
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্বলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। সকলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশীরাও বিনিয়োগ করবে, স্থানীয় লোকেরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিনিয়োগ বেড়ে যায়, অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো সচল হতে শুরু করবে। আর অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে। সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবে। বিনিয়োগ হবে বাধাগ্রস্ত। অর্থনীতির সংকট উত্তরণ কঠিন হতে পারে।
নির্বাচন পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার না হলে যে দলই ক্ষমতায় যাক তারা মেয়াদপূর্ণ করতে পারবে না। কারণ অর্থনীতির অবস্থা ভালো না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে এক নায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও ঠিকে থাকে না। কারণ টিকে থাকতে হলে জনগণকে কিছু দিতে হবে।
বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের ও কম। নির্বাচনকালীন এই সময়ে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে বড় কিছু করাও সম্ভব নয়। তাই এ সময়ে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমদানির ওপর কড়াকড়ি পরিস্থিতিকে আরও সংকটে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন রপ্তানিবৃদ্ধি, প্রবাসী আয় বাড়ানো। কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য চলমান রাখার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবরোধ, ধর্মঘট অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা মনে করেন এ ধরনের পরিস্থিতি হলে দিনে তাদের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। অর্থনীতিবিদদের নানা গবেষণা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির নানা ক্ষতির দিকগুলো মিডিয়ায়ও প্রচারিত হচ্ছে। হরতালে যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ, বন্দরে মালামাল খালাশসহ উৎপাদনমুখী শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর নয়। সকলের মতামত ও সংলাপের মধ্যদিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ঘটিয়ে অর্থনীতিতে সু-বাতাস বয়ে আনার সুযোগ তৈরি প্রয়োজন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না থাকলে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ, আমদানি রপ্তানিসহ উন্নয়ন ও উৎপাদনের পথ হয়ে যাবে রুদ্ধ। ভুল পথে থেকেও আমরা সঠিক পথে আছি-বললে ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। অর্থনীতির বর্তমান যে সংকট তা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা জানি সামষ্টিক অর্থনীতির চলকগুলো একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। একটি খারাপ হলে অন্যগুলোর উপরেও এর প্রভাব পড়ে। তবে আপাতত ৩টি সমস্যা মোকাবিলা করা জরুরি। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার ও রিজার্ভ পরিস্থিতিতে স্বস্তি আনা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন।
এ খাতে ঋণ আদায়ের হার এত নিচে নেমে এসেছে যে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংক খাতের উপর মানুষের যে আস্থা ও বিশ^াস তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কি-না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে সাধারণ জনগণ। পত্রিকার পাতা, মিডিয়ায় ব্যাংকের নানা অনিয়মের খবরে আমানতকারীদের মধ্যে থাকে সন্দেহ-সংশয়। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর ২০২২-এর চেয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি। সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত শ্রেণিকৃত ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর এ হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বর্তমানে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এদিকে ডলার সংকট তো কাটছেই না। রেমিটেন্স কম, রপ্তানি আশানুরূপ নয় এবং বৈদেশিক ঋণের প্রবাহও কম। ব্যাংকিং চ্যানেলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতিরও ঊর্ধ্বগতি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের উপর। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে। এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটি ভালো নির্বাচন প্রয়োজন।
নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তার উপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের নির্বাচনী ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করা সম্ভব নয়।