
ছবি : বদরুল ইসলাম
বাংলার প্রকৃতি নানা রকম ঔষধিগুণে ভরপুর উদ্ভিদে সমৃদ্ধ। এমনই এক মূল্যবান গাছ হলো অর্জুন গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia arjuna। বহু প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্রে এই গাছ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিশেষত হৃদরোগ নিরাময়ে এর খ্যাতি সুপ্রাচীন।
অর্জুন গাছের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
অর্জুন গাছ একটি মাঝারি থেকে বড় আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ, যা সাধারণত ২০–২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। এর ছাল ধূসর-সাদা, মসৃণ ও কিছুটা পলিশ করা কাগজের মতো দেখায়। পাতা ডিম্বাকৃতি, বিপরীতভাবে সাজানো এবং শাখায় শাখায় ঘন পাতা গাছকে ঘন ছায়া দেয়। এর ফুল ছোট, সাদা বা হালকা হলুদ, ফল ৫ খাঁজবিশিষ্ট ও শক্ত খোলসযুক্ত। অর্জুন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উপযুক্ত গাছ, তাই ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি জন্মায়। নদীর পাড়, পুকুরঘাট ও জলাভূমির আশেপাশে এই গাছ ভালো জন্মে।
অর্জুনের ছালে পাওয়া রাসায়নিক উপাদানসমূহ
Coenzyme Q-10 সদৃশ উপাদান – হৃদপেশিকে শক্তি জোগায়
Arjunic acid, Arjunolic acid – অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও প্রদাহনাশক
ট্যানিন – সংক্রমণ প্রতিরোধ করে
সাপোনিন ও ফ্ল্যাভোনয়েড – হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক
অর্জুন গাছের উপকারীতা
১. হৃদরোগ প্রতিরোধে:
অর্জুন গাছের ছাল বিশেষভাবে হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী। এতে রয়েছে কোএনজাইম Q-10 সদৃশ উপাদান, যা হৃদপেশিকে শক্তি জোগায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তনালীকে নমনীয় করে।
২. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে:
অর্জুন ছালের গুঁড়া পানিতে সিদ্ধ করে খেলে উচ্চ রক্তচাপ অনেকাংশে কমে আসে। এটি রক্তনালীর ওপর চাপ কমিয়ে হৃদযন্ত্রের কাজ সহজ করে।
৩. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে:
এটি রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায়।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ:
অর্জুনের ছালে থাকা ট্যানিন ও ফ্ল্যাভনয়েড উপাদান ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়।
৫. ত্বক ও ঘায়ের চিকিৎসায়:
অর্জুন ছালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি লেপ ফোঁড়া, পুঁজযুক্ত ঘা বা চর্মরোগে ব্যবহার করা হয়।
৬. মূত্রনালী সংক্রান্ত সমস্যায়:
মূত্রনালীর সংক্রমণ, অতিরিক্ত প্রস্রাব বা জ্বালাপোড়ায় এটি দারুণ কার্যকর।
অর্জুন গাছের কোন কোন অংশ উপকারী?
ছাল: সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও উপকারী অংশ। মূলত ছাল থেকেই ওষুধ প্রস্তুত হয়।
পাতা: ক্ষত শুকানো, ফোঁড়া ও ত্বকের সমস্যা সারাতে ব্যবহৃত হয়।
বীজ ও ফল: অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধিতে উপকারী।
গুঁড়ো/ক্বাথ: ছালের গুঁড়ো বা সিদ্ধ রস পান করে উপকার পাওয়া যায়।
অর্জুন গাছের ব্যবহারে সাবধানতা
যদিও অর্জুন গাছ একটি প্রাকৃতিক ও নিরাপদ ভেষজ হিসেবে পরিচিত, তবুও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি:
১. অতিরিক্ত মাত্রায় সেবন বিপজ্জনক হতে পারে। এটি রক্তচাপ হঠাৎ খুব নিচে নামিয়ে দিতে পারে।
২. গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
৩. অন্য ওষুধের সাথে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, বিশেষত হার্ট বা প্রেসারের ওষুধের সাথে।
৪. অ্যালার্জি বা অতিসংবেদনশীলতা যাদের আছে, তারা প্রথমে স্বল্পমাত্রায় গ্রহণ করে সহনশীলতা যাচাই করবেন।
প্রাকৃতিক ওষুধের রাজ্যে অর্জুন একটি মুকুটধারী বৃক্ষ। আধুনিক জীবনযাপনের চাপে মানুষ যখন হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছে, তখন অর্জুন গাছ হতে পারে এক নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক সঙ্গী। তবে মনে রাখতে হবে, যে কোনো ভেষজ চিকিৎসা শুরু করার আগে অভিজ্ঞ হাকিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শিহাব