ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আলো ছড়াচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোকচিত্রী কাজী আরিফুজ্জামান

প্রকাশিত: ১৫:৩৪, ২২ মে ২০২৫

আলো ছড়াচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোকচিত্রী কাজী আরিফুজ্জামান

ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে নিজের তোলা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আলোকচিত্রী কাজী আরিফুজ্জামার। ছবিঃ এমডি সাব্বির

প্রতিটি মানুষের শখের সঙ্গে যখন পেশার মেলবন্ধন ঘটে, তখন কাজটি কেবল দায়িত্ব নয়, হয়ে ওঠে ভালোবাসা। এই মেলবন্ধনের মধ্যেই তৈরি হয় নিরন্তর সৃষ্টির আনন্দ। কাজী আরিফুজ্জামানের জীবন এরই প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীলতার প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল। ছবি আঁকায় বিশেষ করে কার্টুন আঁকায় তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল। কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জ ও পরিস্থিতির কারণে এ সৃজনশীল পথ ধরে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে শিল্পের প্রতি সেই অন্তর্নিহিত টান মনের গভীরে থেকে গিয়েছিল, যা তাঁকে নতুন পথ খুঁজতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি রঙ-তুলি ছেড়ে হাতে তুলে নেন ক্যামেরা। ক্যামেরা হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যম, তাঁর ‘তুলির’ পরিপূরক।

আলোকচিত্রের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান তাঁর শিল্পসাধনার নতুন দিগন্ত। ছবি আঁকা বা অংকনের মাধ্যমে যে ভাবনার প্রকাশ ঘটত, সেটিই তিনি এখন ফ্রেমে বন্দী করেন আলোকচিত্রের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্টিশীল মনের ভাবনা, দেশ ও সমাজ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুই ফুটে ওঠে ছবির মাধ্যমে। এক সময় যে শিল্প প্রেম তাঁর অন্তরে লুকিয়ে ছিল, সেই প্রেমই এখন প্রকাশ পায় আলোকচিত্রশিল্পে। আরিফুজ্জামানের ভাষায়, “আলোকচিত্রের মাঝেই আমি আমার সব রকম আশ্রয় খুঁজে পাই।”

এই শিল্পমাধ্যমের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছে। তাঁর জন্য আলোকচিত্রশিল্প কেবল শখ নয়, বরং জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশ। তিনি উপলব্ধি করেন, অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করলে হয়তো এই শিল্প সাধনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই তিনি তাঁর পেশা হিসেবে আলোকচিত্রকেই বেছে নিয়েছেন। এই শিল্পে একজন পেশাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এবং নিজেকে গড়ে তুলছেন। আলোকচিত্রে ক্যারিয়ার গড়ার পথটি সহজ নয়, কিন্তু তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও অদম্য চেষ্টার কারণেই তিনি সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

তাঁর এই শিল্পসাধনার স্বীকৃতিও এসেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ২০২২ সালে ‘Sony World Photography Awards’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। এর আগে ২০২১ সালে ‘The Nature Conservancy Global Photo Contest’-এ ‘Water’ বিভাগে পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি বাংলাদেশের জন্যও গর্বের।

আরিফুজ্জামানের ক্যারিয়ার গঠনে বড় এক ভূমিকা রেখেছে তাঁর ৩৬৫ ডে ফটোগ্রাফি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে তিনি প্রতিদিন অন্তত একটি ছবি তোলার মাধ্যমে ৩৬৫ দিন টানা আলোকচিত্র চর্চা করেছেন, যা তাঁকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতার চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছে। এই চ্যালেঞ্জের অভিজ্ঞতা তাঁর দক্ষতা বাড়িয়ে তুলেছে এবং আলোকচিত্রশিল্পে গভীরতর আবেগ জাগিয়েছে।

বর্তমানে আরিফুজ্জামান তিনটি বড় ফটোগ্রাফি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন, যার প্রতিটি তাঁর শিল্পচর্চার গভীরতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ। "বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা" প্রজেক্টে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম ও সংস্কৃতি তুলে ধরছেন। "সোনালী আঁশের ধূসর জীবন" প্রজেক্টে বাংলাদেশের পাট শিল্পের গৌরবময় অতীত ও আধুনিক বাস্তবতার মিল খুঁজে দেখছেন। এবং "চাতাল জীবন" প্রজেক্টের মাধ্যমে চাতালে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী জীবনকে তুলে আনছেন ফ্রেমে।

কাজী আরিফুজ্জামান বিশ্বাস করেন যে শিল্পের মধ্য দিয়েই সমাজের পরিবর্তন আনা সম্ভব। আলোকচিত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, সুন্দর মুহূর্ত কিংবা পরিবেশের গুরুত্ব তুলে ধরতে চান। তাঁর আলোকচিত্রে প্রকাশ পায় এক অনন্য গল্প, যা কেবল ফ্রেমে আবদ্ধ নয়; বরং তাঁর মনের গভীর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি।

আলোকচিত্রশিল্পে ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছুক তরুণদের জন্য কাজী আরিফুজ্জামান একটি উদাহরণ। তাঁর মতো যাঁরা সৃজনশীলতাকে ভালোবাসেন এবং নিজেদের শখকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চান, তাঁদের জন্য এটি একটি অনুপ্রেরণার গল্প। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহস ও অধ্যবসায় থাকলে, যেকোনো শখকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তাতে সফলতা অর্জন সম্ভব।

সাব্বির

×