ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

কমুক আত্মহত্যা ॥ বিষণ্ণতার চিকিৎসা নিন 

ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০২৩

কমুক আত্মহত্যা ॥ বিষণ্ণতার চিকিৎসা নিন 

বাংলাদেশে ৫-৯% মহিলা কোনো না কোনোভাবে বিষণ্ণতা নামক রোগে ভুগছেন

বাংলাদেশে ৫-৯% মহিলা কোনো না কোনোভাবে বিষণ্ণতা নামক রোগে ভুগছেন। এই বিরাট অংশ রোগী এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার, এই পরীক্ষা, ঐ পরীক্ষা করে শেষে কোনো রোগ ধরতে না পেরে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়।
কি কি লক্ষণ দেখে বুঝবেন আপনার পাশের মহিলাটি বিষণ্ণতায় ভুগছেন :
১। শারীরিক লক্ষণ : মাথা জ্বালাপোড়া করা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জ্বলে। কখনো কখনো পুরো শরীর জ্বালা পোড়া করে।
২। মাথা দিয়ে নাক দিয়ে কান দিয়ে গরম ভাব উঠে, কেউ কেউ বলে ভাত সিদ্ধ করলে যে রকম ভাপ উঠে ঠিক সেই রকম কান দিয়ে নাক দিয়ে বের হয় এবং বারবার তেলপানি দেওয়া লাগে মাথা ঠান্ডা করার জন্য।
৩। কেউ কেউ মাথার চুল মাঝখানে ফেলে দিয়ে বিভিন্ন গাছের পাতা পিষে মাথায় দিয়ে রাখে মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য। 
৪। বেশির ভাগ রোগীর ঘুমের সমস্যা হয়, কারও কারও একদম ঘুম হয় না আজানের অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যায় এবং সকাল বেলাটা তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ লাগে। 
৫। যদি কোনো বয়স্ক মহিলা দুঃখের কথা বলতে গেলেই প্রায় কেঁদে ফেলে তখন কিন্তু বিষণœতাই প্রথম সন্দেহ হতে পারে।
৬। মুখের কথা শুনে আপনি কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন যেমন : এই সমস্ত রোগী খুব কম কথা বলে এবং খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। একটা প্রশ্ন করলে অনেক সময় পর উত্তর দেয়, মাঝে মাঝে কোনো কথাই বলতে চায় না। কেউ জিজ্ঞেস না করলে কথা বলতে চায় না। তারপর ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থায় চলে যায় যে একদম কথা বলে না যাকে আমরা মিউট বলি। 
৭। মন খারাপ থাকা, এটাই আসল লক্ষণ : এই মন খারাপের প্রকাশ বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নভাবে হতে পারে, বেশিরভাগ রোগী নিজের মনের দুঃখ ভাব সরাসরি বলতে চায় না তারা সাধারণত বেশিরভাগ সময় বিরক্ত ভাব থাকে, অন্যের কথা সহ্য করতে পারে না, কথা বললে রেগে যায়, বেশিরভাগ সময় মনমরা ভাব থাকে, কারও সঙ্গে মিশতে চায় না, কাছে ছোট ছোট বাচ্চারা চেচামেচি করলে বিরক্ত হয় টেলিভিশন দেখতে চায় না অথচ আগে নিয়মিত টেলিভিশন দেখত এবং সবার সঙ্গে মিশতো এখন কিছুই ভালো লাগে না ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েই কেঁদে ফেলে এবং অতীতের দুঃখের ঘটনাগুলো বারবার বলতে চায়। এই সবই কিন্তু মন খারাপের লক্ষণ। 
৮। বাচ্চা ডেলিভারির পর বিষণœতা নামক রোগটির  ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সময় বেশিরভাগ মায়ের অভিযোগ থাকে শরীর বেশি দুর্বল লাগে, মন বিরক্ত থাকে, ঘুম হয় না আত্মীয়স্বজনরা বলে ও যেন ইদানীং বেশি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে এবং ভয় ও দুশ্চিন্তা লাগে। অনেক গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যাগুলো সুত্রিকা বলে কবিরাজরা চিকিৎসা করে। অথচ এই নারীরা কিন্তু বিষণœতা নামক রোগে ভুগতেছে। 
৯। এই সব রোগীর আনন্দ ফুর্তি, সাজগোজ, হাসিঠাট্টা, গল্প করা ধীরে ধীরে সকল আনন্দদায়ক ও স্বাভাবিক কাজকর্মে লোপ পেতে থাকে। 
১০। খাওয়ার প্রতি অনীহা থাকে যে খেয়ে কি লাভ হবে, বেঁচে থেকে কি লাভ হবে? 
১১। কেউ কেউ বসার সময় গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে জড় বস্তুর মতো করে বসে থাকে। 
১২। এমনও দেখা গেছে বলে যে, ডাক্তার আমার নাড়ি ভুঁড়ি পঁচে গেছে। আমি হয়ত বড় ধরনের পাপ করেছি আল্লাহ আমাকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে। 
১৩। অনেক বিষণœ রোগীদের দেখা যায় কথা বলার মাঝখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এটাও একটা লক্ষণ। 
১৪। শরীরের ওজন কমতে থাকে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তেও পারে। 
১৫। কেউ কেউ হাজির হন মাথাব্যথা ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা নিয়ে। 
নারীদের বিষণœতার কারণ কি :
১। জন্মগতভাবে আমাদের দেশে নারীরা বেশ নিষ্পেষিত থাকে। এটা তারা ছোটবেলা থেকেই ঘরে এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে দেখতে দেখতে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
২। হরমোনজনিত কারণ। 
৩। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ। 
৪। রিপ্রডাকটিভ লাইফের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময় যেমন বাচ্চা জন্মের পর, মেনোপোজ ইত্যাদিও কারণ হিসেরে বলা যেতে পারে। 
৫। পরিসংখানে দেখা গেছে যে সব মায়েদের তিনটি বাচ্চার বয়স ১৪ বছরের নিচে এবং কেবলমাত্র ঘরের কাজে নিয়োজিত থাকে এবং স্বামীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকে তাদের মধ্যে বিষণœতার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
৬। বাচ্চা ডেলিভারির পর বিষণœতা হওয়ার নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে :
০ এই সময় হঠাৎ করে শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন হতে পারে যেমন ইষ্টোজেন, প্রজেস্টেরন ও থাইরয়েড হরমোন।
০ বাচ্চা যতœ নিতে অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ।
০ সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা।
০ স্বামী ও আত্মীয়স্বজনরা বাচ্চার মাকে সঠিক সময়ে যদি সাপোর্ট না দেয় ও সাহায্য সহযোগিতা না করে এটাও মায়ের জন্য আলাদা একটা মানসিক চাপ। 
৭। সাধারণ কারণের মধ্যে হতে পারে কোনো বিয়োগান্তক ঘটনা যেমনÑ প্রিয়জনের মৃত্যু, স্বামীর সঙ্গে ডির্ভোস হয়ে যাওয়া, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করা, বড় ধরনের কোনো মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি। 
৮। দীর্ঘদিন কোনো শারীরিক রোগে ভুগলে যেমন ডায়াবেটিস, প্রেসার, হাঁপানী, ক্যান্সার, আর্থাইট্রিস ও স্ট্রোকের মতো অন্যান্য দীর্ঘ মেয়াদি রোগ।
৯। বায়োলোজিক্যাল কারণের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তন যেমন সেরোটনিন, নরএপিনেফ্রিন ও ডোপামিন।  
কেন চিকিৎসা দরকার : কারণ  
১। ১০-১৭% রোগী আত্মহত্যা করতে পারে। 
২। ৫০% রোগী কোনো না কোনোভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। 
৩। বিষণœতা দূর করার জন্য অনেক রোগী নেশায় আসক্ত হতে পারে। 
৪। এরা কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। 
৫। এদের সেক্সুয়াল জীবনে অশান্তি বিরাজ করে। 
৬। এসব রোগী পরিবারের, সমাজের ও জাতির বোঝা হয়ে যেতে পারে যদি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করা হয়।  
পরিশেষে একটি কথা মনে রাখুন সঠিক সময়ে বিষণœতা রোগের চিকিৎসা নিলে আমাদের দেশে আত্মহত্যা অনেক কমে যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
ফোন : ০১৮১৭০২৮২৭৭

×