ঈদের আনন্দ
পুরনো ছন্দে ফিরে এলো ঈদের আনন্দ। মুসলিমদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ। পর পর দুটি কোরবানির ঈদের আনন্দকে নির্জীব করে রেখেছিল করোনা। এবারও শঙ্কা মুক্ত হওয়া যায়নি। কেননা করোনা উর্ধমুখী। যেহেতু লকডাউন নেই এবং জনসাধারণ আগের থেকে অনেক সচেতন। তাই বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সবাই কাক্সিক্ষত পশুটি কিনে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। ঈদ-উল -ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা এই দুটো উৎসবেই অর্থ প্রবাহ বেড়ে যায় বহুগুণ। রেমিটেন্সসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে দেখা দেয় চাঙ্গাভাব ।
প্রান্তিক জনগণের কোরবানি : ঈদ-উল-আজহার আনন্দ পরিবার ভেদে বিভিন্ন রকমের হয়। যখন শহরের ধনী পরিবারগুলো ভাবছে এবার পশু কিনতে বাজেট কত হবে। তখন গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবার হিসেব করছে কত টাকায় বিক্রি করলে কিছুটা লাভ হবে। অনেক সময় তারা লাভবান হয় আবার অনেক সময় চরম হতাশায় পরিণত হয় সবকিছু। তবে এই সংখ্যাটা হাতে গোনা। কেননা সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করে। তাই কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ে। বহু হতদরিদ্র পরিবার সারা বছর খুব যতেœ পশু পালন করে এই সময়টার জন্য। সন্তানের মতো লালন-পালন করা পশুটি বিক্রি করে যে লাভ হয় তা দিয়ে বড় কোন প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়। এজন্য এই ঈদ একেকজনের কাছে একেক রকম। শহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামে যায় ঈদ করতে। তারা পশু কোরবানি করে সকল দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। ফলে সারা বছর যাদের পক্ষে গরু বা খাশির মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় না। তাদের এই সময়ে মাংস খাওয়ার সুযোগ হয়। এভাবেই ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মাঝে ভাগাভাগি হয়।
বাড়ছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা : যে কোন ঈদে ঢাকায় বেচা-কেনা বেড়ে যায় বহুগুণ। রোজার ঈদে পোশাক ক্রয়-বিক্রয় এবং যাকার-ফিতরার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়। কোরবানিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় পশু ক্রয়-বিক্রয়। ফলে অর্থপ্রবাহ অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বাড়ে। গত দুই বছর পশু কোরবানির সংখ্যা কমেছিল মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কম থাকায়। এবার বাড়বে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ এবং ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখ। এভাবে ক্রমাগত পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড ১৯ সংক্রমণ মানুষের জীবন যাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলায় পশু কোরবানির সংখ্যা কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩। ২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়ে হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। কোরবানিযোগ্য অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টি। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছিল খামারি-ব্যাপারীরা। এবার গরুর দাম বেশি হবে। কেননা গো-খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০-৪০০ টাকা। তথ্য মতে, এবার ঈদ-উল-আজহায় ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু কোরবানি দেয়া হবে। এর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির জন্য ইতোমধ্যে ৪২ লাখ ৪০ হাজার গরু-মহিষ ও ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ছাগল-ভেড়া মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে। এখন অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আশা করা যায়, গতবারের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন খামারিরা।
বাজার ব্যবস্থাপনা : পবিত্র ঈদ-উল-আজহায় সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে পশুর হাট। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মাঠ, ঘাট, পথে পশুর হাট বসানো হয়। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকায় এবার কোরবানির পশুর ১৭টি অস্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বসবে ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বসবে ৭টি পশুরহাট। প্রয়োজনে হাটের সংখ্যা বাড়তে পারে। বরাবরের মতো চালু থাকবে ডিএনসিসির ডিজিটাল হাট। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের খামারিরা পশু বিক্রি করতে পারবেন ডিজিটাল হাটে।
সম্পূর্ণ দেশীয় পশুতে কোরবানি : ২০১৪ সালে বৈধপথে অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় ভারতীয় গরু আমদানি। পশুর সরবরাহ কম থাকায় বৈধ ও অবৈধ উপায় অবলম্বন করে আরও কয়েক বছর পশু আমদানি করা হয়েছিল। ২০১৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ দেশীয় পশুতে কোরবানি করা হয়। যা সম্ভব হয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের যথাযথ পদক্ষেপের জন্য। এবারও দেশীয় পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ হবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের।
অনলাইন বেচাকেনা : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল হিসেবে দুনিয়াটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। যে কোন প্রয়োজন এখন ঘরে বসেই মেটানো যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে বিলাসবহুল পণ্য সবকিছুই অর্ডার অনুযায়ী পৌঁছে যাবে ঘরে। ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত অনলাইন কেনাকাটা ঢিলেঢালা চলছিল। করোনা অনলাইন ব্যবসায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে অনলাইনে কেনাকাটা প্রচুর বেড়ে যায়। ২০১৫ সাল থেকে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হলেও গত দুবছরে অনলাইনে কেনাবেচা খুবই চাঙ্গা হয়। ফলে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এ বছর কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল পশুর হাট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘ডিজিটাল হাট’ নামক এই পশুরহাট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়াও বিভিন্ন খামারিরা নিজস্ব অনলাইন পেইজ থেকে পশু বিক্রয় করছেন। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রথম সারির ই-কমার্স প্লাটফর্ম হলো- বিক্রয় ডটকম, বেঙ্গল মিট, কিউকম ডটকম, ডিজিটাল হাট, দারাজ গরুর হাট, প্রিয়শপ, দেশী গরু, মাদল, হেক্সা ট্রেডিং, ই-বাজার, অথবা ডটকম, সদাগর, আজকের ডিল ইত্যাদি। চামড়ার বাজার : করোনার কারণে টানা দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সালে) চামড়ার ব্যবসা খুব একটা ভাল হয়নি। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী এ দুই বছরের কোরবানির পশুর চামড়া কিনে লোকসানে পড়েছেন। ২০২০ সালে অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এরইমধ্যে চামড়ার দাম বাড়ার পাশাপাশি রফতানি আয়ও বেড়েছে। ফলে এ বছর কোরবানির ঈদে চামড়ার ভাল দাম পাওয়ার সম্ভাবনা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে চামড়ার বেচাকেনা ভাল হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) জানায়, এবার ব্যবসা আরও ভাল হবে। চামড়া সংরক্ষনে লবনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।