
হাফিজুর রহমান, সাকিফ শামীম ও মীর নাসির হোসেন
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপের কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন চাপের মুখে পড়েছেন। কিন্তু এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই চাপ সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। তবে উত্তরণের পরও যেহেতু তিন বছর সময় পাওয়া যাবে সে কারণে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সম্প্রতি এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, তবে সুযোগও অনেক বেশি থাকবে। তিনি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু প্রণোদনা ওঠে যাবে সেহেতু এলডিসি উত্তরণের পর ব্যবসায়ীদের বিকল্প উপায়ে সহযোগিতা দিতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা সাকিফ শামীম জনকণ্ঠকে বলেন, এলডিসি উত্তরণে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।
উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। মীর নাসির হোসেন জানান, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়া নতুন সংকট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপ। এ অবস্থায় আগামী বছর বাংলাদেশ এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে এলডিসি দেশ হিসেবে এতদিন যেসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া গেছে তা সংকোচিত হয়ে আসবে।
এই সংকট উত্তরণে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমরা এ বিষয়ে বলে আসছি। মীর নাসির হোসেন আরও বলেন, আমাদের অবকাঠামোগত সমস্যা প্রকট, বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও বন্দরে নানারকম সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে। এফবিসিসিআই প্রশাসক হাফিজুর রহমান আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, বেসরকারি খাতের ঋণের সুদ হার স্থিতিশীল রাখা এবং রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণ জরুরি।
অন্যদিকে এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেন, আগামী বছর (২০২৬ সাল) বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ করবে, এই উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই বয়ে আনবে এবং এর ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এখনই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অনেক বাণিজ্যিক সুবিধা কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্য সহায়তা সহজীকরণ এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যা বর্তমানে এলডিসি (স্বল্পোন্নত) সুবিধা দিয়ে সহজ হয়েছে। সাকিফ শামীম এলডিসি হতে উত্তরণের ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন কারণ, এলডিসি সুবিধা কমে যাওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আয়ও কমতে পারে।
এ ছাড়াও, নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং সেখানে নিজেদের পণ্য ও সেবা বাজারজাত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি, এলডিসি উত্তরণে করণীয়, সার্কুলার ও ডিজিটাল অর্থনীতি ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা। সহ-সভাপতি পদে এফবিসিসিআইয়ের জিবি মেম্বারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করে তিনি বলেন, সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ীরাই এদেশের অর্থনীতির প্রাণ।
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৮০ শতাংশ আসে ব্যবসায়ীদের হাত দিয়ে আর তাই এলডিসি উত্তরণের প্রধান চ্যালেঞ্জটিও নিতে হবে ব্যবসায়ীদের। সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হলে এফবিসিসিআইয়ের সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদেরকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান। কোনো ব্যবসায়ী যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন সে বিষয়টি সামনে রেখে কাজ করা হবে। সাকিফ শামীম বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর বিশ্ববাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন খাতের বাণিজ্যিক প্রণোদনা, জিএসপিসহ নানা সুবিধা রোহিত হবে এবং এর সঙ্গে সার্বিক রপ্তানির ওপর চাপ পড়বে।
এই উত্তরণ দেশের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ, ঠিক তেমনি কিছু সুযোগ নিয়ে আসবে। তবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক এবং ওষুধ শিল্পের ওপর এর বড় প্রভাব পড়তে পারে। গ্রাজুয়েট হওয়ার অর্থ হল অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া। রপ্তানি আয়ের ৮০% এরও বেশি অবদান রাখে এমন পোশাক খাত, গ্রাজুয়েট পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে ৮-১২% শুল্কের সম্মুখীন হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং অনুদান কমে যেতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব অধিকার (ঞজওচঝ) চুক্তি পরিপালন-ট্রিপস চুক্তির কঠোর বিধিমালা মেনে চলতে হবে, যা ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বর্তমানে এলডিসি হিসেবে এই শিল্প কিছু ছাড় পায়। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর রয়্যালটি পরিশোধের মতো বিষয়গুলোতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
প্যানেল হু