ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পরিবার হোক সুপরিকল্পিত

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ১২ জুন ২০২৫

পরিবার হোক সুপরিকল্পিত

ধনধান্য পুষ্প ভরা আবহমান বাংলা। ডি এল রয়ের সাঙ্গিতীক মূর্ছনাই শুধু নয় সত্যিই শ্যামলের সমারোহে নদীমাতৃক দেশটির উর্বর পলিমাটিও বিধাতার উত্তম উপহার। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিলেন- বীজ মাত্রই নাকি এখানে সোনা ফলে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত শাশ্বত বাংলার নয়নাভিরাম শৌর্যের পাশাপাশি কত বিপদ-বিপত্তি যে মাথা চাড়া দেয় তাও সবুজের প্লাবনে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি। অনিন্য সুন্দর বাংলার সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ জনসংখ্যার ভারে কত অসময়কে সামলাতে হয়। সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, নির্বিকার জীবনাচরণ সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনার প্রতি চরম উদাসীনতা যেন লেগেই থাকে। ছোট্ট এই দেশটি ১৮ কোটি মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত হলেও আয়তন অনুযায়ী অধিক জনসংখ্যার অঞ্চল হিসেবেও বিশেষভাবে চিহ্নিত। 
জনসংখ্যা যদি নিয়মিত পালাক্রমে জীবন আর সমাজকে ভারবাহী করে তোলে তা হলে তো সমস্যা পদে পদে। বারবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা দেশ ও জাতির অমঙ্গল বয়ে আনে। বাংলাদেশে এখনো সিংহভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে শিক্ষার আলো সেভাবে সংশ্লিষ্টদের জীবনকে আধুনিকতার বলয়ে প্রতিফলিত না করাও। সমাজ সংস্কারের প্রচলিত বিধি। তাই বিবাহিত জীবনে যা সাবধান বাণী কোনোভাবেই দুটির বেশি অধিক সন্তান নয়। তা আজও কেন মান্যতা পেল না তেমন প্রশ্ন থেকেই যায়। মূল কারণ হিসেবে আলোচনায় চলেই আসে বাল্যবিয়ের মতো চিরায়ত অপসংস্কার। যা আজও ঠৈকানো গেল না। বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। শুধু কি তা-ই? অধিক সন্তানের জননী হওয়াও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এক প্রকার পথে পথে কাঁটা ছড়ানোর মতো। অপরিণত বিয়ে মানেই শিক্ষার যথার্থ আলো থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার আগেই তাকে কনের সাজে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে উঠে আসে আরও দুঃসহ কণ্টাকিত পিচ্ছিল পথ। শুধু কি অকাল মাতৃত্ব? বলা হচ্ছে এক কন্যা শিশুর গর্ভে আর এক নবপ্রজন্মের ভ্রƒণ বড় হচ্ছে যে নাকি পৃথিবীর আলো দেখার জন্য অপেক্ষমাণ। তাই পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টা উড়িয়ে না দিয়েও বলা যায় সবার আগে বাল্যবিয়ের লাগাম টেনে ধরা। 
যে কোনো মূল্যে কন্যা শিশুর বিয়ে বন্ধ করা। ঊনবিংশ শতাব্দফর আধুনিক প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর বলেছিলেন বালিকাদের বিয়ের পিঁড়ি নয় বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা অর্জনও জরুরি। আমাদের দেশে নাকি ৩ কোটি ৪৫ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে, অর্থাৎ শরীর-মনের জন্য জরুরি সীমা রেখাটি লঙ্ঘন করা। আবার এক কোটি তিরিশ লাখের বিয়ে যে ১৫ বছরের নিচে। তাই সুস্পষ্টতই প্রতীয়মান দক্ষিণ এশিয়ার বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আমরা এগিয়ে আছি। যে বালিকা বধূটি তার নিরাপত্তার বিষয়ে অজ্ঞাত সে কিভাবে ভাবী প্রজন্মের কথা ভাববার অবকাশ রাখবে? আর পরিবার পরিকল্পনা বিষয়টি তেমন সহজসাধ্য নয়। চিরায়ত সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ কোনো শিশু কন্যার নিজের মতো তৈরি হওয়ার আগেই আরেক শিশুর জন্ম দিয়ে বসে। সঙ্গত কারণে অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রতিরোধ করার প্রধান এবং প্রাথমিক কাজটিই হলো বাল্যবিয়েকে যে কোনো মূল্যে ঠেকানো। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা। আর নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনার শক্তি ও সাহস ভেতরের বোধে জাগিয়ে তোলা। 
স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মিলিত সংসারে পরিবারের শক্ত ভিত তৈরি হয়। সেখানে শিশু কন্যার সঙ্গে নতুন গ্রন্থিতে যদি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ তার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন তা হলে বিপত্তি পদে পদে। সিংহভাগ গ্রামের অসচেতন এবং অশিক্ষিত স্বামী কোনোভাবেই বালিকা স্ত্রীকে সেভাবে মর্যাদা দেন না- কোনো কথায় কর্ণপাতও করেন না। আর পরিবার পরিকল্পনা? সেটা কোনো কাজের মধ্যে না আসাও পরিস্থিতির বিপন্নতা। অকাল কিংবা ঘন ঘন মাতৃত্বের কারণে নবজাতক শিশু মৃত্যু গণমাধ্যমের পাতাকে ভারি করে তোলে। তবে আমরা বাংলাদেশেও বিভিন্ন গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা সন্তান প্রসবের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা দেখতে পাই। বলা হচ্ছে যান্ত্রিক কলা-কৌশলকে যত তাড়াতাড়ি মানুষ আয়ত্বে আনে সেখানে চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধ, চিরায়ত সংস্কার পাল্লা দিতে পারেই না। ক্রমশ পিছু হটে বলে বিভিন্ন অসঙ্গতি দৃশ্যমান হয়। যেমন পরিবার পরিকল্পনার হরেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে সহজ বোধে, নির্ভীক চেতনায় গ্রহণ করার মানসিকতা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে অপ্রতুল। তেমন অবস্থায় নব দম্পতিদের যদি সচেতন সাবধানতায় নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তৈরি করা না যায় তা হলে পদ্ধতি কোনো কাজেই আসবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নেবেন একজন সন্তানের পর নিদেনপক্ষে ৩-৪ বছরের ব্যবধানে অন্য সন্তান নিয়ে ভাবা। সেখানেই শেষ নয়। দুটি সন্তানের পর আর কোনো সন্তানের চিন্তা করাও যেন ভাবার অবকাশ না থাকে। তাই কন্যাটিকে লেখাপড়ায় জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল এক পরিবেশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। যাতে নিজেই সতর্ক অবস্থায় সুরক্ষিত বলয় তৈরি করতে পারে। ঘন ঘন সন্তান প্রসব ও মা আর শিশুর জন্য সুফল বয়ে আনে না। পরীক্ষিত এবং বাস্তবোচিত চিত্র। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন মহাযজ্ঞে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। সঙ্গে মান্ধাতা আমলের বিধি, সংস্কার, চিন্তাও ঝেড়ে ফেলতে হবে। 
পুত্র-কন্যা যেই পৃথিবীর আলো দেখুক সমতার ভিত্তিতে ভাই-বোনকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি করা মা-বাবা দুজনেরই অপরিহার্য দায়বদ্ধতা। অবুঝ আর অবোধ বালিকাকে প্রথমেই পাঠাতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জ্ঞানের শিখা বিচ্ছুরিত হয়ে সন্তান নিজের ভালো-মন্দ, আনন্দ, দুঃখ- সবই যেন তার চেতনায় ধারণ করতে পারে। নারী জাগরণের আর এক পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও সচেতন দায়বদ্ধতায় আবেদন জানিয়েছেন বালিকাদের জ্ঞানের জগৎকে উন্মুক্ত করে দিতে। যা শুধু নিজেকে নয় পুরো সামাজিক বলয়কে সমস্ত দুর্দশা আর অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। তিনি রংপুরের পায়রাবন্দ এলাকায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল নামে বালিকা বিদ্যালয় খোলার ইতিহাসও তৈরি করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও নিজ উদ্যোগে বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে বাল্যবিয়ে, অপরিণত মাতৃত্ব ঠেকানোর উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। এখন আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যগগনে। 
ইতোমধ্যে বাল্যবিয়ে একদম কমছে না তা নয়। কিন্তু যতখানি প্রয়োজন সে তুলনায় অপ্রতুল। আর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও এখন গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে সময়ের আবেদনে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ শুধু মনস্তত্ত্ব কিংবা চেতনা গ্রহণের ব্যাপার নয়। শরীর-স্বাস্থ্য তার উপযোগী কি না সেটাও বিবেচ্য বিষয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সেবা গ্রহণও আবশ্যক। তাই পরিবার পরিকল্পনার মতো আধুনিক চেতনা সমৃদ্ধ ব্যবস্থাপনা ক্রমশ এগিয়েও যাচ্ছে। সামনে তা আরও বাড়বে যদি অবোধ বালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানো না হয়। যদি নিজেকে তৈরি করার সুযোগ আসে।

প্যানেল

×