
ছবি: সংগৃহীত
অটোমেশনের নামে প্রাইভেট মেডিক্যালে চরম বিশৃঙ্খলা
---- ভর্তি সংকটে ১২০০ সিট খালি
দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। 'অটোমেশন' নামে চালু হওয়া নতুন পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও স্বাধীনতা অবজ্ঞা করা হচ্ছে, যার ফলে উচ্চশিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রায় ১২০০টি আসন এখনো শূন্য পড়ে রয়েছে। অথচ অটোমেশন চালুর পূর্ববর্তী তিন বছরে একটিও আসন ফাঁকা থাকেনি। তখন প্রতি বছর গড়ে ৫৭ হাজার শিক্ষার্থী পাস করলেও সব সিট পূর্ণ হতো। বর্তমানে যদিও প্রতি বছর প্রায় ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছে, তবুও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিট খালি রয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের কলেজ নির্বাচন করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট এলগরিদম ও সিরিয়ালের ভিত্তিতে। এতে রাজধানীতে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের পাঠানো হচ্ছে গ্রামীণ এলাকার কলেজে, এবং অনেক মফস্বলের শিক্ষার্থীকে দেওয়া হচ্ছে ঢাকার অভিজাত মেডিক্যালে ভর্তি সুযোগ-যা বাস্তবতা ও সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে অনেকেই বরাদ্দ পাওয়া কলেজে ভর্তি না হয়ে অপেক্ষা বা উচ্চশিক্ষা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অটোমেশন চালুর পূর্বে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বর্তমান পদ্ধতির জটিলতা ও অনিশ্চয়তার কারণে তারা এখন বিকল্প গন্তব্য খুঁজছেন। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে তাদের টিকে থাকাই দুরুহ হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. এম এ মুবিন খান বলেন, "একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে বছরের পর বছর সময় লাগে। অথচ অকার্যকর নীতির ফলে তা মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা এখন আর নিজেদের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে না। এটি যেন হাত-পা বেঁধে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "বেসরকারি মেডিক্যালে টাকার বিনিময়ে ভর্তি ও মানহীন শিক্ষার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রকৃত মেধাবীদের সুযোগ দিতে এবং মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে আমরা অটোমেশন চালু করেছি। একটি সিটের বিপরীতে ৫ জনের তালিকা থাকায় এখনো ৪৯ হাজারতম সিরিয়ালধারী শিক্ষার্থী পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।" স্বাস্থ্যখাত বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা শিক্ষার চাহিদা একা সরকার পূরণ করতে পারবে না। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সহায়ক। বর্তমানে দেশের অনেক প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ও শিক্ষা সেবা দিচ্ছে। দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা এখন অনেকাংশেই দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট সমাধানে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক এবং মেধা ও পছন্দের সমন্বয় সাধনে সক্ষম নীতিমালা। অটোমেশন পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য যদি হয় মান নিশ্চিত করা, তবে তা যেন শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ও প্রাইভেট খাতের টিকে থাকার স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেই ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
অন্যদিকে বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। অনেকেই একে 'তুঘলকি সিদ্ধান্ত' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন-যা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশাভিত্তিক শিক্ষাখাতকে নীতিনির্ধারক অদূরদর্শিতার বলি বানাচ্ছে।
অটোমেশন পদ্ধতি চালুর আগে, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধা, পছন্দ ও আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী কলেজ বেছে নিতে পারতেন। তখন ৪০,০০০-এর বেশি পরীক্ষার্থী পাস করলেও ৬,২০০টি আসন অনায়াসেই পুরণ হতো। অথচ বর্তমানে প্রায় ৬০,০০০ শিক্ষার্থী পাস করলেও প্রায় ৭০০টি আসন শূন্য রয়ে গেছে-যা একটি অস্বাভাবিক ও বিপরীতমুখী বাস্তবতা। বিশেষজ্ঞরা একযোগে এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)-এর যৌথভাবে প্রণীত নতুন ভর্তিনীতি ও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে।
অটোমেশনের ফাঁদে বন্দি ভর্তি প্রক্রিয়া
অভিযোগ রয়েছে, ভর্তি পোর্টাল হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ায় নতুন আবেদনকারী অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি-সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এতে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কলেজ সূত্র জানায়, পোর্টাল খোলা থাকলে আরও অন্তত ১,০০০ শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারতেন- যা আসন শূন্যতার সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনতো। শিক্ষার্থীদের একাংশ বলছেন, মেধাক্রম অনুযায়ী কলেজ বরাদ্দ পেলেও সেটি তাদের পছন্দের নয় বা আর্থিকভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কেউ কেউ আবার রাজধানী বা কাছাকাছি স্থানে পড়তে আগ্রহী হলেও বরাদ্দ পেয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজে-যা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বিএমডিসির ব্যাখ্যা-এই 'অটোমেশন' পদ্ধতির লক্ষ্য ছিল ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা ও মেধার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ভর্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা: অনেক কলেজে এখনো ভর্তি অসম্পূর্ণ, শূন্য রয়েছে বহু আসন, ফলে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও ব্যাচ গঠনই সম্ভব হয়নি।
মাইগ্রেশন ও কোটার দৃষ্টান্তমূলক ব্যর্থতা।। বিভিন্ন কলেজ ও সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, 'মাইগ্রেশন' পদ্ধতির দুর্বল বাস্তবায়ন, অপ্রতুল প্রচার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তড়িঘড়ি করায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে এমনকি 'অস্বচ্ছল ও মেধাবী কোটার' আসনগুলোও থেকে গেছে অপূর্ণ। বিশ্লেষকদের বক্তব্য, এই নীতিমালার ফলে প্রকৃত মেধাবীরা অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ভর্তি হতে পারছে না, অথচ অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা আর্থিক সামর্থ্যের জোরে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে-যা মেধার ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অনিশ্চয়তার মুখে মেডিকেল শিক্ষা
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ৮ মার্চ ২০২৪ এবং ফলাফল প্রকাশিত হয় ১১ মার্চ। কিন্তু ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়েও অনেক বেসরকারি কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। এই অস্বাভাবিক বিলম্ব ও বিশৃঙ্খলা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ব্যতিক্রমী ও উদ্বেগজনক।
সময়ের দাবি: বাস্তবভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক নীতিমালা
বিশ্লেষণ বলছে, মেডিকেল শিক্ষাকে গঠনমূলক ও টেকসই রাখতে হলে তথাকথিত 'অটোমেশন' পদ্ধতির কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে জরুরি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মেধা, পছন্দ, আর্থিক সক্ষমতা ও ভৌগোলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে একটি যুগোপযোগী, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক ভর্তি নীতিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, এই নীতির অসার প্রয়োগে দেশের বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে যাবে।
এসইউ