ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

দেশের গরুতেই মিটবে চাহিদা

দেশি পশুতে কোরবানি

প্রকাশিত: ২০:০৭, ২৩ মে ২০২৫

দেশি পশুতে কোরবানি

রাজশাহী : কোরবানির পশুর হাট দিনকে দিন বেশ জমে উঠছে

আসছে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ ঈদের প্রধান ও অন্যতম অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। এ কারণে কোরবানির ঈদ বলা হয়। চাঁদের হিসাবমতে আর দুই সপ্তাহ পরই পবিত্র ঈদুল আজহা। সে হিসাবে বলা যেতে পারে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে ঈদের বার্তা।
এ ঈদে কোরবানির পশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকে গরু। গরু নিয়েই যত হৈ হুল্লোড় শুরু হয়। গরু নিয়ে ঘটে যায় নানা কাহিনী। গরুর পরই কোরবানির তালিকায় থাকে ছাগল। গরু ও ছাগলের পাশাপাশি ভেড়া, মহিষ কোরবানির তালিকায় থাকে। তবে গরুর চাহিদা হলো সবার শীর্ষে।
ঈদের আগের অন্তত এক মাস ধরেই গরুময় হয়ে উঠে সবক্ষেত্র। হাট-ঘাট, সড়কপথ কিংবা চায়ের স্টল সবখানেই গরু নিয়ে জমে উঠে অলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। কোন হাটে কত টাকার গরু বিক্রি হলো, কে কত বড় কোরবানির গরু কিনল এসব নিয়ে চলে যত বিতর্ক।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তাই এখনই জমে উঠতে শুরু করেছে রাজশাহী অঞ্চলের পশুহাটগুলো। দেশের সবচেয়ে কোরবানির পশু রয়েছে রাজশাহী বিভাগেই। এ বিভাগের উদ্বৃত্ত গরু-ছাগল চাহিদা মেটায় রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের কোরবানি দাতাদের। এবারও তার ব্যতিক্রম নই। রাজশাহী বিভাগের উদ্বৃত্ত কোরবানির পশু এবারও চাহিদা মেটাবে সারাদেশের।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব মতে এবার এ অঞ্চলের আট জেলায় ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত করেছেন কৃষক ও খামারিরা। যা এ অঞ্চলের কোরবানিদাতাদের চাহিদা মিটিয়ে জোগান দেবে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতবারের তুলনায় এবার শুধু রাজশাহী জেলায় কোরবানিযোগ্য পশু বেড়েছে ৩০ হাজার ৬৯৭টি। বিভাগের অন্য জেলাতেও বেড়েছে কোরবানিরযোগ্য পশু। ভারতীয় গরুর আগ্রাসন বন্ধ হওয়ায় দেশীয় গরু-ছাগলের প্রতিপলন ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায়।
এবার রাজশাহী বিভাগের ৩০২টি হাটে কোরবানির পশু বেচাকেনা হবে বলে জানিয়েছে বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর। ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের হাটে হাটে পশু আমদানি ও কেনাবেচা শুরু হয়েছে। এবার ব্যবসায়ীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কোরবানির পশু কেনাবেচা করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার হাটে হাটে আগাম কোরবানির পশু উঠতে শুরু করেছে। এখনো জোরতাল কেনাবেচা শুরু না হলেও চলতি সপ্তাহের তা জমে উঠবে। হাটে হাটে শুরু হবে ক্রেতা-বিক্রেতা আর বেপারিদের হাক-ডাক। এ অঞ্চলের পশুহাটগুলো সারাবছর জোরতাল থাকলেও কোরবানির ঈদের এক মাস আগে থেকে শতগুণ বেড়ে যায় ক্রেতা-বিক্রেতারের বিচরণ। ইতোমধ্যে রাজশাহীর হাটগুলোতে শুরু হয়ে গেছে ক্রেতা-বিক্রেতা আর বেপারিদের বিচরণ।
সর্বশেষ বুধবার ছিল রাজশাহীর সবচেয়ে বৃহৎ পশুর হাট সিটিহাটের নির্ধারিত দিন। সপ্তাহে দুটি হাটবার হলেও কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এ হাটটি প্রতিদিনই বসবে। রাজশাহী নগরীর বাইপাশ সড়কের পাশে বিশাল এ হাটের অবস্থান। বলা হয় এটিই রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় কোরবানির হাট। উত্তরবঙ্গে সব জেলার ক্রেতা-বিক্রেতা আর সারাদেশের পাইকাররা এ হাটে আসেন। বুধবার এ হাটে কোরবানির পশুর আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে।
শুধু সিটিহাট নয়, রাজশাহীর সব পশুহাটই এরই মধ্যে জমতে শুরু করেছে। হাটে হাটে আসতে শুরু করেছে বিপুল পরিমাণ কোরবানির পশু। এবারও রাজশাহী অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোরবানির পশু থাকায় হাটে হাটে ছোট, মাঝারি আকারের গরুগুলো আসছে ব্যাপক হারে। বড় আকারের গরুগুলো আরও কয়েকদিন পরে আসবে হাটে।

বাংলাদেশের বাজারে বিক্রেতারা নিয়ে আসছে কোরাবানির পশু
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজশাহীর বাগমারার আরেকটি বড় পশুহাট তাহেরপুর হাটে অন্তত আড়াই হাজার গরু-মহিষ আমদানি হয় বেচা-কেনার জন্য। এ হাটে এ মৌসুমে অন্তত ৫-৮ হাজার হাজার গরু-ছাগল ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন হাটের ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, রাজশাহীর সিটিহাটে সর্বশেষ বুধবার বিপুল পরিমাণ কোরবানির পশুর আমদানি হয়। কেনাবেচাও ভালো হয়েছে। চলতি সপ্তাহ থেকে সব হাটই জমে উঠবে বলে মনে করছেন ইজারাদার।
রাজশাহীর সব হাটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং খামারিরা এখন পশু বিক্রির প্রস্তুতির শেষ ধাপে রয়েছেন। ফলে হাটগুলোতে জমজমাট বেচাকেনা শুরু হতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে বলে জানান হাট ইজারাদার ও পশু ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীর সিটি হাটের ইজারাদার আমিনুল ইসলাম বলেন, গত রোজার ঈদের কয়েকদিন পর থেকেই এবার হাটে গরু আসছে ব্যাপক হারে। সেই হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, এবার পর্যাপ্ত পরিমাণ গরু আছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা এসে এসব গরুর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

রাজশাহী বিভাগে প্রস্তুত ৪৩ লাখ
গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষ

পবিত্র ঈদুল আজহায় এবার রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় (রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও জয়পুরহাট) প্রস্তুত করা হয়েছে ৪৩ লাখ কোরবানির পশু। বিভাগের কোরাবানিদাতাদের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে ১৭ লাখের বেশি পশু। এইসব পশুই বিক্রি হবে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কোরবানির হাটে। ঈদ ঘনিয়ে আসায় এখন পশুর বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন এ অঞ্চলের খামারিরা। স্থানীয় হাটেও পশু বেচাকেনা হচ্ছে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর এলাকার নাদিরা বেগম ৮ মাস আগে ৬৫ হাজার টাকায় একটি গরু কেনেন। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরুটি লালন পালন করে এখন বিক্রির উদ্দেশে হাটে তুলতে চান।তিনি বলেন, এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় গরুটি বিক্রি করতে চান তিনি। সেজন্য বাড়তি যত্নের পাশাপাশি গরুটিকে বাড়তি খাবারও খাওয়াচ্ছেন।
শুধু নাদিরা বেগমই নন, রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় বাড়িতে এখন একটি দুটি করে দেশি গরু, ছাগল মহিষ লালন পালন করছেন খামারিরা। তবে বড় বড় খামারগুলোতে শাহীওয়াল, সিন্ধি, রেট চিটাগাং, পাবনা ব্রিড ও মীর কাদিমসহ নানা জাতের গরু কোরবানিতে বিক্রির উদ্দেশ্যে মোটাতাজাকরণ (হৃষ্টপুষ্ট) করা হচ্ছে।
রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সব জেলায় পালন হচ্ছে এসব কোরবানিযোগ্য পশু। খামারিরা বলছেন, কোনো ধরনের ক্ষতিকর ইনজেকশন ও ভিটামিন ওষুধ ছাড়া শুধু ঘাস, ভুট্টা, ফিড এবং দানাদার খাবার খাইয়ে পশুগুলোকে লালন পালন করা হচ্ছে। কোরবানির জন্য পশুগুলোকে প্রস্তুত করতে যত্নের কোনো কমতি রাখা হচ্ছে না। কৃষক ও খামারি পর্যায়ে পশুগুলো পালন করে এরই মধ্যে বেচাকেনাও শুরু হয়েছে। আবার এখনো অনেকেই পশুর পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটচ্ছেন। বিশেষ করে মোটা জাতের গরুগুলো শেষ সময়ের দিকে বেচাকেনা হয় বেশি বলে এসব গুরুর পরিচর্যায় আরও বেশি সময় দিচ্ছেন খামারি ও কৃষকরা।
খামারিরা জানান, তারা অতিযত্নে গরু-ছাগল লালন পালন করলেও হাটে কোরবানির পশুর দাম নিয়ে সংশয় রয়েছে। বেপারিরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, পশুর দাম এবার বেশ চড়া হবে। কারণ এখন তাদের প্রতিটি পশু কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। তবে রাজশাহীর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. অনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, আশা করছি ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে গরু কিনতে পারবেন। পাশাপাশি খামারিরাও পশুর ভালো দাম পাবেন। আর সীমান্ত এলাকায় কড়া নজরদারি থাকায় প্রতিবেশী দেশ থেকে পশু না আসায় দেশি গরুর খামারিরা এবার ভালো দাম পাবেন এমন প্রত্যাশা প্রাণিসম্পদ বিভাগের।
বেপারিরা জানান, ইতোমধ্যে তারা কোরবানির পশু কেনাবেচা হয়েছে। তারা রাজশাহী বিভাগের আট জেলার হাট ও খামার থেকে বেপারিরা কোরবানির পশু কিনে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে কোরবানির পশুর জমজমাট বেচাকেনা।

রাজশাহী : ৩০২ কোরবানির হাট

সংশ্লিষ্ট জেলার উদৃৃতি দিয়ে রাজশাহী আঞ্চলিক তথ্য অধিদপ্তর জানায়, রাজশাহী বিভাগের ৩০২টি হাটে এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশু কেনা-বেচা হবে। এরই মধ্যে অধিকাংশ হাটে পশু কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। বাকি আছে গ্রামের কিছু হাট। এগুলোও চলতি সপ্তাহেই শুরু হবে কেনাবেচা।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বিভাগের মোট ৩০২টি পশুর হাটের মধ্যে স্থায়ী হাট রয়েছে ১৬১টি এবং অস্থায়ী ১৪১টি।
এর মধ্যে রাজশাহী নগরীর সিটিহাট সবচেয়ে বৃহৎ। এ হাটে সারা বিভাগের সব জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে কমবেশি পশু আমদানি হয়। এবারও এ হাটে সর্বোচ্চ কোরবানির পশু কেনাবেচার আশা করা হচ্ছে। এখানে গত প্রায় ১৭ বছর ধরে সপ্তাহের দুদিন হাট বসে। ঈদ ঘিরে হাটে কোরবানির পশু বিক্রির পরিধি এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে।
রাজশাহীর সিটিহাটের খাটাল মালিক মতিউর রহমান জানান, কোরবানির ঈদ ঘিরে এখন হাটে গড়ে ৮-১০ হাজার গরু আসছে। প্রতিদিন বাড়ছে গরু-মহিষের সংখ্যা। আর কয়েকদিন পরে সেটি ২০ হাজার ছাড়ায় যাবে।
তিনি বলেন, হটে এখন ছোট আর মাঝারি আকারের গরু আসছে বেশি। কারণ মোটা গরুর চাহিদা এখনো তেমন দেখা যাচ্ছে না। হাটে মোটা গরু এনে বিক্রি না হলে খামারিরা লোকসানের মুখে পড়েন। তাই শেষদিকে যখন চাহিদা বাড়ে, তখন মোটা গরুও আসে অনেক। পাইকাররাও মোটাতাজা বড় আকারের গরু কিনেন বেশি।
এ হাটের ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, এখন গড়ে ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি মাংস টার্গেট করে গরু কেনাবেচা হচ্ছে। সেই হিসাবে ৩০-৩২ হাজার টাকা মণ পড়ছে গরু। মহিষও এবার প্রায় একই দামে বিক্রি হতে পারে। তবে শেষদিকে গিয়ে দাম আরও বাড়তে পারে।
এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য হাটগুলোর মধ্যে রাজশাহী সদরের সিটিহাট। উত্তরের এই হাটটি এখন সবচেয়ে বৃহৎ। এ হাটে সারাদেশের পাইকাররা আসেন গরু কিনতে। নগরীর অদূরে আরেক হাট রয়েছে পবা উপজেলায় দামকুড়া পশুহাট হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী আমলের ১৭ বছর এ হাটটি বন্ধ ছিল। তবে এবার আবার চালু হয়েছে। সিটিহাট ও দামকুড়া হাট সপ্তাহ দুদিন বসে।
রাজশাহীর উপজেলা পর্যায়েও রয়েছে বেশকিছু বড়হাট। এসব হাটে কোরবানির সময় ১০ গুণ কেনাবেচা বেড়ে যায়। এসব হাটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, তানোরের মুন্ডুমালা, গোদাগাড়ীর কাকনহাট, মহিষালবাড়িহাট, মোহনপুরের কেশরহাট, পবার নওহাটা, খাটাখালী, দামকুড়া, বাঘার রুস্তুমপুর-আড়ানী ও চন্ডিপুর, বাগমারার ভবানীগঞ্জ, তাহেরপুর, নাটোরের তেবাড়িয়া, গুরুদাসপুরের চাচকৈড়, আহম্মদপুরহাট, আবদুলপুরহাট, নওগাঁর মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়াহাট ও সতিহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের বটতলাহাট, শিবগঞ্জের তক্তিপুরহাট, নাচোলের সোনাইচন্ডিহাট, জামবাড়িয়া, গোমস্তাপুরের রহনপুরহাট। বগুড়ার কালিতলা, বোনানীহাট, শিবগঞ্জের গাবতলী, বুড়িমারীহাট, সান্তাহার, সিরাজগঞ্জের তালগাছিহাট, পাবনার অরনখোলাহাট, বেড়ার চতুরহাট, কাশিনাথপুরহাট, সুজানগর ও শ্যামগঞ্জহাট উল্লেখযোগ্য। এসব হাট নিয়মিত। ঈদ মৌসুমের বিভিন্ন জেলার ক্রেতা-বিক্রেতা ও পাইকারদের আনাগোনায় মুখর থাকে এসব হাট। ইতোমধ্যে এসব হাটে বিপুল পরিমাণ পশু আমদানির পাশাপাশি কেনাবেচাও শুরু হয়ে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
রাজশাহী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে চার লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৩ গবাদিপশু। এর মধ্যে গরু এক লাখ ১৫ হাজার ৭৪২টি, মহিষ চার হাজার ২৪০টি, ছাগল তিন লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৩ এবং ভেড়া ৩০ হাজার ১৪৮টি। এটি রাজশাহী জেলার চাহিদার তুলনায় বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় কোরবানিযোগ্য পশু বেড়েছে ৩০ হাজার ৬৯৭টি। বিগত বছরে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল চার লাখ ৬৬ হাজার ১৯৬টি। এর মধ্যে গরু ৮৩ হাজার ৩৬৫টি, মহিষ তিন হাজার ৭৬৯টি ও ছাগল তিন লাখ ৪২ হাজার ৭৫৩টি।
জেলার গোদাগাড়ীর গরুর খামারি আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি তার বাড়িতে ১৪টি গরু পালন করেছেন। এগুলো সবই দেশি জাতের। এরই মধ্যে ৬টি গরু তিনি এরই মধ্যে বাড়িতেই বিক্রি করেছেন। তিন মণের একটু বেশি মাংস হবে এমন আকারের চারটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে। আবার তার চেয়ে ছোট দুটি বিক্রি করেছেন ৯৫ হাজার টাকা এবং ৯৮ হাজার টাকায়।
তিনি আরও জানান, তার বাড়িতে থাকা ৮টি গরুর মধ্যে একটা আছে ৫ মণ মাংস হবে। এটি তিনি তিন লাখ টাকায় বিক্রি করবেন বলে আশাবাদী। তবে তার এই গরুর এখনো ক্রেতা মেলেনি। আবার হাটেও তোলেননি তিনি।
কোরবানিকে কেন্দ্র করে বাসা-বাড়ি ও খামারে লালন-পালন করা পশুর বাড়তি যত্ন নেওয়া হচ্ছে। খামারিরা গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খাওয়াচ্ছেন ঘাস, ভুট্টা, খৈল ও ভুসিসহ পুষ্টিকর সব খাবার। তবে গোখাদ্যের দাম বাড়ায় এবার পশুর দাম কিছুটা বেশি থাকতে পারে।
জেলার পবা উপজেলার হরিয়ান গ্রামের খামারি মিজানুর রহমান জানান, তার খামারে ছয়টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে চারটি কোরবানির উপযোগী। অল্প সময় থাকায় তিনি বাড়তি পরিচর্যা নিচ্ছেন। মিজানুর রহমান বলেন, ‘গরুগুলো চার মাস ধরে লালন-পালন করছি। খামারে বিক্রি না হলে, হাটে তুলবো। ইচ্ছে আছে খামার থেকে বিক্রি করার। সব খাবারই কিনে খাওয়াতে হয়। গতবারের চেয়ে এবার পশুখাদ্যের দাম বেশি। ঘাস, ভুট্টা, খৈল ও বিভিন্ন ধরনের ভুসির দাম বেড়েছে।

তরুণ উদ্যোক্তার এগ্রো ফার্ম
একই উপজেলার খামারি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় কোরবানির সময় পশুর দাম কিছুটা হলেও বেশি থাকে। কোরবানিতে বিক্রির জন্য অনেকে পশু পালন করে থাকেন। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি বা দুটি গরু আছে। গ্রামের মানুষ মাঠে কাজ করার পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে এগুলো পালন করেন। তবে বাইরে থেকে গরু আমদানি না হওয়ায় এবার ভালো দাম পাওয়া যাবে।
পবা উপজেলার মুদি দোকানি রহিদুল ইসলাম বলেন, ডালের ভুসির দাম বেড়েছে। কাটা খড়, ভুট্টার গুঁড়া, খৈলের দামও বেড়েছে। কয়েক মাস থেকে বাড়ছে গোখাদ্যের দাম।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গতবারের চেয়ে এবার কোরবানিযোগ্য পশু বেড়েছে। গতবারের তুলনায় এবার গরু বেড়েছে ৩২ হাজার ৩৭৭টি, মহিষ বেড়েছে ৪৭১টি ও ছাগল বেড়েছে চার হাজার ১০টি।

হাটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা

রাজশাহী অঞ্চলের কোরবানির হাটে হাটে এবারও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রাজশাহী নগর ও জেলার পশুহাটের নিরাপত্তা বিধানে মহাসড়কের পাশে কোনো পশুর হাট বসানো যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, প্রতিটি পশুর হাটে সিসি ক্যামেরা, জেনারেটর, নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রাখার জন্য ইজারাদার, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং বাজার কমিটি ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট নেতাদের বলা হয়েছে।
পশু রাখার জন্য শেড তৈরি করা, আগত ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের জন্য পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখার জন্যও বলা হয়েছে। হাটে যেন দ্বন্দ্ব না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে।
এছাড়া সব পশুাহাটে জাল টাকা শনাক্তকরণ ও লেনদেন সংক্রান্ত বুথ স্থাপনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজশাহী নগর পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন, সব পশুহাটে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি প্রতিরোধে টহল বৃদ্ধির পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে। সার্বিক নিরাপত্তায় হাটকেন্দ্রিক পুলিশের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হবে। কোনো পশুবাহী গাড়ি জোরপূর্বক হাটে আনা যাবে না। মহাসড়কে পশু লোডিং বা আনলোডিং করা যাবে না। যানজট রোধে ট্রাফিক ব্যবস্থা আরও জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও উপজেলা ভিত্তিক পশুহাট ঘিরে একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
 
মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক

রাজশাহী বিভাগের শহরাঞ্চল থেকে উপজেলা পর্যায়ের সব কোরবানির পশহাটে এবার মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বসবে। সেখানে ভেটেরিনারি সার্জন থাকবেন, তারা চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
তিনি বলেন, হাটে হাটে গরু-ছাগলের পিছনের যে মানুষ থাকবে তারা যেন নিরাপদে আসতে পারে, নিরাপদে ফেরত যেতে পারে সেটারও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কোরবানির পশুর যত্ন

রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় শুরু হয়েছে কোরবানির পশু লালন-পালনের শেষ ধাপের প্রস্তুতি। খামার ও গ্রামীণ বাড়িঘরে দেশি জাতের গরু, ছাগল ও মহিষ লালন-পালনে ব্যস্ত সময় পার করছেন খামারিরা।
গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক খামারি নিজ নিজ ঘরে এক থেকে দুটি করে দেশি জাতের পশু লালনপালন করছেন। পাশাপাশি বড় খামারগুলোতে নানা জাতের গরু কোরবানির জন্য মোটাতাজা করা হচ্ছে।
সীমান্ত দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ থাকায় গত কয়েক বছর ধরে দেশি গরুর চাহিদা ও দাম উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। খামারিরা আশা করছেন, এবারও দেশি পশুর ভালো দাম পাওয়া যাবে। যদিও হাটে কিছু খামারি অভিযোগ করছেন, তাদের থেকে কম দামে পশু কেনার চেষ্টা করছে বেপারিরা। তবে বেপারিরা বলছেন, গরুর দাম খামারিরা অনেক বেশি চাচ্ছেন।
খামারিরা এখন নিজেদের পশু প্রস্তুতের শেষ পর্বে ব্যস্ত। খাবার ও পরিচর্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতাও রয়েছে তাদের মূল ফোকাসে।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের শাহজাহান বলেন, শেষ সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গরুকে সকালে ঘাস, বিকেলে ভুসি-চিটা আর একটু ফিড দিচ্ছি নিয়ম মেনে। গরুগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সবকিছু খেয়াল রাখছি যেন হাটে তুলে ভালো দাম পাই।

তুলনামূলক উৎপাদন হার

এবারের ঈদে বিপুলসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। বিভাগের আট জেলায় প্রস্তুত ৪৩ লাখ কোরবানির পশু। বিভাগের কোরবানিদাতাদের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে ১৭ লাগের বেশি পশু। বিভাগের সবচেয়ে বেশি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে নওগাঁয়।
এ জেলায় পশুর চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার আর পশু রয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার। বগুড়ায় পশুর চাহিদা ৭ লাখ ৯ হাজার, পশু রয়েছে, ৭ লাখ ৪৬ হাজার। রাজশাহীতে পশুর চাহিদা ৩ লাখ ৮১ হাজার, পশু রয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার। নাটোরে চাহিদা ২ লাখ ৭৩ হাজার, পশু রয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার। পাবনায় কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার, পশু রয়েছে ৬ লাখ ৪৮ হাজার। সিরাজগঞ্জে কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা ২ লাখ ৫৬ হাজার, পশু রয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। এছাড়া বিভাগের জয়পুরহাট জেলায় কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা রয়েছে একলাখ ৯৭ হাজার, এর বিপরীতে পশু রয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগের আটটি জেলায় মোট কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা ও উদ্বৃত্ত অংশের তুলনামূলক চার্ট নিম্নরূপ।

রাজশাহী বিভাগের জেলাওয়ারি কোরবানির পশুর উৎপাদন ও চাহিদা চিত্র

রাজশাহী : চাহিদা ৩.৮১ লাখ, উৎপাদন ৪.৯৬ লাখ
নাটোর : চাহিদা ২.৭৩ লাখ, উৎপাদন ৫.১৪ লাখ
নওগাঁ : চাহিদা ৩.৮৬ লাখ, উৎপাদন ৭.৮৮ লাখ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাহিদা ১.৩৪ লাখ, উৎপাদন ২ লাখ
পাবনা: চাহিদা ৩.১২ লাখ, উৎপাদন ৬. ৪৮ লাখ
সিরাজগঞ্জ : চাহিদা ২.৫৯ লাখ, উৎপাদন ৬.৫৫ লাখ
বগুড়া : চাহিদা ৭.০৯ লাখ, উৎপাদন ৭.৪৬ লাখ
জয়পুরহাট : চাহিদা ১.৯৭ লাখ, উৎপাদন ৩.১৬ লাখ।
মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

প্যানেল

×