ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আসল নকলের জটিল ধাঁধা! আপনি কি আসলেই আগের সেই মানুষ?

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৩ মে ২০২৫

আসল নকলের জটিল ধাঁধা! আপনি কি আসলেই আগের সেই মানুষ?

ছবিঃ সংগৃহীত

প্রায় ১০ বছর আগে আপনি যে শরীরকে নিজের বলতেন, আজ তা আর নেই। আপনার শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষই এখন নতুন। সেই পুরনো স্মৃতি, চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা—সবই আংশিক বা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তাহলে কি আপনি আগের সেই মানুষ নন? শুধুই কি একটি পুরনো নাম বহন করছেন? এই প্রশ্ন বহু বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের মস্তিষ্কে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এই পরিচয় সংকটের শিকড় খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হয় প্রাচীন গ্রীসের গল্পে—এক সাহসী বীর থিসিয়াস ও তার বিখ্যাত জাহাজের কাহিনিতে। থিসিয়াস ছিলেন গ্রীসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর, যিনি বহু অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তার জাহাজটি ছিল তার অভিযান সঙ্গী—একটি ঐতিহাসিক প্রতীক।

থিসিয়াসের মৃত্যুর পর তার সম্মানে সেই জাহাজটি সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি বছর একটি বিশেষ উৎসবে জাহাজটি প্রদর্শন করা হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জাহাজের কাঠ ক্ষয় হতে শুরু করে। তখন স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নেন, ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়া কাঠগুলো নতুন কাঠ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে।

বছরের পর বছর ধরে কাঠ বদলের এই প্রক্রিয়া চলে। একসময় দেখা গেল, পুরো জাহাজের সব কাঠই নতুন। তখনই প্রশ্ন উঠল—এটি কি আগের সেই থিসিয়াসের জাহাজ, নাকি একটি সম্পূর্ণ নতুন জাহাজ?

এই প্রশ্নটি শুধু একটি কৌতূহলের বিষয় নয়, বরং দার্শনিক ইতিহাসে এটি পরিচিত "থিসিয়াসের জাহাজ প্যারাডক্স" নামে। প্রাচীন দার্শনিক প্লুটার্ক থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিক টমাস হবস, জন লক পর্যন্ত এই প্যারাডক্স নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন।

ধরুন, কেউ যদি থিসিয়াসের পুরনো কাঠগুলো সংরক্ষণ করে আর তা দিয়ে আবার একটি জাহাজ তৈরি করে, তাহলে কোনটি হবে আসল থিসিয়াসের জাহাজ? পুরনো কাঠ দিয়ে তৈরি জাহাজটি, নাকি ইতিহাস ও স্মৃতি বহন করা সংস্কারকৃত নতুন কাঠের জাহাজটি?

এই দ্বন্দ্বই আমাদের পরিচয় ও অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন তোলে। আপনি যেহেতু প্রতি কয়েক বছরে শরীরের কোষ পাল্টে ফেলেন, তাহলে আপনি কি এখন সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ? নাকি আপনার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা এবং ধারাবাহিকতা আপনাকে আগের মতোই "আপনি" করে রাখে?

একই ধাঁধা প্রযোজ্য একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান বা একটি জাতির ক্ষেত্রেও। সময়ের সাথে সদস্য, কাঠামো, সংস্থান বদলায়, কিন্তু পরিচয় কি বদলে যায়? নাকি তার ইতিহাস, বিশ্বাস ও স্মৃতি সেই পরিচয়কে ধরে রাখে?

আধুনিক যুগে এই প্যারাডক্স আরও জটিল হয়ে উঠেছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্লোনিং, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। যদি কেউ কারও জেনেটিক ক্লোন তৈরি করে বা যদি মানুষের স্মৃতি ডিজিটালি সংরক্ষণ করে কৃত্রিমভাবে পুনরুত্থান ঘটানো যায়, তবে সেই অস্তিত্ব কি আসল মানুষটির মতোই "আসল"?

এই প্যারাডক্স আমাদের শেখায় যে পরিচয় শুধু পদার্থ বা শরীরের উপর নির্ভর করে না। সময়, স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, এবং গল্প—এই সবকিছুর সংমিশ্রণেই গড়ে ওঠে একজন মানুষের বা কোনো কিছুর সত্যিকার পরিচয়।

আমরা সবাই যেন থিসিয়াসের জাহাজের মতো—সময় ও অভিজ্ঞতায় বদলে যাই, আবার তবু কিছু থেকে যাই একই। তাই যদি কোনোদিন মনে হয় "আমি কি আগের সেই মানুষ?", তখন থিসিয়াসের জাহাজের গল্পটি মনে রাখবেন। কারণ পরিচয় হলো সেই রহস্য, যা মানুষকে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে শেখায়।
 

মারিয়া

×