তায় ঘুম ভাঙে ইসরাইলের জনগণের। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে জানানো হয়, তাদের সামনে একটি গুরুতর হুমকি রয়েছে। তাই, সবাই যেন আশ্রয়কেন্দ্রের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করে। ইসরাইলের জরুরি সেবা বিভাগ জানিয়েছে, সারাদেশে রক্ত সংগ্রহের কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে এবং যেসব রোগী বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো কিছুটা সুস্থ, তাদের ছেড়ে দিচ্ছে ইসরাইলের হাসপাতালগুলো। অন্যদিকে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পশ্চিম তীরে সব ফিলিস্তিনি শহরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ॥ এই ঘটনায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইসরাইলকে ‘কঠোর শাস্তি’র হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, প্রয়োজন হলে অভিযান আরও চলবে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা তিনি সমর্থন করেন না। বিশেষভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইলের হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি । চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা এই ঘটনার ‘গভীর পরিণতি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং পরিস্থিতির ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উত্তেজনা বৃদ্ধির পথ পরিহার করতে হবে। চীন জানিয়েছে, তারা সংকট নিরসনে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
এ ছাড়া তুরস্ক, ওমান, যুক্তরাজ্য, ফান্স, সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, অস্ট্রেরিয়া, নিউজিল্যান্ডও জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ইরানে ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্ক ইসরাইলের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও কূটনৈতিক পথকে অস্বীকার’ বলে অভিহিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ ধরনের হামলা প্রমাণ করে, ইসরাইল শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় না।

প্যানেল

×