ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

মাছের আঁশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১২ জুলাই ২০২৫

মাছের আঁশে  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

.

কয়েকদিন আগে কাওরান বাজারস্থ মাছের পাইকারি বাজারে গিয়েছিলাম। কিছু মাছ কেনার পর আসার সময় লক্ষ্য করলাম যে, রেললাইন ঘেঁষে মাছ কাটার জন্য সারি সারি পুরুষ-মহিলা বঁটি নিয়ে বসে আছে। দেখলাম, তারা মাছ কাটার পর আঁশগুলো বেশ যত্নসহকারে পাশে রেখেছে। অনুসন্ধিচ্ছু মনে একজন বয়সী মহিলা মাছ কাটারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপা এই আঁইশ দিয়ে কি করেন? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, এই যে কাতল মাছের আঁশগুলো টাকার মতো দেখছেন না? আসলে এগুলো টাকা। এই মিষ্টি উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে আলাপান্তে বুঝলাম, পরবর্তীতে এগুলো বিক্রি করে বেশ অর্থের সমাগম হয়। যাইহোক, বাংলায় আঁশ বললেও ইংরেজি শব্দে এটি ‘ঝপধষব’ বলে অভিহিত। সাধারণত মাছের আঁশ উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু সেই আঁশ এখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে শুরু করেছে, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার টন আঁশ রফতানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোয় এবং প্রতি টন আঁশ ন্যূনতম ৩৫০-৪৭০ ডলারে বিক্রি হয়ে থাকে।
মাছের আঁশ বিশ্বব্যাপী নানাবিধ কাজে ব্যবহার হয়। এ আঁশে থাকে কোলাজেন (প্রাকৃতিক প্রোটিন)। তাছাড়া ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহৃত হয়। আর এই কোলাজেন পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এদিকে চীন ও জাপানে এ আঁশ দিয়ে বায়ো পাইজোইলেকট্রিক ন্যানো জেনারেটর তৈরি করা হয়। আর সেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো যে ঘরোয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। এতদ্ব্যতীত মাছের আঁশ ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্নিয়া, মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। একই সঙ্গে জিন্স প্যান্ট ও গ্যাভার্ডিন কাপড়ের ওপর এক ধরনের আঠার প্রলেপ দেয়া হয়, যার ফলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ক্যাপসুলের খোসা ও প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতেও মাছের আঁশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পরিবেশ দূষণের মধ্যে বিশেষ করে পানি দূষণের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হলো হেভী মেটাল পলুশন। আর এই পলুশন রোধে মাছের আঁশ বেশ কার্যকর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৭ হাজার টনের উপরে মাছের আঁশ উৎপন্ন হয়। আর এর মধ্যে ৯০ ভাগই রপ্তানি হয়। মূলত জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীনে এসব আঁশ অধিক রপ্তানি হয়। প্রতি টন আঁশ ৩৫০-৪৭০ ডলারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশ বছরে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার মাছের আঁশ রপ্তানি করে। আর এ পেশার সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং এক্ষেত্রে প্রায় ১৫টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। 
মাছের আঁশ সংগ্রহ করার পর, সেই আঁশগুলো স্বচ্ছ পানি অথবা গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর রোদে শুকানোর পর ঝরঝরে করা হয়। এর পরই বিক্রির উপযোগী হয়। বছরে দুই থেকে তিনবার পাইকারদের কাছে এ আঁশ বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকার এসে মাছের আঁশগুলো কিনে নিয়ে যায়। প্রতি মণ আঁশ ৩৬০০-৪০০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। শুধু আঁশ নয়, মাছের নাড়িভুঁড়িও বিক্রি হয়। অবশ্য নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করা হয় মাছের খাদ্য হিসেবে। এদিকে মাছের জাত অনুযায়ী আঁশের দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। রুই-কাতলাসহ বিভিন্ন বড় মাছের আঁশের দাম তুলনামূলক বেশি। আর আকার মোতাবেক ছোট মাছের আঁশের দাম কম। তথ্য মতে জানা যায়, ‘বাংলাদেশে মাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন উপাদান তৈরির সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। কিন্তু এর মূল অন্তরায় হচ্ছে প্রযুক্তির অপ্রতুলতা বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণার অভাব। তাছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সৃষ্টির জন্য সহযোগিতার অভাব। শুধু তাই নয়, অদ্যাবধি এ খাতে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের তেমন কালচার গড়ে উঠেনি। 
এ ব্যাপারে সঙ্গতকারণেই তিনটি জেলার কর্মকাণ্ড সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি। তথ্যানুযায়ী,  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছের আঁশ (আইস) রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। মাছের এই উচ্ছিষ্ট অংশ (আঁশ) বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন অনেক জেলে পরিবার। জেলার প্রায় ৫০টি পরিবার মাছের আঁশ শুকানোর সঙ্গে জড়িত। তথ্যমতে জানা যায় যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৫ লাখ টাকার মাছের আঁশ বিক্রি হয়। এ সূত্র ধরে আরও জানা যায়, জেলে পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিন মাছের আঁশ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। 
পূর্ণিমা দাস নামে এক গৃহবধূ জানান, মাছের আঁশ শুকিয়ে মাসে তিনি ৮-১০ হাজার টাকা আয় করেন। 
এদিকে টাঙ্গাইল শহরের বড় দুই বাজার অর্থাৎ পার্ক বাজার ও ছয়মনি বাজার থেকে ১৫-২০ জন মাছ কাটার পাশাপাশি নিয়মিত মাছের আঁশ বিক্রি করে থাকেন। আর টাঙ্গাইলের ছয়আনি মাছের বাজারে নিয়মিত মাছ কাটেন সজীব। তিনি মাছ কাটতে প্রতি কেজিতে নেন ২০-৩০ টাকা করে। মাছ কাটেন বেলা ১টা পর্যন্ত। আর মাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ বিক্রি করে বছরে বাড়তি আয় করে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি বছর ছয়-সাত মণ মাছের আঁশ বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। একই কাজ করা মো. সোহেল নামের একজন বলেছেন, তিনি প্রায় ১৪ বছর ব্যাপী মাছের ব্যবসা করেন। 
আর মাছের আঁশ বিক্রি করেন প্রায় সাত বছর ধরে এবং বছরে দুই-তিনবার মাছের আঁশ বিক্রি করে থাকেন। এদিকে পাবনার সদর উপজেলার রানীগ্রামের মর্জিনা খাতুন বছর চারেক আগে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এখন তিনি মাছের আঁশ ও বর্জ্য বিক্রি করে সংসার চালান। এ প্রেক্ষাপটে তিনি জানান, তার স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছেলে স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। তারা বাড়িতে আসার সময় ভেজা মাছের আঁশ ও বর্জ্য কিনে আনেন। সেগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে আঁশ বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় হয়। এভাবে প্রায় প্রতিটি জেলায় মাছের আঁশ বিক্রির প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। 

প্যানেল

×