
ছবি: জনকন্ঠ
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১৩নং গোপালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত মিঠাপুকুর ইকো পার্কটি ২০১৪ সালে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্বোধন করা হলেও, এক দশক পেরিয়েও এটি এখন চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার শিকার। ২২৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই পার্কটি শাল্টিগোপালপুর রেঞ্জের আওতায় বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, জনবলের স্বল্পতা এবং বনদস্যুদের দৌরাত্ম্যের কারণে এর ভবিষ্যৎ ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
দুর্লভ বৃক্ষ ও জীববৈচিত্র্য সংকটাপন্ন:
মিঠাপুকুর ইকো পার্কে রয়েছে হাজার হাজার শাল গাছ, যা অত্যন্ত দুর্লভ প্রজাতির। এছাড়াও মিনজিরি, গর্জন, তেলশুড়, কড়াই, আকাশমনি, চাপালিশ, রক্ত চন্দন ও পারুল-এর মতো মূল্যবান গাছপালা পার্কের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অর্জুন, আমলকী, বহেড়া ও হরীতকী-এর মতো ঔষধি গাছের সমারোহও রয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে কিছু অর্কিড দেখা গেলেও, বনের গভীরে প্রবেশ করলে মাঝে মাঝে খেঁকশিয়াল, কাঠবিড়ালি, সাপ, বেজি ও ব্যাঙ-এর দেখা মেলে। উদ্বোধনের পর তিনটি অজগর সাপ পার্কে ছাড়া হলেও, সংরক্ষণের অভাবে তাদের অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে।
অবকাঠামোগত বেহাল দশা:
১৯৫১ সালে নির্মিত একটি মাটির ঘরে আজও বন বিভাগের দাফতরিক কার্যক্রম চলে, যা পার্কের বেহাল দশার প্রতিচ্ছবি। ইকো পার্কের ফটক প্রায়শই বন্ধ থাকে, যার ফলে দর্শনার্থীরা বন বিভাগের ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হন। বিদ্যুৎ সংযোগ কেবল রেঞ্জ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কার্যালয়েই সীমাবদ্ধ। দর্শনার্থীদের জন্য গোটা পার্কে স্যানিটেশনের জন্য মাত্র দুটি কক্ষ থাকলেও, সেগুলো জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী। শিশুদের খেলাধুলার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, বরং কয়েকটি জরাজীর্ণ দোলনা ভেঙে পড়ে আছে। ভ্রমণপিপাসুদের ক্লান্তি শেষে বসার জন্য মাত্র চারটি বেঞ্চ ও ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে, যা বিশাল পার্কের তুলনায় অপ্রতুল।
জনবল সংকট ও বনদস্যুদের তাণ্ডব:
ইকো পার্কের কার্যক্রম মাত্র ছয়জন বনরক্ষক, একজন বিট কর্মকর্তা এবং একজন রেঞ্জ কর্মকর্তা দিয়ে পরিচালিত হয়। তারা মূলত সামাজিক বন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, ইকো পার্কের জন্য আলাদাভাবে কোনো জনবল নিয়োগ করা হয়নি। এই স্বল্প জনবল দিয়ে বিশাল বনভূমি ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর ফলস্বরূপ, উপযুক্ত সীমানাপ্রাচীর না থাকায় রাত হলেই বনদস্যুরা বনাঞ্চলের ভেতর থেকে দুর্লভ প্রজাতির মূল্যবান শাল গাছ কেটে সাবাড় করছে। দুষ্কৃতকারীদের অবাধ বিচরণ পার্কের নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে।
সম্ভাবনার অপচয়:
প্রতি বছর কিছু কিছু বরাদ্দ দিয়ে পার্ক উন্নয়নে কাজ করার কথা থাকলেও, তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না। যথাযথ উদ্যোগ ও বিনিয়োগের অভাবে মিঠাপুকুর ইকো পার্ক তার পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে পারেনি। যদি এই পার্কটিকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা যেত, তাহলে এটি কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। স্থানীয় অর্থনীতিতে এটি একটি বিশাল ইতিবাচক প্রভাব ফেলত, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করত এবং পরিবেশ সংরক্ষণেও অবদান রাখত।
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা:
উদ্বোধনের পর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, পশু-পাখিসহ অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ বা পর্যটক আকর্ষণে কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এই উদাসীনতা মিঠাপুকুর ইকো পার্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশকর্মীরা অবিলম্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন, যাতে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা যায় এবং এর পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়।
মুমু