
ছবি: সংগৃহীত
কারবালার শোকগাথা শুধু একটি ধর্মীয় স্মরণ নয়—বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে তা হয়ে উঠেছে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য, স্মৃতি এবং শোকের এক শিল্পিত প্রকাশ। আশুরা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজিত হয় তাজিয়া মিছিল, মজলিস ও শোকসভা—যেখানে ইতিহাস, ধর্মীয় আচার, লোকঐতিহ্য এবং সমকালীন সমাজবোধ মিলেমিশে যায়।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন ও তাঁর সাথীরা ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনাই ইসলামের ইতিহাসে এক বেদনাময় অধ্যায়। শিয়া মুসলমানদের কাছে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
মাহররম মাসের প্রথম দশ দিন জুড়ে চলে শোকানুষ্ঠান, যার শীর্ষ বিন্দু ১০ই মহররম—আশুরা। তাজিয়া মিছিল মূলত কারবালার সেই শোক ও ত্যাগের স্মরণেই।
মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে তাজিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। শোকানুষ্ঠানগুলো ক্রমে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। বাঙালির গ্রামীণ সমাজে কখনো কখনো হিন্দু মৃৎশিল্পের অনুকরণে তৈরী হয় রঙিন তাজিয়া—যা কারবালার রওজা বা কবরের প্রতীক।
বাংলাদেশে মূলত শিয়া মুসলমানদের উদ্যোগে তাজিয়া মিছিল হয়, তবে উপমহাদেশের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রভাবে কিছু জায়গায় সুন্নি সম্প্রদায়ের কিছু অংশও ঐতিহ্য হিসেবে অংশ নেন।
বাংলাদেশে তাজিয়া মিছিলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন আয়োজন ঢাকার পুরান ঢাকার হোসনি দালানে। মুঘল আমলে ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই ইমামবাড়ির বয়স প্রায় ৪০০ বছর।
হোসনি দালান শুধু শোকমজলিসের স্থান নয়—এটি বাংলাদেশের শহর-সংস্কৃতিরও অংশ। আশুরার দিন সকালে এখান থেকে বর্ণাঢ্য শোকমিছিল বের হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা মাতম করেন, শোকগান (মারসিয়া-নওহা) পাঠ করেন এবং কারবালার শোক স্মরণে প্রতীকী রওজা বহন করেন।
একটি অংশ শরীর আঘাত করে (সেলফ-ফ্ল্যাগেলেশন) শোকপ্রকাশও করে—যদিও এটি সীমিত আকারে। হোসনি দালান ট্রাস্টের ভাষায়—এটি ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানবতা ও ত্যাগের শিক্ষা’কে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন শহরে মাহররমের শোকানুষ্ঠান হয়। চট্টগ্রামের বক্সিরহাট এলাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল হয়। খুলনা, বরিশাল, যশোর, রাজশাহী, সিলেট শহরে ছোট আকারে শোকমজলিস, মিছিল বা মজলিস হয় শিয়া পরিবারের উদ্যোগে।
তবে বাংলাদেশের অনেক জেলায় আনুষ্ঠানিক মিছিল হয় না। সেসব এলাকায় মাহররম উপলক্ষে মসজিদ, খানকা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শোকমজলিস, মিলাদ, দরুদ-জিকির এবং তাবারুক বিতরণ হয়।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে, দেশের বহু মসজিদ ও খানকায় মাহররমে শোকানুষ্ঠান হয়। মারসিয়া ও নওহা পাঠ, দরুদ-জিকিরের মাধ্যমে কারবালার বার্তা স্মরণ করা হয়।
তাজিয়া মিছিলকে কেবল ধর্মীয় আচার বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না। উপমহাদেশে এটি এক ধরণের লোকঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলার কিছু অঞ্চলে কাঠ, বাঁশ, রঙিন কাগজ ও মাটির কাজের সমন্বয়ে তৈরী হয় তাজিয়া। এগুলোর অলঙ্করণে থাকে স্থানীয় শিল্পীর হাতের ছাপ।
শিল্পীরা বলেন, এটি শুধু কারবালার শোক নয়—এক ধরণের শিল্পকলাও বটে, যেখানে বেদনা ও নান্দনিকতা একসাথে মেলে।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে দা, ছুরি, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন এবং আতশবাজি ও পটকা ফোটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
গতমঙ্গলবার (২ জুলাই) ভারপ্রাপ্ত ডিএমপি কমিশনার মো. সরওয়ার বিপিএম-সেবা স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আগামী ১০ মহররম ১৪৪৭ হিজরি (৬ জুলাই) পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বিভিন্ন স্থানে তাজিয়া মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাজিয়া মিছিল বাংলাদেশের সমাজে বহুস্থানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও নিদর্শন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা-চিন্তা, নগরায়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের কারণে অনেক এলাকায় আয়োজন সীমিত হয়ে গেছে।
সময়ের সাথে সাথে শোকের প্রকাশ বদলালেও কারবালার বার্তা—অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানবতা ও ত্যাগ—বাংলাদেশের সমাজে রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এ আয়োজনকে দেখছে এক ধরনের ঐতিহ্য-সংরক্ষণ হিসেবে।
হোসনি দালানের এক প্রবীণ আয়োজক বলেন—“প্রতিবছর আশুরার মিছিলে আসা নতুন মুখ দেখে আশ্বস্ত হই—আমাদের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে না। শোকের মধ্যেও এটা আমাদের সংস্কৃতি।”
কারবালার শোক বাংলাদেশের সমাজে যে বেদনার স্মৃতি বয়ে আনে, সেই শোকই আবার মানুষকে কাছে আনে, ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের বার্তা জাগিয়ে তোলে।
ফারুক