
.
মানুষ যুদ্ধ চায় না, এটা আসলে বাস্তবতা না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যুদ্ধ চায় কারণ মানুষ ক্ষমতালোভী এবং অর্থলোভী। অর্থের সঙ্গে ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সম্প্রতি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধে বিপুল অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটল এখানে দুই দেশেরই অস্ত্র প্রয়োজন হয়েছে। সেই অস্ত্র আবার কিনতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। তারপর আবার যুদ্ধ! যুদ্ধ যদি নাও হয় তবুও মানুষ সুরক্ষার তাগিদে অস্ত্র কেনাবেচা করবে। এর ফলে যে দেশ থেকে সেসব কিনবে সেসব দেশের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশের অর্থনীতিই মূলত দাঁড়িয়ে গেছে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের ওপর। এজন্যই বলা হয় বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হলো অস্ত্র বাণিজ্য। যত যুদ্ধ তত অস্ত্র। যত অস্ত্র ক্ষয় হবে তত নতুন অস্ত্রের দরকার হবে।
অস্ত্র বিক্রি করেই যদি অর্থনীতির পালে হাওয়া দেওয়া যায় তাহলে ক্ষতি কি! আর যে দেশগুলো অস্ত্র বিক্রি করছে সেসব দেশ তো মোড়ল দেশ। পৃথিবীর হর্তা-কর্তায় পরিণত হয়েছে। মানুষের হাতে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে এবং সেসব অস্ত্র প্রয়োগ করাই মূল উদ্দেশ্য। যতই মানুষ বলুক যে নিজের নিরাপত্তার জন্যই অস্ত্র তৈরি আদতে নিজের ক্ষমতা প্রচার করাই মূল উদ্দেশ্য। আবার নিরপত্তার বিষয়টিও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ আধুনিক অস্ত্র না থাকলে অন্য দেশ খুব সহজেই প্রভুত্ব খাটাতে পারে। আর যে কোনো দেশকে যে কোনো সময়ই যুদ্ধে নামতে হতে পারে। যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয় কার অস্ত্র কত আধুনিক এবং রণকৌশল। আর অস্ত্র না থাকলে শুধু রণকৌশল দিয়ে লাভ কি! কেবল সাহস দিয়ে আজকাল কিছু হয় না। ফলে প্রতিটি দেশ নিজের দেশের অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধি করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। অস্ত্র মানেই বিপুল ব্যবসা। কাড়ি কাড়ি টাকা। একদিকে ধ্বংস আবার অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা। আবার শক্তিমত্তার নির্ণায়কও এই অস্ত্র। বিশ্ব চলছে অস্ত্রের দাপটে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইরান-ইসরাইল এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, কয়েকটি দেশে অভ্যন্তরীণ সংঘাত যেমন- মিয়ানমার পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। জোট এবং জোটনীতিতেও নতুন চিন্তা-ভাবনা যোগ হচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর শক্তিমত্তার অন্যতম নির্ধারক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণেও গতি সঞ্চার করেছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে সম্মত হয়েছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করছে।
গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে সেখানে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি পাকা করেছেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ একাধিক দেশ নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন কিনতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা অঞ্চলটিতে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২৩ সালে সর্বমোট ২৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে সামরিক খাতে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সম্প্রতি আট হাজার ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পাকিস্তান তাদের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, মূলত ভারতের সঙ্গে ১৯ দিনের ভয়াবহ সংঘাত থেকে পাওয়া শিক্ষাই পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা খাতে এমন গুরুত্ব দিতে বাধ্য করল।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানায়, গত চার বছরে বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানি ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ফ্রান্সের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি এবং তৃতীয় থেকে নবম স্থানে থাকা দেশগুলোর সম্মিলিত অস্ত্র রপ্তানির সমান। গত পাঁচ বছরে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে সিপ্রি এর গবেষণায় বিশ্বের শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠান নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রেরই ৪২টি প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে, যাদের দখলে রয়েছে বৈশ্বিক অস্ত্র-বাণিজ্যের মোট আয়ের ৫১ শতাংশ।
নিজেদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করা, হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং এ উদ্দেশ্যে সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা।
সমরক্ষেত্র আধুনিকায়নে ব্যস্ত প্রতিটি দেশ। কেউ অস্ত্র তৈরি করছে আবার কেউ অস্ত্র কিনছে। স্ট্যাটিস্টার সর্বশেষ (১০ মার্চ, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ দশ অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে যৌথভাবে ভারত ও সৌদি আরব। বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ১১ শতাংশই কেনে এই দুই দেশ। এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে- মিসর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, চীন ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, কাতার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ৪ দশমিক ১ শতাংশ, পাকিস্তান ৩ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জাপান ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
আর শীর্ষ ১০ অস্ত্র রপ্তানিকারকদের মধ্যে রয়েছে-যুক্তরাষ্ট্র ৪০ শতাংশ, রাশিয়া ১৬ শতাংশ, ফ্রান্স ১১ শতাংশ, চীন ৫ দশমিক ২ শতাংশ, জার্মানি ৪ দশমিক ২ শতাংশ, ইতালি ৩৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৩ দশমিক ২, স্পেন ২ দশমিক ৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইসরাইল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, পাকিস্তানের আমদানির ৭৭ শতাংশই সরবরাহ করেছে চীন।
পৃথিবী এখন আগের থেকে অনেক বেশি যুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং এই ঝুঁকি মোকাবিলায় দরকার অস্ত্র। অস্ত্র উৎপাদন এবং বিক্রি এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ইতোমধ্যেই অনেক উন্নত দেশ অস্ত্রের আমদানি ও উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে যে এই বাজার আরও বিস্তৃত হবে এবং অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।