
একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩টি প্রতিষ্ঠান
একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩টি প্রতিষ্ঠান। যদিও এক ব্যক্তি বা পরিবারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা বা মালিকপক্ষ হতে বাধা নেই, কিন্তু একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি বিমা আইনেও রয়েছে বিধিনিষেধ। কিন্তু তারপরও এসব নির্দেশনার কোন তোয়াক্কা করেনি সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ওয়াফি শফিক মেনহাজ খান।
তিনি একইসঙ্গে দুইটি বীমা কোম্পানি এবং একটি ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ পদে থাকায় ‘কনফ্লিক্ট অব ইনারেস্ট’ দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। উপরন্তু ওয়াফি মেনহাজের দায়িত্ব গ্রহণের পরও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিমা গ্রাহককের দাবি পরিশোধে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন। এগুলো হলো- জীবন বিমা খাতের সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:, সাধারণ বিমা খাতে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স এবং ব্রোকারেজ হাউজ গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজ লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শফিক মেনহাজ ২০১১ সালের জুন মাসে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে যোগদান করেন এবং এসএমই ও রিটেইল বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
একইসময় থেকে তিনি গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজ নামে একটি ব্রোকারেজ হাউজেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এরপরও তিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব লাভ করেন।
অথচ বিমা আইন অনুসারে শফিক মেনহাজ খান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না। কারণ বিমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা ২০১৩ এর ৩(২)(খ) এর বিউনিক-খ (১৭)(ঙ) অনুসারে তিনি আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থাকলে সেটা বিমা কোম্পানির পরিচালক হওয়ার অযোগ্যতা। কিন্তু তিনি গ্রিনডেল্টা সিকিউরিটিজ লিমিটেড নামক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বোর্ডে যুক্ত আছেন, যা একটি নির্বাহী পরিচালক পদ। ফলে একইসঙ্গে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান (একজন পরিচালক হিসেবে) এবং গ্রিনডেল্টা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে দ্বৈত কার্যনির্বাহীর দায়িত্ব পালন করে আইন লঙ্ঘন করেছেন।
অপরদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র করপোরেট গভর্নেন্স কোড অনুসারেও তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন না। কেননা বিএসইসি’র করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড-২০১৮ এর ৩(১)(সি) অনুসারে, কোনো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইও, কোম্পানি সচিব, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা এবং অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও সুশাসন বিভাগের প্রধান একইসময়ে আরেকটি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদে থাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এসব দ্বৈত নির্বাহীর দায়িত্ব পরিচালনাকে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দন্দ্ব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকদের মতে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মাধ্যমে তারা শেয়ার লেনদেন করে থাকেন। তাছাড়া মার্কেট বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারীদের কোন কোন শেয়ার কিনতে হবে সে পরামর্শও দিয়ে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের নিয়ন্ত্রণও থাকে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে।
কিন্তু শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দুইটি কোম্পানির দায়িত্বে থাকা একটি ব্রোকারেজ হাউজের সিইও যখন বিনিয়োগকারীদের স্পর্শকাতর হিসাবের দায়িত্বে থাকেন, তখন সে সব বিনিয়োগকারীদের শঙ্কায় থাকাটা অমূলক নয়। আবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অমূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কিনতে প্রলুব্ধ করাও অমূলক নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মো. আল-আমিন বলেন, একই ব্যক্তি ব্রোকারেজ হাউজের এমডি, আবার জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি এবং লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান হওয়ায় ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ আছে। যেহেতু তিনি বিমা সেক্টরের দুইটি প্রতিষ্ঠানে আছেন, এখানে খাতভিত্তিক ইস্যু আছে। তাছাড়া ব্রোকারেজ হাউজে থাকলে সেখানে ভ্যালুয়েশনের সঙ্গে, ফ্লোটিংয়ের সঙ্গে বা কোন প্রাইভেট প্লেসমেন্টের সঙ্গে জড়িত আছেন কিনা, সে সব খতিয়ে দেখার বিষয় আছে। কারণ উনি যে সুযোগ পাবেন, অন্য একজন ব্যবসায়ী সে সুযোগ পাবেন না।
এই বিষয়ে ওয়াফি শফিক মেনহাজ খানের কাছে জানতে চাইলে দৈনিক জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বরে যখন সানলাইফের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে তখন থেকে আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। তবে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি হিসেবে নেই। যদি ওয়েবসাইটে এবং গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে আমাকে ডিএমডি হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে সেটা ভুল তথ্য। এ বিষয়ে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলব।
কারণ পাঁচ বছর আগেই সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাকে ডেপুটেশনে গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজের এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজের এমডি’র দায়িত্ব নিতেই গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি’র দায়িত্ব পাই। ব্যাংকগুলোতে যেভাবে ডিএমডি, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বা এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়েন করানোর পর ডেপুটেশনে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে পাঠানো হয়, ঠিক তেমন।
বিএসইসি’র পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, একজন ব্যক্তি যখন ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ দায়িত্বে থাকার পাশাপাশি দুইটি ইস্যুয়ার কোম্পানির সঙ্গেও জড়িত থাকেন, তখন সেখানে ইনসাইডার ট্রেডিং হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ব্রোকারেজ হাউজে থেকে যদি ইস্যুয়ার কোম্পানিতেও জড়িত থাকে তাহলে সেই ব্রোকারেজ হাউজের লাইসেন্স থাকে না।
কারণ ব্রোকার হতে গেলে সে কোনোভাবেই ইস্যুয়ার কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না। এক্ষেত্রে চাইলে বিএসইসি ওই ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইস্যুয়ার কোম্পানিগুলোর লেনদেনের তথ্য খতিয়ে দেখতে পারে, কোন ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কিনা সেটা জানতে। অপরদিকে বিমা আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। আইডিআরএ’র মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি জনকণ্ঠকে বলেন, বিমা আইনের কোনো লঙ্ঘন হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এটিকে খতিয়ে দেখবে।
এরপর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শফিক মেনহাজ শুধু আইন লঙ্ঘনই করেননি, একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানেই ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের অডিট রিপোর্টেও বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত বিমা গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের দাবির টাকা যথাযথভাবে পরিশোধ করতে পারেননি। তাছাড়া এভাবে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত থাকা নিয়েও উদ্বেগ (গোয়িং কনসার্ন) প্রকাশ করেছে নিরীক্ষক।
এদিকে একাধিক দায়িত্বের চাপে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কার্যক্রমে দেখা গিয়েছে শিথিলতা। কমে গিয়েছে গ্রাহক বিমা দাবি পরিশোধের পরিমাণ, জীবন বিমা তহবিল এবং গ্রোস প্রিমিয়ামের আয়ের পরিমাণ। নিরীক্ষকের প্রতিবেদনেও ‘গোয়িং কনসার্ন’ হিসেবে বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ এর অডিট রিপোর্টের ওপর নিরীক্ষক জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির জীবন বিমা তহবিল (আর্থিক প্রতিবেদনের নোট: ৬), মোট প্রিমিয়াম আয় এবং বিমা দাবির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
যদিও তারা বলছে, সময়মতো বিমা দাবি পরিশোধ করায় দাবির পরিমাণ কমেছে; কিন্তু ভবিষ্যতে দাবির অর্থ পরিশোধের সক্ষমতা (সলভেন্সি) নিশ্চিত করতে অ্যাকচুয়ারিয়াল মূল্যায়নের মাধ্যমে লাইফ ফান্ডের ভারসাম্য বিবেচনায় নিতে হবে বলেও জানিয়েছে।
তবে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থান যে ভালো নেই তা বোঝা যায় প্রিমিয়াম আয় কম হওয়া এবং জীবন বিমা তহবিল হতে অর্থ নগদায়ন করায়। সমাপ্ত হিসাব বছরে (৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) প্রতিষ্ঠানটির জীবন বিমা তহবিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৫৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা ২০২৩ সালের সমাপ্ত বছরে ছিল ৫৭ কোটি ৩১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ একবছরের মধ্যে ৭৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা জীবন বিমা তহবিল থেকে নগদায়ন করা হয়েছে।
এই সময়ে মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, যা আগের সমাপ্ত বছরে ছিল ৭৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এছাড়া নিট প্রিমিয়াম গত বছরের ৭৮ কোটি ৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকার বিপরীতে সমাপ্ত বছরে দাঁড়িয়েছে ২৩ কোটি ৭৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা। প্রিমিয়াম আয়ের এই অবস্থাকে ‘হাইলেভেল অব রিস্ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেমস অ্যান্ড আর চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট্স।
তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছেও দীর্ঘদিন যাবত দেনা রয়েছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। অর্থ সংকটে যা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসবের মধ্যে রয়েছে- সরকারের কাছে পরিশোধযোগ্য অর্থ, শেয়ার আবেদন বাবদ টাকা, সন্দেহজনক প্রিমিয়ামের বিপরীতে সংরক্ষিত প্রভিশন, মেডিক্লেইম বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধযোগ্য ব্যালেন্স। এছাড়া আর্থিক প্রতিবেদনের দ্রষ্টব্য ১৬.০২ অনুসারে ‘অন্যান্য অগ্রিম’ শিরোনামে কিছু অর্থ দীর্ঘদিন যাবত সমন্বয় করা ছাড়াই দেখিয়ে আসছে।
প্রভিডেন্ড ফান্ডেও অর্থের পর্যাপ্ততা না থাকায় পিএফের বাজেয়াপ্ত অংশ নির্ধারণ করতে পারেনি। আবার এজেন্ট লাইসেন্স নবায়ন না করেই কোম্পানির বিভিন্ন এজেন্টদের কমিশন বাবদ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক হিসাবমান-১২ অনুসারে প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডেফার্ড ট্যাক্স হিসাব করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানেনি প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ৩৪০টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোতে দীর্ঘদিন যাবত কোনো লেনদেন করা হয়নি। একে সন্দেহজনক বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকরা।
এসব বিষয়ে মতামত জানতে আবারও ওয়াফি শফিক মেনহাজ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি মোবাইলের লাইনটি কেটে দেন। বীমা আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে নক দেওয়া হলেও সাড়া দেননি।
প্যানেল হু