ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রেললাইনের ওপর মানুষ কেন ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পায় না?

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২৫ মে ২০২৫

রেললাইনের ওপর মানুষ কেন ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পায় না?

ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালের নভেম্বর। মার্কিন জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসিতে প্রচারিত একটি ব্যতিক্রমী রিপোর্ট তখন ব্যাপক চাঞ্চল্যের জন্ম দেয়। ‘টুডে শো’ প্রোগ্রামের রিপোর্টার জেএফ রোজেনের মাথায় ঘুরছিল একটি সাধারণ অথচ বিপজ্জনক প্রশ্নপেছন দিক থেকে আসা ট্রেনের শব্দ সত্যিই কি শোনা যায় না? প্রশ্নটা শুনতে সহজ মনে হলেও এর উত্তর নিয়ে সন্দেহ ছিল তার মনে।

তার এই কৌতূহলের উত্তর খুঁজতেই শুরু হয় এক্সপেরিমেন্ট। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একদিন ক্যামেরা ও টিম নিয়ে তিনি রেললাইনে দাঁড়ানট্রেন আসার দিকের বিপরীতে মুখ করে। চারপাশ নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর পেছন দিক থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রেন এগিয়ে আসে, যার গতি ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। অবাক করা বিষয় হলো, ট্রেনটি একেবারে কাছে চলে না আসা পর্যন্ত রোজেন কোনও শব্দই শুনতে পাননি। ট্রেন তাকে অতিক্রম করার মাত্র পাঁচ সেকেন্ড আগে তিনি শব্দ টের পান।

গবেষণা বলছে, যদি ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার হতো, রোজেনের হাতে থাকত মাত্র ২ সেকেন্ডযা কোনওভাবেই সরার জন্য যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশেও ভয়াবহ চিত্র: শুধু হেডফোন দায়ী নয়

প্রতিদিনের মতো বাংলাদেশেও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর খবর নতুন কিছু নয়। অনেক সময় কানে হেডফোন, অসতর্কতা বা লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা আরও গভীর। উন্নত দেশগুলোতেও এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা কম নয়। যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ শতাধিক এবং যুক্তরাষ্ট্রে সাত থেকে আটশো মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হন।

এখন প্রশ্নএত বড় এবং ভারী বাহন ট্রেন, যার রয়েছে হুইসেলসহ নানা শব্দ, সেটিকে এত কাছে না আসা পর্যন্ত মানুষ কেন শুনতে পায় না?

চারটি প্রধান কারণ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা

প্রথমত, রেললাইন তৈরি হয় মোটা ধাতব পাত দিয়ে। ট্রেনের শব্দের একটা বড় অংশই রেললাইনের মাধ্যমে শোষিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, ট্রেনের লম্বাটে কাঠামো সামনে V-আকৃতিতে বাতাস কেটে শব্দ ছড়িয়ে দেয়, তাই পাশ থেকে শব্দ সহজে কানে পৌঁছায় না।

তৃতীয়ত, অধিকাংশ রেললাইনই গাছপালা ঘেরা নীরব অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যায়, যা শব্দ ছড়াতে বাধা দেয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের মনস্তত্ত্ব। একে বলা হয় ‘হ্যাবিচুয়াল কনফিডেন্স’ বা অভ্যাসগত আত্মবিশ্বাস। প্রতিদিন একই রাস্তায় ট্রেন না দেখে বা দুর্ঘটনা না ঘটায় মস্তিষ্ক ধরে নেয় এটি নিরাপদ। এভাবে সাবধানতা হ্রাস পায় এবং একসময় ঘটে প্রাণঘাতী ভুল।

মস্তিষ্ক যখন বিপদ চিনতে ভুলে যায়

যে ব্যক্তি প্রতিদিন রেললাইন পার হন, তিনি যদি নিয়মিত ট্রেন না দেখেন, তখন তার মনস্তত্ত্ব সেই সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করে। এই আত্মবিশ্বাসেই একদিন ঘটে বিপদ। যে সময় তার চোখ-কান সজাগ থাকার কথা, সেই সময় সে থাকে আত্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন।

বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, একাধিক ব্যক্তি একসঙ্গে হাঁটছেন বা বসে আছেন লাইনের ওপর। তারা সবাই নিশ্চয়ই হেডফোন ব্যবহার করছিলেন না। এদের অনেকেই এই ‘অভ্যাসগত আত্মবিশ্বাস’-এর শিকার।

গবেষকরা বলছেন, যখন মস্তিষ্ক বিশ্বাস করে বিপদের আশঙ্কা নেই, তখন আসল বিপদেও তা সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। তাই শুধুমাত্র কান নয়, চোখ দিয়ে নিশ্চিত হতে হবে ট্রেন আসছে না।

ট্রেনের লাইনের কাছে গেলেই চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। সিগনাল মানতে হবে। ট্রেনকে কখনো বন্ধু ভাবা যাবে না। কারণ একবার ভুল হলে দ্বিতীয়বার আর সুযোগ নাও আসতে পারে। জীবন একটি অমূল্য উপহার, সেটি রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।

 

সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=DkFcpZ26fF8

রাকিব

×