
.
যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তবে তা নিঃসন্দেহে আমাদের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে যখন তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের বড় অংশ নির্ভর করে, তখন এ ধরনের শুল্ক চাপ দেশের অর্থনীতি, শ্রমবাজার এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে। এ রপ্তানির ওপর থেকে মোট ১১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার শুল্ক আদায় করেছে দেশটি। গড়ে শুল্ক আদায় হয়েছে ২১ শতাংশ হারে। অথচ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের পোশাকপণ্য থেকে গড়ে ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ শুল্ক আদায় করেছিল দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আদায়সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ থেকে ১০ ডলারের একটি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নেওয়ার জন্য গড়ে ১ দশমিক ৬৭ ডলার শুল্ক দিতে হতো। চলতি বছরের একই সময়ে একই মূল্যের পণ্যে শুল্ক দিতে হয়েছে ২ দশমিক ১১ ডলার। আগামী ১ আগস্ট থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে তা আরও বাড়বে।
২০২৪ সালে মে মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছিল ৫৭ কোটি ডলারের পোশাক। চলতি বছরের মে মাসে প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। অতএব বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ। শুল্ক-কর বৃদ্ধির পরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের রপ্তানি বেড়েছে ১৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের মে মাসে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে ১০৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। চলতি বছরের মে মাসে তা ১২৩ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘নতুন করে পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। কারণ অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ককর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক নেওয়ার কথা নয়। এ জন্য দরকষাকষির মাধ্যমে আমাদের শুল্ক-কর প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার। তৈরি পোশাক খাতের একটি বড় অংশ এখানেই রপ্তানি হয়। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে প্রতিযোগী দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া বা কম্বোডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও এ ধরনের শুল্ক আরোপের ফলে তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক লাখ শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। কারখানা বন্ধ হওয়া, উৎপাদন হ্রাস পাওয়া বা রপ্তানি আদেশ বাতিলের ঘটনা ঘটতে পারে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রপ্তানি আয় কমলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রবাহ কমে যাবে যা চাপ তৈরি করবে রিজার্ভে। এতে আমদানি ব্যয় মেটানো, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের শুল্ক আরোপ কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক সংকেতও বহন করে। এটি মার্কিন প্রশাসনের নীতিগত বার্তা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ করে যদি এটি মানবাধিকার, শ্রমনীতি বা কূটনৈতিক অবস্থানের প্রতিক্রিয়ায় হয়ে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী?
দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি বিকল্প বাজার খোঁজা ও পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশের জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে তৈরি পোশাক ছাড়াও প্রযুক্তি, কৃষিপণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস ইত্যাদি খাতেও রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যের গুণগতমান, সাস্টেইনেবিলিটি ও ট্রেড কমপ্লায়েন্স বজায় রাখা প্রয়োজন। শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের আস্থা অর্জন করতে হবে।
পরিশেষে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা নির্ভরযোগ্য রাখতে হলে কূটনৈতিক সংলাপ, অর্থনৈতিক কৌশল ও নীতিগত উন্নয়ন সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে। একতরফা শুল্ক আরোপের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি ও বিকল্প পথ থাকা আবশ্যক।
প্যানেল