ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

টেকসই ও সবুজ অর্থায়ন

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ৩২ শতাংশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২০ জুন ২০২৪

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ৩২ শতাংশ

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ৩২ শতাংশ

অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততা। ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে তা বন্ধে শুরু হয়েছে নানামুখী কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যাংক। কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রকল্পে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করছে। সবুজ ও টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব খাতে অর্থায়নে নজর বাড়াচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশই এই খাতে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবুজ অর্থায়নে মোট বিনিয়োগ করেছে ৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। একই সময়ে টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করেছে ৮৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট বিনিয়োগ করেছে ৯৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এই প্রসঙ্গে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতে টেকসই বা স্থায়িত্ব আনতে হলে সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ও গ্রিন ফিন্যান্সিং খাতে বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পরিবেশগত ঝুঁকি, সামাজিক ও করপোরেট গভর্ন্যাস ঝুঁকি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠতে হলে এ খাতে বিনিয়োগ করতেই হবে। তারা বলেন, যেসব ব্যাংক নীতিমালা মেনে এই খাতে অর্থায়ন করবে, তারাই ভবিষ্যতে ভালো করবে। এ ছাড়া এসব খাতে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক কিছু মানদ- রয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করলে আরও অগ্রগতি আসবে।

একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রিন ব্যাংকিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্যোগের ফল হিসেবে আশা করা যায়, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে টেকসই অর্থায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫০ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই অর্থায়নে ২০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো টেকসই অর্থায়নে ১৪টি ক্যাটাগরিতে মোট ৭০টি পণ্যের বিপরীতে ঋণ দিতে পারে। এসব পণ্যের অধিকাংশই সবুজ অর্থায়নের অন্তর্ভুক্ত। এই তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত ৮৭৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে এই তহবিলের আকার বাড়ানো হবে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৭টি ব্যাংক ও পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবুজ অর্থায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। অর্থাৎ তারা মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ করেছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক আল-ফালাহ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইডকল, আইপিডি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি এবং আইডিএলসি ফাইন্যান্স। এ ছাড়া ২৬টি ব্যাংক ও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই অর্থায়নে বিনিয়োগ করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মধ্যে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি নির্মাণ, পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন অন্যতম। এই খাতে মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার শর্ত রয়েছে। টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে দুই বছর ধরে বিভিন্ন মানদ-ে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রতিবেদনের শেষে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। পুনঃঅর্থায়ন সবুজ ব্যাংকিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে এই খাতে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। 
কয়েকটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত সরকারের শীর্ষ পর্যায় এবং রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই অর্থায়নের জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। 
আমরাও আমাদের জনশক্তিকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছি সবুজ অর্থায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শাখাভিত্তিক সবুজ অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান গ্রাহকের সাধারণ প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে রূপান্তর এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব বিষয়গুলো নিশ্চিতকরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 
আসলে কোনো কিছু অর্জনের জন্য সম্পৃক্ত বিষয়ের সঙ্গে যারা কাজ করবেন, তাদের মাইন্ডসেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে অগ্রযাত্রা বেগবান করতে সর্বদা সক্রিয়। একইভাবে সাসটেইনেবল ফাইন্যান্সের বিষয়ে সরকার যে গুরুত্বারোপ করেছে, আমরা তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং পরিবেশবান্ধব খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের গ্রাহকদেরও বিষয়টির যথার্থতা ও গুরুত্ব বোঝাতে প্রতিনিয়ত কাজ করছি।

×